জলবায়ু পরিবর্তনের ফল দেখছে ভারত

১৩০ কোটির বেশি জনসংখ্যার দেশ ভারত ঘূর্ণিঝড়, হিমালয়ে হিমবাহ ধস, অতি উত্তপ্ত দাবদাহ, অতিবৃষ্টি ও প্রাণসংহারী বন্যার মুখোমুখি হচ্ছে।

ভারী বৃষ্টির ফল সৃষ্ট বন্যায় ডুবে গেছে মহারাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। গত বৃহস্পতিবার রত্নাগিরি এলাকায়ছবি : এএফপি

ভারী মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পরে ভারতের কয়েকটি অঞ্চলে মারাত্মক বন্যা এবং ভূমিধসের সৃষ্টি হয়েছে। বিশাল এই দেশটি কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে পড়েছে, তার সাম্প্রতিক উদাহরণ এটি।

চলতি বছরের প্রথম সাত মাসের মধ্যেই ১৩০ কোটির বেশি জনসংখ্যার দেশটি দুটি ঘূর্ণিঝড়, হিমালয়ে একটি মারাত্মক হিমবাহ ধস, একটি অতি উত্তপ্ত দাবদাহ ও প্রাণসংহারী বন্যার মুখোমুখি হয়েছে।

হিমবাহ ধস

গত ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতীয় হিমালয় উপত্যকায় আকস্মিক এক বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। উত্তরাখন্ডে হিমবাহ ভেঙে সৃষ্ট ধস ও বন্যায় দুই শতাধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল; ভাসিয়ে নিয়েছিল জলবিদ্যুৎ প্রকল্পও। ওই ঘটনায় মাত্র ৬০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে ভারতীয় হিমালয় অংশে প্রায় ১০ হাজার হিমবাহ প্রতি দশকে ৩০ থেকে ৬০ মিটার (১০০ থেকে ২০০ ফুট) গলে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ১৫টি ফুটবল মাঠের সমান দীর্ঘ এই হিমবাহ উঁচু পর্বত থেকে ভেঙে পড়ে। ওই ঘটনার তদন্তকারী এক হিমবাহ বিশেষজ্ঞ বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, ‘ওই বিপর্যয়ের ঘটনাটি জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট একটি ফলস্বরূপ। এটাই আমাদের ভবিষ্যতের একটি গল্প বলে।’

হিমবাহ ধসের কারণে বন্যার সৃষ্টি হয়। উত্তরাখণ্ড, ৭ ফেব্রুয়ারি।
ছবি: রয়টার্স

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে ভারতীয় হিমালয় অংশে প্রায় ১০ হাজার হিমবাহ প্রতি দশকে ৩০ থেকে ৬০ মিটার (১০০ থেকে ২০০ ফুট) গলে যাচ্ছে। ২০১৩ সালে ওই এলাকায় আকস্মিক এক বন্যায় ছয় হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।

প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়

ভারত মহাসাগরে ঘূর্ণিঝড় বিরল কোনো ঘটনা নয়। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আরও প্রবল ও ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে পারে।
গত মে মাসে ভারতে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় তকতে। এতে ১৫৫ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। ভারতের মহারাষ্ট্রের মুম্বাইয়ে আঘাত হানে তকতে। প্রতি ঘণ্টায় বাতাসের গতিবেগ ওঠে ১৮৫ কিলোমিটার। বিগত ৩০ বছরের মধ্যে এটি ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়।

তকতের রেশ কাটতে না কাটতেই আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে ইয়াসের আঘাতে ভারতে কমপক্ষে নয়জন প্রাণ হারান। ওডিশা সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ওই সময় উপকূলের প্রায় দুই লাখ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়।

ইয়াসের আঘাতে ভারতে অনেকেই গৃহহীন হন।
ছবি : রয়টার্স

ঘূর্ণিঝড়ে উত্তাল সাগর ও দ্বিতল বাসের সমান ঢেউয়ের আঘাতে শত শত মানুষ তাঁদের ঘরবাড়ি হারান। ঘূর্ণিঝড়ে বেঁচে যাওয়া এক ব্যক্তি বলেন, ‘মারাত্মক ওই ঝড়ে আমি ঘরসহ আমার সবকিছু হারিয়েছি।’

দাবদাহ

বিশ শতকের শুরুতে এবং ২০১৮ সালে ভারতের গড় তাপমাত্রা বেড়ে যায় দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (১ দশমিক ৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট) কাছাকাছি। ভারত সরকারের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২১০০ সাল নাগাদ দেশটির গড় তাপমাত্রা আরও ৪ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। জুলাই মাসের শুরুতে উত্তর ভারতে ভয়াবহ দাবদাহের শিকার হয় কয়েক কোটি মানুষ।

১৯৭১ সালের পর থেকে ভারতে দাবদাহে ১৭ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর ঘোষণা করেছে, গত দশকে প্রায় প্রতিবছরেই দাবদাহ বয়ে গেছে। কখনো কখনো তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে। ভারতের গণমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস–এর প্রতিবেদনে বলা হয়, শীর্ষ আবহাওয়াবিদদের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের পর থেকে ভারতে দাবদাহে ১৭ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

ভারতে তীব্র দাবদাহ প্রায় পানি শুকিয়ে যাওয়া একটি পুকুরে মাছ ধরছেন স্থানীয়রা।
ছবি: এএফপি

বর্তমানে ভারতে মাত্র ৫ শতাংশ বাড়িতে এয়ারকন্ডিশনের সুবিধা আছে। যুক্তরাষ্ট্রে এই হার ৯০ শতাংশ এবং চীনে ৬০ শতাংশ। বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, আগামী বছরগুলোতে এয়ারকন্ডিশনের বাজার বড় হবে এবং এ ক্ষেত্রে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়বে। বর্তমান বিশ্বে তৃতীয় কার্বন নিঃসরণ উৎস এয়ারকন্ডিশন।

বন্যা

ভারতের পশ্চিম উপকূল গত কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত। ভারতের বন্যাকবলিত মহারাষ্ট্র ও গোয়ায় এখনো অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এনডিটিভির খবরে জানানো হয়েছে, মহারাষ্ট্রে বন্যায় এ পর্যন্ত ১৩৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে। গোয়ায় কয়েক শ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে অতিবৃষ্টির কারণে বন্যা দেখা দিয়েছে।

ভারতের মহারাষ্ট্রে বন্যায় আটকে পড়া ব্যক্তিদের উদ্ধার করছেন উদ্ধারকর্মীরা।
ছবি : রয়টার্স

মুম্বাইয়ের দক্ষিণ-পূর্বে তালিয়ে এলাকায় ভূমিধসের কারণে বেশ কয়েকটি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রয়টার্সকে এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সেখানে কমপক্ষে ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

গত এপ্রিল মাসে জার্মানির পটসডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইম্প্যাক্ট রিসার্চের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তন বর্ষাকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে। জলবায়ু পরিবর্তন খাদ্য, কৃষি ও অর্থনীতিতে বিশ্বের এক–পঞ্চমাংশ মানুষের ওপর প্রভাব ফেলবে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটি।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বজ্রপাত বেড়েছে।
ছবি : রয়টার্স

বজ্রপাত

শুধু বন্যা নয়, জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বর্ষা মৌসুমে আকাশ থেকেও বিপদ নেমে আসে। ২০১৯ সালে শুধু বজ্রপাতে ভারতে মারা গেছে তিন হাজারের বেশি মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই বজ্রপাতের ঘটনা বেশি ঘটছে।

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত বছরে বজ্রপাতের ঘটনা ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। বজ্রপাতের প্রভাব মানুষের পাশাপাশি অন্যান্য প্রাণীর ওপরেও পড়ছে। গত মে মাসে আসামে ১৮টি হাতি বজ্রপাতে মারা গেছে।