টিকার প্রথম মডেল ভারতীয় রানি

গুটিবসন্তের টিকা নিতে ভারতীয়দের উদ্বুদ্ধ করতে ১৮০৫ সালে আঁকা চিত্রকর্মে রানিরা।
ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

স্থান মহীশুরের রাজদরবার। সাল ১৮০৫। এর কিছুদিন আগে তৃতীয় কৃষ্ণরাজা ওয়াদিয়ার মহীশুর রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছেন। রানি দেভাজাম্মানি যখন এই রাজপ্রাসাদে এলেন, তখন তাঁর বয়স ১২ বছর। রাজার বয়সও কাছাকাছি। তিনি ছিলেন ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের এই রাজ্যের নতুন রাজা।

ভারতসহ বিভিন্ন দেশেই তখন গুটিবসন্তের প্রকোপ। দেভাজাম্মানিকে এই সময় ব্যবহার করা হয় গুটিবসন্তের টিকাদান কর্মসূচির মডেল হিসেবে। তবে সেই সময় প্রযুক্তি এত সহজলভ্য ছিল না। প্রচারমাধ্যমও এত শক্তিশালী ছিল না। ফলে সাবেকি পদ্ধতিই ব্যবহার করা হয় টিকার প্রচারের জন্য। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ নাইজেল চ্যান্সেলরের বরাত দিয়ে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি।

টিপু সুলতানের পতনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে আসে মহীশুর। কিন্তু এই মহীশুরে আগে ক্ষমতাসীন ছিলেন ওয়াদিয়াররা। তাই তাঁদের হাতেই ক্ষমতা তুলে দেয় ব্রিটিশরা। তবে এর মধ্য দিয়ে ওয়াদিয়ার পরিবারের ওপর একধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশদের। ওই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতজুড়ে গুটিবসন্তের টিকা ছড়িয়ে দিতে চাইছিল। কিন্তু মানুষের সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে টিকার প্রচারের জন্য রাজা–রানিদেরই ব্যবহারের কৌশল নেয় কর্তৃপক্ষ। দেভাজাম্মানির ইচ্ছা না থাকলেও তাঁর একটি চিত্রকর্ম আঁকা হয়।

মহীশুরে টিপু সুলতানের শাসনের পতনের পরও ভারতে ব্রিটিশ শাসন সেভাবে পোক্ত হয়নি। ঠিক এ সময়ই তৎকালীন মাদ্রাজের (বর্তমান চেন্নাই) গভর্নর উইলিয়াম বেনটিক গুটিবসন্ত দমনের মধ্যে একটি রাজনৈতিক সুযোগ দেখতে পেলেন। ওয়ার অ্যাগেইনস্ট স্মলপক্স বইয়ের রচয়িতা অধ্যাপক মাইকেল বেনেট লিখেছেন, ব্রিটিশরা ভারতে ব্যাপক হারে টিকা দেওয়ার একান্ত চেষ্টা করছিল।

ভারতে রানি দেভাজাম্মানির ছবিটি এঁকে প্রচার চালানোর জন্য প্রস্তুতি যখন চলছে, তার ছয় বছর আগেই টিকাটি আবিষ্কার করেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড জেনার। কিন্তু এই টিকা নিয়ে ভারতীয়দের মনে সন্দেহ ছিল। তবে ব্রিটিশরা দমে যায়নি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিশ্বের প্রথম কোনো টিকার প্রয়োগ ভারতে করতে চাইছিল। যেহেতু ভারত ছিল তাদের সবচেয়ে বড় উপনিবেশ, তাই একটি বড় পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয় তারা। এ জন্য ব্রিটিশ শল্যচিকিৎসক, ভারতীয় চিকিৎসক—যাঁরা টিকা নিয়ে কাজ করছেন এবং ব্রিটিশদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ রাজপরিবারগুলোকে এই কাজে যুক্ত করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। নাইজেল চ্যান্সেলরের ধারণা, রানিকে টিকা দেওয়া হয়েছিল—চিত্রকর্মটি শুধু এই তথ্যই বহন করে না। ভারতে গুটিবসন্তের টিকা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্রিটিশরা যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তারও তথ্য বহন করে এই চিত্রকর্ম।

২০০৭ সালে এই চিত্রকর্ম নিলামে তোলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক সোথেবিস অকশন হাউসকে দেওয়া হয়েছিল। ছবির বিষয়বস্তু সম্পর্ক তাদের তেমন ধারণা ছিল না। তখন ধারণা করা হচ্ছিল, ছবির নারীরা রাজদরবারের নৃত্যশিল্পী। তবে এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন নাইজেল চ্যান্সেলর। তিনি বলেন, এই ধারণা ছিল ভুল। কারণ, চিত্রকর্মের ডান পাশের নারী রানি দেভাজাম্মানি। চিত্রকর্মে তাঁর বাঁ হাত দেখানো হয়েছে। স্পষ্টই বোঝা যায়, তিনি হাতটি নির্দেশ করছেন। তাঁকে যে টিকা দেওয়া হয়েছে, সে জন্যই এটা করা হয়েছে। ছবিতে বোঝানো হয়েছে, টিকা নেওয়ার ফলে তাঁর কোনো ক্ষতি হয়নি।

নাইজেল চ্যান্সেলর বলেন, এই ছবির বাঁয়ে যিনি রয়েছেন, তিনি তৃতীয় কৃষ্ণরাজা ওয়াদিয়ারের প্রথম রানি। তাঁর নামও দেভাজাম্মানি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, তাঁর নাকের নিচে দাগ রয়েছে। এটি বসন্তের চিহ্ন। আর মাঝের নারীটি রাজার দাদি লক্ষ্মী আম্মানি বলে মনে করছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ নাইজেল। গুটিবসন্তে তিনি তাঁর স্বামীকে হারিয়েছিলেন।