ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে সাম্প্রতিক দিনগুলোয় বায়ুদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কর্তৃপক্ষ জরুরি পদক্ষেপ নিচ্ছে।
সাধারণত শীতের মাসগুলোয় নয়াদিল্লিতে ‘ধোঁয়াশা’ পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ থাকে। এমন পরিস্থিতির জন্য বিভিন্ন কারণকে দায়ী করা হয়। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে খড় পোড়ানো, শিল্পকারখানার নির্গমন, যানবাহনের ধোঁয়া, আবহাওয়ার ধরন, দীপাবলি উৎসবের সময় আতশবাজি প্রভৃতি।
কিন্তু এ কারণগুলোর প্রতিটি সমস্যা সৃষ্টির ক্ষেত্রে কতটা ভূমিকা রাখে? বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।
দিল্লির বায়ুদূষণ কতটা মারাত্মক
‘পিএম২.৫’ হলো বায়ুদূষণকারী ক্ষুদ্র কণা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ১০ মাইক্রোগ্রাম পিএম২.৫ থাকলে তাকে সহনীয় বলা যায়। কিন্তু নয়াদিল্লির বাতাসে পিএম২.৫-এর উপস্থিতি আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে অনেক বেশি।
গত এক সপ্তাহে পূর্ব দিল্লির আনন্দ বিহার এলাকার বায়ুমান পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, সেখানকার প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পিএম২.৫-এর উপস্থিতি ৩০০ মাইক্রোগ্রামের ওপরে।
বায়ুদূষণের গুরুতর পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দিল্লির স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। নির্মাণকাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের বাড়িতে থেকে কাজ করতে বলা হয়েছে।
ভারতের প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানার এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে আরও জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
গ্রিনপিসের তথ্য অনুযায়ী, করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে লকডাউন থাকা সত্ত্বেও গত বছর বায়ুদূষণ-সংশ্লিষ্ট কারণে দিল্লিতে প্রায় ৫৭ হাজার মানুষের অকালমৃত্যু হয়েছে।
দিল্লিতে বায়ুদূষণের কারণ কী
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বলছে, বায়ুদূষণের একটি কারণ হলো ফসল তোলার পর খড় পোড়ানো। তবে খড় পোড়ানোর দায় ১০ শতাংশের বেশি নয়।
প্রতি শীতের শুরুতে দিল্লির কাছাকাছি রাজ্যগুলোর কৃষকেরা গম চাষের জন্য খেত প্রস্তুত করতে ধানসহ অন্যান্য ফসলের অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে ফেলেন। এ থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া বায়ুদূষণে ভূমিকা রাখে।
ফসলের অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে ফেলার এই চর্চা ২০১৫ সালে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা সর্বাত্মকভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি।
ভারত সরকারের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ তথ্যে দেখা যায়, সামগ্রিক দূষণের মাত্রায় খড় পোড়ানোর যে ভূমিকা, তা দৈনিক ভিত্তিতে ওঠানামা করে।
প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৫ নভেম্বর খড় পোড়ানো থেকে সৃষ্ট পিএম২.৫ কণা বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ অবদান রেখেছে। তবে এক সপ্তাহ আগেই এ অবদান ছিল ৪৮ শতাংশ।
দীপাবলির আতশবাজির প্রভাব
ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্য দীপাবলি উদ্যাপনে আতশবাজি বিক্রি ও এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু দেশটির অনেক রাজ্যেই এ নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি।
২০১৮ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়, বায়ুদূষণে দীপাবলির আতশবাজির প্রভাব রয়েছে। এ প্রভাব ছোট হলেও পরিসংখ্যানগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
সমীক্ষাটিতে দিল্লির পাঁচটি স্থানের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। সমীক্ষায় ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে সংগৃহীত তথ্য পর্যালোচনা করা হয়।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, চার বছরের মধ্যে দুই বছর দীপাবলি উদ্যাপনের সময় সরাসরি খড় পোড়ানোর ঘটনা ঘটেনি।
গবেষকেরা দেখতে পান, দীপাবলির ছুটির কারণে দিল্লির কোনো অংশে শিল্পকারখানার কার্যক্রম বন্ধ থাকে।
পর্যালোচনায় আবহাওয়ার ধরনকে একটি কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়।
গবেষকেরা দেখতে পান, দীপাবলির উৎসবের দ্বিতীয় দিন পিএম২.৫-এর ঘনত্ব প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। দীপাবলি শেষ হওয়ার পর তা আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে।
অন্যদিকে, সময়ভিত্তিক (ঘণ্টা) পর্যালোচনায় দেখা যায়, দীপাবলির সময় সন্ধ্যা ছয়টার পর পাঁচ ঘণ্টার জন্য দূষণের মাত্রা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
দিল্লিভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০১০ সালে ভারতের রাজধানীতে দীপাবলির সময় পিএম২.৫-এর ঘনত্ব বেড়ে গেছে।
আতশবাজিতে ভারী ধাতুসহ অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থ থাকে। ভারতের জামশেদপুর শহরে করা এক গবেষণায় দীপাবলির সময় বায়ুতে নিম্নোক্ত পদার্থের মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায়—
*পিএম১০ কণা
*সালফার ডাই-অক্সাইড
*নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড
*ওজোন
*লোহা
*সিসা
*ম্যাংগানিজ
*তামা
*বেরিলিয়াম
*নিকেল
ভারত সরকারের সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড আতশবাজিতে পাওয়া ১৫টি পদার্থের তালিকা করেছে। এগুলোকে তারা বিপজ্জনক ও বিষাক্ত হিসেবে বর্ণনা করেছে। এই পদার্থগুলোর মধ্যে কিছু কিছু গাড়ির নির্গমন থেকেও সৃষ্টি হতে পারে।
দিল্লির সড়কে দীপাবলির সময় যানবাহনের চাপ বেড়ে যায়। কারণ, এ সময় লোকজন কেনাকাটা করতে বাইরে যায়। তারা আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যায়। এর একটা প্রভাব বায়ুমানে পড়ে।