পশ্চিমবঙ্গে দুই মন্ত্রীর মামলার রায়ে ধাক্কা খেল তৃণমূল
পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী নেতা-মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি আবার শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের সচিবও। আগে ছিলেন এই রাজ্যেরই শিক্ষামন্ত্রী। এখন শিল্পমন্ত্রী। এই পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারী ফেঁসে গেলেন শিক্ষকতার চাকরিতে নিজেদের দলের লোক নিয়োগ করার জেরে। এ ঘটনায় কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের হয়েছিল দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরিতে নিয়োগের মামলা। গতকাল শুক্রবার মামলার রায়ের পর প্রকৃতির গরম হাওয়ার সঙ্গে মিশে এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেও বইছে তপ্ত হাওয়া। এই মামলার রায় দেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।
গতকাল কলকাতা হাইকোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে জানিয়ে দেন, রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর কন্যা অঙ্কিতা অধিকারীকে শিক্ষকতায় নিয়োগ করার বিষয়টি ছিল অবৈধ। মন্ত্রীর মেয়ে ইন্টারভিউ না দিলেও, এমনকি মেধাতালিকায় তাঁর নাম না উঠলেও প্রভাব খাটিয়ে তাঁকে চাকরি দেওয়া হয়। আর বঞ্চিত করা হয় মেধাতালিকায় থাকা প্রার্থীদের। প্রভাব খাটিয়ে ওই প্রতিমন্ত্রী এবং সাবেক শিক্ষামন্ত্রী তাঁর কন্যাকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষকতা পদে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। আর এই নিয়োগকে অবৈধ বলে দাবি করে মেধাতালিকায় থাকা আরেক প্রার্থী ববিতা সরকার কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের করেন মামলা।
গতকাল কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এক নির্দেশে ওই শিক্ষিকাকে চাকরি থেকে অবিলম্বে বরখাস্ত করার দির্দেশ দেন। একই সঙ্গে আরও নির্দেশ দেন, ইতিমধ্যে যে ৪১ মাসের বেতন নেওয়া হয়েছে ওই শিক্ষিকার , সেই টাকাও অবিলম্বে দুই কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। আর ওই শিক্ষিকা কখনো নিজেকে শিক্ষিকা হিসেবে পরিচয় দিতে পারবেন না। শুধু তা–ই নয়, ওই শিক্ষিকা আর স্কুলেও ঢুকতে পারবেন না। সিবিআইও ওই শিক্ষিকার বাবা মন্ত্রী পরেশ অধিকারী এবং কন্যা অঙ্কিতার বিরুদ্ধে গতকালই মামলা করেছে।
এর আগে এই দুর্নীতির তদন্ত করার জন্য কলকাতা হাইকোর্ট সিবিআইকে নির্দেশ দেন। সিবিআই তদন্তের স্বার্থে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং বর্তমান শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীকে কলকাতায় তাঁদের দপ্তরে ডাকলেও তাঁরা প্রথমে সাড়া দেননি। বরং সিবিআিইয়ের এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলে কলকাতা হাইকোর্ট সেই মামলার আবেদন খারিজ করে দেন। এরপর এই দুই মন্ত্রী ডিভিশন বেঞ্চে মামলা করলে সেখান থেকেও তাঁরা নিরাশ হয়ে ফিরে আসেন। দুই মন্ত্রীই সিবিআই দপ্তরে হাজির হন। সিবিআইও তাঁদের জেরা করেন। হাইকোর্ট এই দুই মন্ত্রীকে তাঁদের পদ থেকে অপসারণের সুপারিশ করেন।
অভিযোগ ছিল , প্রতিমন্ত্রীর কন্যা অঙ্কিতা অধিকারীকে বেআইনিভাবে নিয়োগ করা হয় কোচবিহারের মেখলিগঞ্জ ইন্দিরা উচ্চবিদ্যালয়ে। অথচ একই সময়ে নিয়োগ পরীক্ষায় অঙ্কিতার চেয়ে ১৬ নম্বর বেশি পাওয়া প্রার্থী ববিতা সরকার বঞ্চিত হন। ববিতার বাড়ি শিলিগুড়িতে।
নিয়োগ নিয়ে অনিয়ম, সিবিআইয়ের তলব, মন্ত্রিত্ব থেকে বাদ দেওয়ার নির্দেশের ঘটনায় কার্যত রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য বড় থাক্কা। তৃণমূল কংগ্রেসে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জায়গা হবে না বলে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বরাবরই বলে আসতেন। এখন রাজ্যের দুই মন্ত্রীর এই কাজ এবং আদালতের রায় তাঁদের চরম অস্বস্তিতে ফেলল।
আজ শনিবার তৃতীয়বারের জন্য সিবিআইয়ের মুখোমুখি হয়েছেন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ। দুই মন্ত্রীকে জেরা করে সিবিআইও স্বীকার করে নিল, ওই মামলায় তদন্তে এটা পরিষ্কার হয়েছে যে শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। লাখ লাখ টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে। এর আগে সারদা, নারদ ও রোজভ্যালির মতো অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ছিল।
সেসব কেলেঙ্কারিতে একাধিক তৃণমূল নেতার নাম জড়িয়েছিল। কিন্তু তাঁরা পার পেয়ে গেছেন। দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে মুকুল রায় নারদ–কাণ্ডে অভিযুক্ত হয়ে বিজেপিতে যোগ দেন। পরে আবার বিধানসভা নির্বাচনের পর তৃণমূলে ফিরে আসেন। সারদা-নারদ সামলে এখনো ক্ষমতায়। বলা যায়, আরও বেশি শক্তি নিয়ে। তবে এবারের ঘটনার জের আরও গড়াবে বলেই রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের ধারণা।