ভারতের আসাম-মিজোরামে দ্বন্দ্ব বাড়ছে
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় দুই রাজ্য আসাম ও মিজোরামের মধ্যে সম্পর্কের দ্রুত অবনতি হচ্ছে। গত সোমবার দুই রাজ্যের সীমান্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর পরস্পরের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কোনো রাজ্যই সীমান্ত এলাকা থেকে নিজেদের বাহিনীকে সরায়নি।
মিজোরামের পক্ষ থেকে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা ও দুই উচ্চপদস্থ আধিকারিকের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টা ও ষড়যন্ত্রের মামলা করা হয়েছে। স্বাধীনতার পরে ভারতের এক রাজ্য অন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার মামলা করেছে কি না, তা বলা মুশকিল।
মিজোরাম অন্তত আরও ২০০ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে তাদের রাজ্যের ভেতরে ঢুকে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টার অভিযোগে মামলা করেছে। মিজোরাম পুলিশের বক্তব্য, গোটা ঘটনায় প্ররোচনা দিয়েছে আসাম পুলিশ। মিজোরাম আরও অভিযোগ করেছে, তাদের মালপত্র, দৈনন্দিন পণ্য, খাবারদাবার যেহেতু আসামের ভেতর দিয়ে আসে, তাতে বাধা দিয়ে রাজ্যটিকে চূড়ান্ত বিপদের মধ্যে ফেলছে আসাম। সব অভিযোগই অবশ্য আসামের প্রশাসন অস্বীকার করেছে।
এ পরিস্থিতিতে গত বুধবার দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বৈঠকে দুই রাজ্যই সীমান্ত থেকে পুলিশ সরিয়ে নিতে রাজি হয়। সেখানে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু তা হয়নি, ফলে উত্তেজনা রয়ে গেছে।
অতীতে দুই রাজ্যের পুলিশের মধ্যে এত বড় সহিংসতার ঘটনা উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারতে একবারই ঘটেছিল। ১৯৮৫ সালে নাগাল্যান্ডের পুলিশের গুলিতে আসাম পুলিশের ৩২ জন মারা যায়।
কেন রক্ত ঝরল
সংঘাতের দিন আসাম পুলিশের ২০০ জনের একটি দল সীমানা পেরিয়ে মিজোরামে ঢুকে একটি সীমান্তচৌকি দখল করে। মিজোরাম মামলার অভিযোগে বলেছে, আসাম পুলিশ মিজোরামের ভাইরাঙ্গেট এলাকা নিজেদের বলে দাবি করে সেখানে নিরাপত্তাশিবির তৈরি করার কথা জানায়। এরপর দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলাকালে আসাম পুলিশ গুলি চালায়। মিজোরাম পুলিশ পাল্টা গুলি চালালে আসাম পুলিশের সদস্যরা মারা যান।
তবে আসামের বক্তব্য, প্রতিবেশী রাজ্যের পুলিশ কোনো কারণ ছাড়াই গুলি চালিয়েছে। এ পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্যে যেটা পরিষ্কার তা হলো ভাইরাঙ্গেট অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখা গেলেও, দুই রাজ্যের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতি হয়েছে।
এরই মধ্যে আইতলাঙ্ঘাম নামের একটি অঞ্চলের দখলও আসাম পুলিশ নিয়েছে, অভিযোগ মিজোরামের। জুন মাসের গোড়া থেকেই উত্তেজনা বাড়তে বাড়তে অবশেষে জুলাইয়ের শেষে এসে কার্যত লড়াই শুরু হয়েছে আসাম ও মিজোরামের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
দক্ষিণ আসামের তিনটি জেলা কাছাড়, হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জ—এর লাগোয়া উত্তর মিজোরামের তিন জেলা কোলাশিব, মামিত ও আইজল। দুই রাজ্যের এই ছয় জেলার মধ্যে সীমান্ত ১৬৫ কিলোমিটারের। এই সীমান্তের বিভিন্ন অংশ নিয়ে বিবাদ রয়েছে, কারণ দুই রাজ্যই দাবি করে অঞ্চলগুলো তাদের। এই বিবাদ দীর্ঘদিনের, ১৯৮৭ সালে মিজোরাম রাজ্য গঠন হওয়ার পর থেকে এই বিবাদ আরও বেড়েছে। মিজোরাম চায়, ১৮৭৫ সালে ইনার লাইন রেগুলেশনের ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান করা হোক। কিন্তু কেন্দ্র সরকার তা ১৯৩৩-এর সীমানা চুক্তি মোতাবেক করতে চাইলে মিজোরাম রাজি হয়নি। এ কারণে এ অঞ্চলগুলোতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আসাম মিজোরামের মধ্যে একটি ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’ সমঝোতা ছিল, যে সমঝোতা গুলি চালানোর ফলে ভেঙে গেল।
এ ছাড়া মিজোরামের অভিযোগ, দীর্ঘ সময় ধরে আসাম তার বৃহৎ বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠীকে (৩৫ শতাংশ) মিজোরামে ঢুকিয়ে সেখানকার জনগোষ্ঠীর বিন্যাস নষ্ট করার চেষ্টা করছে। মিজোরামের মুসলিম জনসংখ্যা ১ দশমিক ৩ শতাংশ। ফলে এ বিবাদ, যা অতীতে শুধু সীমানাকেন্দ্রিক সংঘাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, তা এখন জনগোষ্ঠীর চরিত্রকেন্দ্রিক বিবাদে পরিণত হচ্ছে। রাজ্যের সীমানা নিয়ে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে বিবাদ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারতে রয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এখন সক্রিয়ভাবে দুই পক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে, যাতে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।