মমতার চাপ, বিজেপির সসেমিরা হাল
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লি এসেছেন বলে বিজেপির চাপ বাড়েনি, চাপ বেড়েছে পেগাসাসকাণ্ডের তদন্তে তাঁর কমিশন গঠনের সিদ্ধান্তে।
ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপের তৈরি করা সফটওয়্যার ‘পেগাসাস’ ব্যবহার করে ফোনে আড়ি পাতাকে কেন্দ্র করে ভারতের সংসদ উত্তাল। বর্ষাকালীন অধিবেশন শুরু হওয়া ইস্তক কোনো কক্ষের কাজই সুষ্ঠুভাবে করা যাচ্ছে না। পেগাসাসকাণ্ডকে কেন্দ্র করে প্রায় সব বিরোধী দল এককাট্টা। এ অবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি মদন লোকুর ও কলকাতা হাইকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যকে নিয়ে কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকারের কপালে চিন্তার গভীর ভাঁজ ফেলেছে। মমতা তদন্ত কমিশন গড়েছেন ১৯৫২ সালের তদন্ত আইন মোতাবেক।
মমতার এ সিদ্ধান্ত শুধু যে তাঁর একার, বিজেপি নেতাদের একাংশ তা মনে করছেন না। বিজেপির কেন্দ্রীয় মুখপাত্রদের একজন আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে মমতার সঙ্গে কংগ্রেসের কোনো বোঝাপড়া হয়ে থাকতে পারে। কারণ, কিছুদিন আগে ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেলও পেগাসাসকাণ্ডে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। ওই নেতার কথায়, ‘ইদানীং কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের মাখো মাখো ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। দিল্লি আসার আগেই কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ দেখিয়েছেন মমতা। সোনিয়াও পেগাসাসকাণ্ডে মমতার ভাইপো ও সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিসহ তাঁর ফোন থাকার বিষয় নিয়ে টুইট করছেন। কাজেই একযোগে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।’
সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন শুরুর ঠিক আগের দিন ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’ প্রতিবেদনের আত্মপ্রকাশ। এই ‘টাইমিং’ তুলে ধরে বিজেপি নেতৃত্ব গোটা বিষয়কে ‘ভারতের বিরুদ্ধে চক্রান্ত’ বলে অভিহিত করেছে। দেশের তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রীর বিবৃতিতেও রয়েছে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত। সেখানেও জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম ও দেশের অগ্রগতিকে বিজেপি হাতিয়ার করে বলেছে, যারা ভারতের উন্নয়ন ও বিকাশ সহ্য করতে পারছে না, এটা তাদের চক্রান্ত। কিন্তু সেই তত্ত্বে সবাইকে যে বিশ্বাসী করা গেছে, তেমন নয়। কেননা, প্রতিদিন একটু একটু করে নামের যে তালিকা প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে সন্দেহ কমার চেয়ে বেড়ে যাচ্ছে। বিজেপির মধ্যেই নানা রকম প্রশ্ন উঠছে, যেহেতু নামের তালিকায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, নির্বাচন কমিশনের সদস্য, আমলা, গোয়েন্দা, সেনা, সাংবাদিক, সমাজকর্মীসহ রয়েছে সরকার ও বিরোধী পক্ষের নেতাদের নাম।
সরকার আগে থেকেই বিব্রত কৃষক আন্দোলন নিয়ে। দিল্লি অবরোধের আট মাস পূর্ণ হয়েছে। অথচ উত্তর ভারতের কৃষকদের আন্দোলনে ভাটা পড়েনি। সরকারের ওপর চাপ বাড়িয়েছে কোভিড পরিস্থিতি, জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অগ্নিমূল্য ও বেকারত্ব। এই বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে বিড়ম্বনা বৃদ্ধি করেছে পেগাসাসকাণ্ড। প্রতি দিন ভন্ডুল হয়ে যাচ্ছে লোকসভা ও রাজ্যসভার অধিবেশন। এ অবস্থায় সরকার এখনো নিশ্চিত নয়, কীভাবে বিরোধী ক্ষোভ ও দাবি প্রশমিত হয়। বিজেপির সংসদীয় দলের এক নেতার কথায়, ‘পেগাসাসকাণ্ড আমাদের কাছে শাঁখের করাত হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
শাঁখের করাত, কারণ, নজরদারি অভিযোগ অস্বীকার করা যাচ্ছে না, আবার স্বীকার করলেও হাজারটা প্রশ্ন তুলে বিরোধীরা বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। সংসদে সরকারি বিবৃতিতে পেগাসাসের অস্তিত্ব স্বীকার বা অস্বীকার, কিছুই করা হয়নি। চক্রান্তের অভিযোগের পাশাপাশি শুধু বলা হয়েছে, দেশের আইন খুবই স্পষ্ট। বেআইনিভাবে এ দেশে কারও ফোনে আড়ি পাতা সম্ভব নয়। এই উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে আইনিভাবে নজরদারি চালানোর প্রশ্ন। সরকার সেই স্বীকারোক্তি করলে যেসব অবধারিত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে, তার প্রথমটি হলো ইসরায়েলের এনএসও সংস্থার সঙ্গে কোনো চুক্তি হয়েছিল কি না, হলে কী চুক্তি, কবে করা, কত টাকার এবং কী জন্য।
ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী আগেই জানিয়েছেন, রাজ্যে বিজেপির শাসন চলাকালে মুখ্যমন্ত্রী রামন সিংয়ের আমলে ইসরায়েল সংস্থা এনএসওর এক প্রতিনিধিদল ছত্তিশগড় সফরে এসেছিল। সরকারের জন্য দ্বিতীয় বিড়ম্বনা তৈরি করেছে এনএসও স্বয়ং। তারা দুটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছে। প্রথমত, এই স্পাইওয়্যার বা নজরদারি ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য সন্ত্রাসবাদী কাজ ও বিভিন্ন ধরনের ঘৃণ্য অপরাধ রোখা। তারা এ কথাও বলেছে, পেগাসাসের জন্য দেশে দেশে সাধারণ মানুষ নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমোতে পারছে। দ্বিতীয়ত, এ প্রযুক্তি তারা শুধু দেশের সরকারকেই বিক্রি করে। সরকার কাদের ওপর তা ব্যবহার করছে, তা তাদের জানার কথা নয়।
এখানেই ভারত সরকারের বিপদ। পেগাসাস প্রযুক্তি কেনার কথা তারা যদি স্বীকার করে, তাহলে প্রশ্ন উঠবে, যেসব ফোনমালিকের নাম তালিকায় উঠে আসছে, তাঁরা কি সন্ত্রাসী? দেশদ্রোহী? অপরাধী? বিরোধীদের দাবি, সংসদে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিবৃতি দিতে হবে। দিলে এই প্রশ্নগুলোর জবাবও দিতে হয়। অর্থাৎ, বিড়ম্বনার একশেষ। সরকারের মুখে তাই কুলুপ।
শুধু সরকারই নয়, বিরোধীরা চাপ সৃষ্টি করেছ সুপ্রিম কোর্টের ওপরেও। সেই চাপ বাড়িয়ে তুলেছে তদন্ত কমিশন গঠনে মমতার সিদ্ধান্ত।
এটা ঠিক, মমতার গড়া তদন্ত কমিশনের বৈধতা নিয়ে আইনজ্ঞ মহলে দ্বিমত রয়েছে। কারও কারও অভিমত, সংবিধানে স্পষ্ট বলে দেওয়া আছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের এখতিয়ার কী কী। সেই নিরিখে এ তদন্ত কমিশনের নির্দেশ কেন্দ্রীয় কর্তারা মানবেনই না। কোনো কোনো মহল অবশ্য ভিন্নমত। তাঁরা মনে করেন, মমতার গড়া কমিশনের তদন্তের বৈধতা রয়েছে। এই বিতর্ক সত্ত্বেও বলা যায়, কেন্দ্রীয় সরকার মমতার চালে চিন্তিত। কারণ, বিভিন্ন বিরোধী–শাসিত রাজ্যকে তিনি অনুরোধ করেছেন, তারাও যেন নিজ রাজ্যে অনুরূপ তদন্ত কমিশন গড়ে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক আইনি পরামর্শদাতা মনে করেন, এতে সুপ্রিম কোর্টের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি হবে। ওই আইনজ্ঞের মতে, ‘বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে অনুরোধ জানিয়েছে। জনমত যেভাবে প্রবল হচ্ছে, মিডিয়ায় চর্চা চলছে, সংসদ অচল থাকছে, সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দাখিল হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টকে ব্যবস্থা নিতে আরজি জানানো হচ্ছে, তাতে সুপ্রিম কোর্ট কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সরকারের কিছু করার থাকবে না।’ সুপ্রিম কোর্টে ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে তিনটি আবেদন দাখিল করা হয়েছে। প্রথমটি সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবী এম এল শর্মার, দ্বিতীয়টি কেরলের সিপিএম নেতা ও সাংসদ জন ব্রিটাসের, তৃতীয়টি দাখিল হয়েছে আজ। সুপ্রিম কোর্টকে হস্তক্ষেপের এ মামলা করেছেন দুই বিশিষ্ট সাংবাদিক এন রাম ও শশী কুমার।
সুপ্রিম কোর্ট ইদানীং দুটি বিষয়ে তাঁদের মনোভাব স্পষ্ট করেছেন। প্রথমটি কোভিডসংক্রান্ত মামলা। এ মামলার শুনানির সময় বিচারপতিরা সরকারের টিকানীতি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলেন। সর্বোচ্চ আদালতের মনোভাব বুঝতে পেরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেই জানিয়ে দেন, ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সীদের ৭৫ শতাংশকে টিকা দেওয়ার ব্যয়ভার কেন্দ্র বহন করবে। দ্বিতীয় মামলাটি দেশদ্রোহসংক্রান্ত। এ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ব্রিটিশ সরকারের তৈরি আইন বলবৎ রাখার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলে জানতে চেয়েছেন, স্বাধীনতার এত বছর পরেও কেন এই আইন বাতিল করা হচ্ছে না।
বিজেপির চিন্তা সুপ্রিম কোর্টকে নিয়েই। যেভাবে দাবি উঠছে ও চাপ বাড়ছে, তাতে মমতার তৈরি কমিশনকেই সুপ্রিম কোর্ট যদি মান্যতা দেন, পেগাসাসকাণ্ডের তদন্তে সর্বোচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মদন লোকুর ও কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যকেই দায়িত্ব দেন, কেন্দ্রীয় সরকারকে তাহলে তদন্তের আতশি কাচের নিচে আসতেই হবে। কোনো ওজর–আপত্তি চলবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপির চাপ মারাত্মক বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁকে নিয়েই বিজেপির চিন্তা।