মণিপুরে নতুন করে সহিংসতায় নিহত ৬, অশান্ত একাধিক জেলা
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে নতুন করে সহিংসতা শুরু হয়েছে। এক পরিবারের বাবা-ছেলেসহ অন্তত ছয়জনের এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় পুলিশ। আহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন। গতকাল শনিবারে শুরু হওয়া সহিংসতা আজ রোববারও অব্যাহত রয়েছে। কয়েক সপ্তাহ মোটামুটি শান্ত থাকার পর আবার নতুন করে সহিংসতা বাড়াতে উদ্বিগ্ন প্রশাসন। কেন্দ্র সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি দলের নেতারাই।
গতকাল থেকে যে সহিংসতা শুরু হয়েছে, তার কেন্দ্রস্থল মধ্য দক্ষিণ মণিপুরের দুই জেলা বিষ্ণুপুর ও চুড়াচাঁদপুরের সীমান্ত। এই সীমান্তের বিভিন্ন অঞ্চলে গতকাল থেকে বিক্ষিপ্তভাবে সংঘর্ষ হচ্ছে স্থানীয় মেইতেই এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে। সংঘর্ষ হচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে দুপক্ষেরই। বন্দুকযুদ্ধের পাশাপাশি অত্যাধুনিক মর্টার এবং গ্রেনেড ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানা গেছে। প্রায় তিন মাস ধরে সহিংসতা চলাকালীন একাধিক সরকারি অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করা হয়েছে। আগ্নেয়াস্ত্র লুণ্ঠিত অস্ত্রাগার থেকেই আসছে বলে মনে করা হচ্ছে। তিন মাসের এই সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ১৫০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন।
সামরিক, আধা সামরিক বাহিনী এবং পুলিশ মোতায়েন করেও সহিংসতা রোধে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সাফল্য পাওয়া যায়নি।
বিষ্ণুপুর বাজার–সংলগ্ন কয়াকতা এলাকার একটি গ্রামে গতকাল ভোরের এক হামলায় বাবা-ছেলেসহ তিন নিরস্ত্র গ্রামবাসী নিহত হন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা ত্রাণ শিবিরে বসবাস করছিলেন। তাঁরা গত শুক্রবার তাঁদের গ্রাম পাহারা দিতে ফিরে এসেছিলেন। গত ৩ মে গ্রামে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর গ্রামবাসীরা স্থানীয় অধিবাসীদের একত্র করে শিবির গঠন করে সেখানে থাকতে শুরু করেন। পরে তা ত্রাণ শিবিরে পরিণত হয় বলে ইম্ফলের এক সাংবাদিক প্রথম আলোকে জানান। নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্র উদ্ধৃত করে ভারতের প্রচারমধ্যম জানিয়েছে, বাবা ও ছেলেকে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়। এরপরে কাছ থেকে গুলি করা হয়।
বিষ্ণুপুর জেলায় এ ঘটনার পরপরই কয়াকতা–সংলগ্ন চূড়াচাঁদপুরে পাল্টা আক্রমণ শুরু হয়। পাল্টা আক্রমণে চূড়াচাঁদপুরের ফুজাং ও সোংডো গ্রামে দুজনের মৃত্যু হয়। পাশাপাশি আক্রমণ চলতে থাকে, বিষ্ণুপুর সীমানা–সংলগ্ন গ্রামগুলোতেও। যার জেরে বিষ্ণুপুর জেলার তেরখাংসাংবিতে একজনের মৃত্যু হয়। এই সব সশস্ত্র অভিযানে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, গ্রেনেড ও মর্টার ব্যবহৃত হয়েছে।
আধা সামরিক বাহিনীর এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত ‘রকেট লঞ্চার’ ব্যবহারের কোনো খবর তাঁরা পাননি। তবে মিয়ানমারের স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী গোষ্ঠী মণিপুরের যুদ্ধরত জঙ্গিদের এসব সরবরাহ করছে বলে এখন সন্দেহ করা হচ্ছে। অর্থাৎ মণিপুরের লড়াই ক্রমে বড় আকার ধারণ করছে এবং সহিংসতাকে নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনী যে ব্যর্থ হচ্ছে, তা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন মণিপুরের বিজেপিদলীয় বিধায়ক রাজকুমার ইমো সিং। ইমো সিং মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের জামাতাও।
গতকাল কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীকে আক্রমণ করে ইমো সিং বলেছেন, বিষ্ণুপুর জেলায় যে হামলায় তিনজন নিহত হয়েছেন, সেখানে নিরাপত্তায় বিশাল ত্রুটি ছিল। আধা সামরিক বাহিনীর কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘কর্তব্যে অবহেলার’ জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন বিজেপিশাসিত মণিপুর সরকারের ক্ষমতাসীন দলের বিধায়কেরা। অর্থাৎ কার্যত, বিজেপিশাসিত কেন্দ্রীয় সরকারের বাহিনীর তীব্র সমালোচনা এখন করছেন রাজ্য বিজেপির নেতারাই।
বিষ্ণুপুর ও চূড়াচাঁদপুরের পাশাপাশি লড়াই চলছে ইম্ফল পূর্ব জেলার সানসাবি এবং থামনাপোকপি গ্রামেও। সেখানেও দুষ্কৃতকারীরা গতকাল এবং আজ ভোরে গুলি চালিয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম। তবে এখনো কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। একই সঙ্গে, ইম্ফল পশ্চিম জেলার ল্যাংগোলেও কিছু বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ এবং অজ্ঞাতপরিচয় লোকজন। রাজধানী ইম্ফলেও ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন স্থানীয় মানুষ।
সব মিলিয়ে মধ্য এবং দক্ষিণ মণিপুরে পরিস্থিতি আবার প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে। বন্ধ রাখা হয়েছে ইন্টারনেটও।