ইরানের পরমাণু চুক্তি ঘিরে শঙ্কা

ভিয়েনায় ইরানের পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছেন কূটনীতিকেরা
ছবি : রয়টার্স

অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার রিংসট্রেসের দ্য গ্র্যান্ড হোটেল। পরমাণু কূটনীতির জন্য মনোরম এক স্থান। তবে পারিপার্শ্বিক ঐশ্বর্যে এর গুরুত্ব বোঝা দায়। এই হোটেলই ২২ বছর ধরে বিশ্বে পরমাণু সক্ষমতা অর্জনকারীদের পর্যবেক্ষণে কাজ করা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সদর দপ্তর। গত এপ্রিল মাস থেকে কূটনীতিকেরা এখানে প্রায় ছয় দফা আলোচনায় বসেছেন। সর্বশেষ গত ২০ জুন তাঁরা ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় বসেন। কিন্তু এখনো তাঁদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। কিন্তু সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।

এখানে ইরানের পরমাণু সমঝোতা ও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, যাতে অংশ নিয়েছে যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। পরোক্ষভাবে থাকছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান। কীভাবে জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) নামের বহুজাতিক পারমাণবিক চুক্তি পুনরুদ্ধার করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করছেন কূটনীতিকেরা। চুক্তিটি ২০১৫ সালে স্বাক্ষর করা হয়েছিল। কিন্তু তিন বছর পরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যান। ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।

মার্কিন এ নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় ইরান চুক্তি লঙ্ঘন করে পরমাণু কর্মসূচি সক্রিয় করে। তারা উন্নত সেন্ট্রিফিউজ পরীক্ষার পাশাপাশি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে কাজ শুরু করে।

মে মাসে আইএইএ পূর্বাভাস দেয়, ইরানের ৫ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত ৩ হাজার কেজি ছাড়িয়ে গেছে। তারা এর বেশি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করলে তা কয়েকটি পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য যথেষ্ট। দেশটির ৭০ কেজি ইউরেনিয়াম ইতিমধ্যে ২০ শতাংশ সমৃদ্ধ, যা অধিকাংশই অস্ত্রের গ্রেডে যাওয়ার পথে।

গত বছর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান উভয় দেশই বলে আসছে, অন্যরা রাজি থাকলে তারাও মূল চুক্তির শর্তগুলোয় ফিরে আসতে রাজি।

ভিয়েনায় সর্বশেষ দফার আলোচনা শেষে ইরানের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, চুক্তির সব নথিপত্র প্রস্তুত হয়ে গেছে।

সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ধাতব তৈরির পথে ইরান

ইরান সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ধাতব উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের আণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) গত মঙ্গলবার বলেছে, তারা যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে সাহায্য করতে পারে। এ বিষয়টি ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত বহুজাতিক পারমাণবিক চুক্তিটি পুনরুদ্ধারে হুমকি সৃষ্টি করবে বলে দাবি করেছে ইউরোপের তিনটি দেশ।
ইরান তাদের এ পদক্ষেপ প্রসঙ্গে বলেছে, গবেষণা রিঅ্যাক্টর তৈরির জন্য জ্বালানি হিসেবে তারা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে।

গত কয়েক বছর ধরে ইরানের ওপর চাপ বাড়িয়ে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র।
ছবি: এএফপি

ইরানের এই পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা বলছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে পেছনে হটার পদক্ষেপ।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের তিন দেশ বলছে, ইরানের পদক্ষেপ চুক্তি পুনর্বহালের পথ আরও জটিল করবে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির পক্ষ থেকে বলা হয়, ইরানের সিদ্ধান্ত চুক্তি নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।

ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট বলছে, ৩০ জুন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের কূটনীতিকেরা এ চুক্তি ঘিরে ‘নতুন স্তরের আশাবাদ’ শোনান। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ১৪ জুলাই জেসিপিওএ চুক্তির ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতেই নতুন চুক্তি সই হতে পারে। তবে, চুক্তিটি প্রথমবার যে পরিস্থিতিতে সই হয়েছিল, তার তুলনায় এখন পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে বলে মূল চুক্তির শর্তগুলো ধরে রাখা কঠিন হতে পারে।

ইরানের ঘরোয়া রাজনীতি

ইরান বর্তমানে রাজনৈতিক পালাবদলের মাঝপথে রয়েছে। দেশটির মধ্যপন্থী নেতা হাসান রুহানির জায়গায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন কট্টরপন্থী ইব্রাহিম রাইসি। গত মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হন রাইসি। আগামী ৩ আগস্ট দায়িত্ব গ্রহণ করবেন তিনি। বর্তমান প্রশাসনের তুলনায় রাইসি ও তাঁর প্রশাসনের লোকজন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের প্রতি ততটা বন্ধুভাবাপন্ন নন। তবে তার মানে এই নয় যে চুক্তিটি অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। হাসান রুহানির পূর্বসূরি আরেক কট্টরপন্থী মাহমুদ আহমেদিনেজাদ এই চুক্তির সূচনা করেছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পদে রাইসি নির্বাচিত হওয়ার ঘটনাটি এখন চুক্তির বিষয়টিকে বেশি জটিল করে তুলেছে।

নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লা আলী খামেনি
ফাইল ছবি

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাংক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের গবেষক আনিশে বাসিরি তাবরিজি বলেন, রুহানির সরকারের শেষ সময়ে ভ্রান্ত কূটনীতির পেছনে উৎসর্গ করার জন্য প্রণোদনা সামান্যই। রাজনৈতিক ফায়দা তো দূরের কথা, আগামী তিন বছরে ইরানের পার্লামেন্টে (মজলিশ) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না। এমনকি তাদের সরকারের করা কোনো চুক্তি নতুন সরকার পুরোপুরি বাস্তবায়ন করবে, এমন কোনো নিশ্চয়তাও নেই।

ইরানের ঘরোয়া রাজনীতিই অবশ্য চুক্তির পথে একমাত্র বাধা নয়। মার্কিন এক কর্মকর্তা সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছেন, ‘আমাদের এখনো গুরুতর কিছু পার্থক্য আছে, যার সেতুবন্ধন হয়নি। ইরানের পরমাণু কর্মসূচির পদক্ষেপ থেকে সরে আসা, যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি কিংবা উভয় পক্ষই ক্রমান্বয়ে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, তার কোনো সুরাহা হয়নি।’

বাধা আছে আরও

উভয় পক্ষের ক্রমান্বয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি আগের মতো আর বাধা বলে বিবেচিত হচ্ছে না। আগে কে পদক্ষেপ নেবে, এ নিয়ে দুই পক্ষের ঠেলাঠেলি চলছিল। কিন্তু তারা এখন চুক্তিতে ফিরতে একযোগে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণে সম্মত হয়েছে। কিন্তু অন্য চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

ইরান চাইছে, ট্রাম্প সরকার তাদের বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, তা পুরোপুরি তুলে নেওয়া হোক। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বলছে, চুক্তিতে যেসব শর্ত আছে, সে অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে। এর আগে মার্চ মাসে বাইডেন প্রশাসন ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড করপোরেশনের (আইআরজিসি) দুই সদস্যের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে নতুন নিষেধাজ্ঞা দেয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইউরেশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষক হেনরি রোম বলেন, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা অর্থনৈতিকভাবে অসংলগ্ন তবে রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল। এর মধ্যে রয়েছে আইআরজিসিকে সন্ত্রাসী দলের তকমা দেওয়া, দেশটির সর্বোচ্চ নেতা, ইরানের সামরিক কমান্ড ও দেশটির প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির মতো বিষয়গুলো।

৩০ জুন জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত মাজিদ তাখত রাভাঞ্চি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আবার এই চুক্তি থেকে সরে যাবে না, তার দেশ এ নিশ্চয়তা চায়। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, এ ধরনের নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, জেসিপিওএ চুক্তি কোনো বাঁধাই চুক্তি নয়। তা করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের দুই–তৃতীয়াংশ সিনেটরের সমর্থন লাগবে। কিন্তু মার্কিন পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটের অর্ধেকই রিপাবলিক দলের সমর্থক। তারা শুরু থেকেই এ চুক্তির তীব্র বিরোধিতা করে করছে।

মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ধরনের নিশ্চয়তা হয় না। ইরান সেটা জানে এবং আমরাও তা জানি।’

দর-কষাকষি চলছে

সমস্যা আছে আরও। পশ্চিমা দেশগুলোর নিজস্ব অভিযোগ আছে ইরানকে ঘিরে। তাদের যুক্তি হলো, ইরান চুক্তির লঙ্ঘনকে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে চিত্রিত করেছে। এ ছাড়া তারা উন্নত সেন্ট্রিফিউজ চালানো এবং ইউরেনিয়াম ধাতব তৈরির মূল্যবান এবং স্থায়ী জ্ঞান অর্জন করে ফেলেছে। বাড়িয়ে চলেছে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ। মূল জেসিপিওএ চুক্তিতে এ ধরনের কার্যক্রমের বিষয়টি স্থগিত করে ইরানকে পরমাণু কার্যক্রম প্রক্রিয়ায় পিছিয়ে দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র এখন চাইছে ইরানকে আরও আলোচনা চালিয়ে যেতে সম্মত হতে হবে। অর্থাৎ ইরানকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ওই অঞ্চলে মিলিশিয়াকে সমর্থনের বিষয়টি নিয়েও আলোচনায় রাজি হতে হবে। তবে রাইসি আগেই জানিয়ে রেখেছেন, তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ও মিলিশিয়াদের সমর্থনের বিষয়টি দর-কষাকষির বাইরে।

এ অচলাবস্থা বিশেষত বিপজ্জনক। কারণ, ইরান কেবল তার পারমাণবিক কার্যক্রম অবিচ্ছিন্নভাবে এগিয়ে নিতেই বদ্ধপরিকর নয়, এ ক্ষেত্রে যত কম সময় লাগে, সেটাই চাইছে তারা। এ ছাড়া পুরো প্রক্রিয়াটি অস্বচ্ছ করে রাখার হুমকিও দিয়ে রেখেছে। ফেব্রুয়ারিতে ইরানের পক্ষ থেকে জেসিপিওএ চুক্তির কয়েকটি কঠোর পরিদর্শন বিধানকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। এর মধ্যে ছিল পারমাণবিক স্থাপনাগুলোয় ক্যামেরা স্থাপন বন্ধ করার বিষয়টিও। তবে তারা আইএইএকে স্থাপনা পরিদর্শনের ক্ষেত্রে সাময়িক কারিগরি বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে সম্মতি দিয়েছিল।

ওই পদক্ষেপের বিষয়গুলো দুইবার পুনর্বহাল করার পরও ২৪ জুন মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। ইরানের সরকার বলছে, ওই সুবিধা তারা বাড়াবে কি না, তা এখনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া তারা ক্যামেরায় ধারণ করা তথ্য মুছে ফেলারও ইঙ্গিত দিয়েছে। ইরান এ পদক্ষেপ নিলে যুক্তরাষ্ট্রের দুশ্চিন্তা বাড়বে। তবে এ ক্ষেত্রে ইরান আরও বেশি আস্থা হারাবে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স ১ জুলাই এক প্রতিবেদনে জানায়, ইরান তাদের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনা নাতাঞ্জে সংযুক্ত হওয়ার সুবিধা সীমিত করে দিয়েছে। এর পেছনে অবশ্য এপ্রিল মাসে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে সেখানে সন্দেহজনক হামলার বিষয়টি বেশি প্রভাব ফেলেছে।

ইকোনমিস্ট অবলম্বনে মো. মিন্টু হোসেন