চলতি বছরের পবিত্র রমজান মাসেও ইসরায়েল–অধিকৃত ফিলিস্তিনের মাটিতে বড় ধরনের উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর পরিপ্রক্ষিতে গাজা উপত্যকার বাসিন্দারা গত বছরের রমজানের মতোই আরেকটি যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন।
জেরুজালেমভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাজেন জাবারি আল-জাজিরাকে বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে তা বড় ধরনের বিস্ফোরণের জন্য উপযুক্ত।
গত বছর জেরুজালেমে বসবাসকারী ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করাকে কেন্দ্র করে জনক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। ফিলিস্তিনিদের ওই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনজুড়ে।
এ বছরের মতো ঠিক গতবারও আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর প্রবেশ ও অভিযান আগে থেকেই চলে আসা দুই পক্ষের উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। ওই অভিযানের চার দিন পর গাজায় টানা ১১ দিন স্থল ও বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। হামলায় কয়েক শ মানুষ হতাহত হন। নিহত ব্যক্তিদের একটা বড় অংশ ছিল শিশু। হামলায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল গাজার বাড়িঘরসহ বহু স্থাপনা। বাদ পড়েনি হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ ঘটনা নিয়ে ইসরায়েল বলেছিল, হামাসের রকেট ছোড়ার প্রতিক্রিয়ায় তারা গাজায় অভিযান চালিয়েছে মাত্র।
‘হতে যাচ্ছে আবারও লড়াই’
গত রমজানের সংঘর্ষের পর সংঘটিত বেশ কিছু ঘটনা এবার ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনের আরেকটি লড়াইয়ের আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। মাজেন জাবারি বলেন, এবারের সংঘর্ষ শুধু যে জেরুজালেমের দিক থেকে শুরু হতে পারে তা নয়, বিভিন্ন দিক থেকেই শুরু হতে পারে। যেমন জেনিনে (পশ্চিম তীরের শহর) বিস্তর সংঘর্ষ হতে পারে। কারণ ইসরায়েল ওই শহরে প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। সেখানকার সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযানে নামার কথা বলতে পারে তারা।
গত ২২ মার্চ থেকে ইসরায়েলের ভেতরে ক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিদের হামলা বা ‘সশস্ত্র অপারেশন’ বেড়ে গেছে। এসব ঘটনায় ১৪ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন ইসরায়েলি তিন পুলিশ কর্মকর্তা।
অন্যদিকে গত জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ৩৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এমনটাই জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার জেনিনে দুজন নিহত হন। সে সময় ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের তেল আবিব ও বেনি বারেক শহরের কাছে হামলা চালান। আগের দিন বুধবার পশ্চিম তীরে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোর ও এক আইনজীবীকে হত্যা করে ইসরায়েলি বাহিনী।
জেনিনের শরণার্থীশিবিরে বড় ধরনের ইসরায়েলি আক্রমণের আশঙ্কা বাড়ছে। কারণ, সেখানে প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে) ও ফাতাহ আন্দোলনের সশস্ত্র শাখার সদস্যরা সক্রিয়।
সংঘর্ষ শুরুর আভাস আসছে পিআইজের দিক থেকেও। ১০ এপ্রিল এই গ্রুপের এক মুখপাত্র হুঁশিয়ারি দেন, যদি ইসরায়েলি বাহিনী জেনিনের শরণার্থীশিবিরে আক্রমণ অব্যাহত রাখে, তবে খুব শিগগির তাদের দিক থেকেও চূড়ান্ত জবাব আসবে।
গাজার শাসনক্ষমতায় থাকা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের মুখপাত্র হাজেম কাসেম বলেন, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে আবার লড়াইয়ের আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, যদি ইসরায়েলি অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা আল-আকসা মসজিদ নিয়ে তাঁদের অসহিষ্ণু আচরণ দেখিয়ে যেতে থাকেন, তবে হামাস বসে থাকবে না।
জেনিনে সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর প্রতিও হামাসের সমর্থনের কথা জানান কাসেম। বলেন, ‘জেনিনে প্রতিরোধ করা আমাদের দায়িত্বের অংশ। আমরা আমাদের লোকদের ক্ষতি হতে দেব না।’
ইতিমধ্যে পশ্চিম তীরে ও আল-আকসা মসজিদের ভেতরে ইসরায়েলি বাহিনী যাতে ঢুকতে না পারে, সে ব্যাপারে বৃহস্পতিবার ফিলিস্তিনিদের ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছে হামাস।
আশঙ্কার মধ্যেই আল-আকসায় হামলা
শুক্রবার (১৫ এপ্রিল) পূর্ব জেরুজালেমে আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে ইসরায়েলি পুলিশ ও ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় পুলিশের হামলায় ১৫২ ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন। এ ছাড়া কয়েক শ ফিলিস্তিনিকে আটক করেছে পুলিশ। এর আগে বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও আল-আকসা প্রাঙ্গণে ঢোকেন ইসরায়েলি উগ্রবাদীরা।
মূলত নতুন করে উত্তেজনার সূত্রপাত ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের এক ঘোষণার মধ্য দিয়ে। ওই ঘোষণায় বসতি স্থাপনকারীরা ১৫ এপ্রিল আল-আকসা প্রাঙ্গণে তাঁদের বার্ষিক বড় উৎসব ‘প্যাসওভার’ উদ্যাপনের কথা বলেন। এ ঘোষণাকে অনেক ফিলিস্তিনি পবিত্র এ স্থানটির সংবেদনশীল পরিবেশ উসকে দেওয়ার চেষ্টা হিসেবে দেখেন।
জেরুজালেমভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক নাসের আল-হিদমি বলেন, আল-আকসা প্রাঙ্গণে ইহুদিদের এমন উৎসব উদ্যাপন সেই প্রাচীন আমল থেকে এখন পর্যন্ত হয়নি। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেতের দপ্তর জানিয়েছিল, আল-আকসা প্রাঙ্গণে এ উৎসব উদ্যাপন করা হবে না।
মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস সারা বিশ্বের মুসলিমদের কাছে তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। আর ইহুদিদের কাছে এটি খ্যাত টেম্পল মাউন্ট নামে। তাঁরাও এটিকে তাদের অন্যতম পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচনা করেন।
শুক্রবারের সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে ইসরায়েলি পুলিশের দাবি, আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে পাথর ছুড়ছিলেন একদল বিক্ষোভকারী। তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতেই সেখানে ঢোকে তারা। আটক করা হয় ৩০০ জনকে। তবে ফিলিস্তিনি সূত্র বলছে, ৪০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনিকে আটক করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের ওপর রাবার বুলেট ছুড়েছেন। বিক্ষোভকারীরাও ইসরায়েলি বাহিনীকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়েন।
আহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগকেই হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে জানিয়ে ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট বলেছে, আল-আকসার একজন নিরাপত্তাপ্রহরীর চোখে গুলি করা হয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনী মসজিদ প্রাঙ্গণে অ্যাম্বুলেন্স ও চিকিৎসাকর্মীদের ঢুকতেও বাধা দিয়েছে। এতে আহত ব্যক্তিদের উদ্ধারে সমস্যা হয়।
ইসরায়েলি পুলিশের ভাষ্য, শুক্রবার ফজরের নামাজ শেষে ফিলিস্তিনিদের ‘সহিংস’ ভিড় ঠেকাতে তারা মসজিদ প্রাঙ্গণে ঢুকে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
তবে প্রত্যক্ষদর্শী এক ফিলিস্তিনি আলোকচিত্রী বলেন, ইসরায়েলি বাহিনী নির্মমভাবে অভিযান চালিয়ে মসজিদ প্রাঙ্গণ খালি করে দেয়। মসজিদের কর্মী, সাধারণ মানুষ, যুবক, এমনকি প্রবীণদের ওপর হামলা চালায় তারা। ছোড়ে রাবার বুলেট। করে মারধর। এতে অনেকে আহত হন। এমনকি চিকিৎসকদেরও ছাড়েনি পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে আল-জাজিরার প্রতিবেদকও জানান, পুলিশ বিনা অজুহাতে মসজিদ প্রাঙ্গণে হামলা চালিয়েছে।
সংক্ষেপিত অনুবাদ মো. ছানাউল্লাহ