জনতুষ্টিবাদের তিন কৌশল ও ইমরান খান

ইমরান খান
ছবি : এএফপি

ইমরান খান জনতুষ্টিবাদীদের একজন হওয়ার মতো পরিচয় তুলে ধরতে পেরেছেন পাকিস্তানে। সচরাচর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতুষ্টিবাদের রাজনীতিতে যেমনটা হয়, তিনি সেটাই করছেন। ইমরান খানকে নিয়ে দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল একটি মতামত ছাপিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোশাররফ জায়দির সেই লেখা পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।

পাকিস্তানের সংবিধান ১৯৪৭ সালের পর দুই স্বৈরশাসক জিয়াউল হক ও পারভেজ মোশাররফের সরাসরি পদদলনের শিকার হয়েছে। ৩ এপ্রিল অনুচ্ছেদ ৫ ব্যবহার করে পার্লামেন্টে যে ঘটনা ইমরান খান ঘটিয়েছেন, এখন তিনিও ‘কনস্টিটিউশনাল হল অব শেম’-এ তাঁদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে পারেন। নামে তিনি স্বৈরশাসক নন, কখনো পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্বও দেবেন না, তবে তিনি ডিজিটাল যুগের আরও কয়েকজন জনতুষ্টিবাদীর একজন হওয়ার মতো পরিচয় তুলে ধরতে পেরেছেন।

এটা পরিহাসের বিষয়, কারণ শরিফ ও ভুট্টো-জারদারির গণতন্ত্রের ধরন নিয়ে পাকিস্তানি রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা পক্ষপাত করেছেন; বাস্তব অর্থে ‘ডন লিকস’ ব্যর্থতার সময় থেকে। যদি কোনো স্বৈরশাসক হন, তবে তিনি সেই একই সংগঠনেরই হবেন, একসময় যার নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল জিয়া ও জেনারেল মোশাররফ—এমনটাই বলা হচ্ছে। ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডিতে আংশিক হিসাব-নিকাশ শেষের পর যা দাঁড়ায়, সেটা হলো যেসব গণতন্ত্রপন্থী সব সময় নির্বাচিত বেসামরিক নেতার জন্য উচ্ছ্বাসিত হয়ে থাকেন, তাঁরা সেই একই টিমের জন্যও এখন উচ্ছ্বাস প্রকাশ শুরু করতে পারেন; নাকি শুরু করে দিয়েছেন?

‘নোটিফিকেশন গেট’ নিয়ে মতপার্থক্য যেভাবে বেসামরিক-সামরিক ভারসাম্যকে গুলিয়ে ফেলেছে, পাকিস্তানের গণতন্ত্রপন্থীরা নিশ্চিতভাবে ইমরান খানের পক্ষেই জড়ো হবেন? প্রথাগতভাবে, আংশিক পর্যালোচনার পর মতটি যাঁর দিকে কিছুটা যায়, গণতন্ত্রের পক্ষের সমর্থন তিনিই পান। আর সব সময় এটা হলো বেসামরিক নির্বাচিত নেতা। সর্বোপরি সামরিক বাহিনী দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী একক সংগঠন হিসেবে আছে ও থাকবে, দেশের সব প্রতিষ্ঠানের ভরকেন্দ্র হিসেবে (এমনকি এই অঞ্চলেরও)। কিন্তু গণতন্ত্রপন্থী সেই ঐক্য গড়ে ওঠেনি।

এক পক্ষে সবাই ছিলেন; মনে করা হয় সেনাবাহিনীও। অন্যদিকে ছিলেন ইমরান খান এবং তাঁর প্রতি যাঁরা আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। এই আনুগত্যের চালিকা শক্তি হলো তিনি, যাঁর প্রতি অঙ্গীকারটি করা হয়েছিল। এটা দেশের প্রতি, দলের প্রতি, সেনাবাহিনীর প্রতি ছিল না। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে ৩ এপ্রিল সংসদীয় যথাযথ প্রক্রিয়া পদদলিত করার পর এমনকি সংবিধানের প্রতিও এ আনুগত্য ছিল না। আপাতদৃষ্টিতে পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থায় বাকি থাকা একমাত্র পবিত্র জিনিসের প্রতি সেই আনুগত্য ছিল—ইমরান খান, ডিজিটাল যুগের আরেক জনতুষ্টিবাদী।

চলমান ঘটনাপ্রবাহে ইমরান খানের যত ধরনের অনুকূল অবস্থা আছে, তাতে আরও গভীর চিন্তার উদ্রেক হওয়া উচিত। দেশের প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতা নিয়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। দুঃখজনকভাবে যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বর্তমান সংকট লালন করেছেন এবং সৃষ্টি করেছেন, এমন অবস্থায় তাঁদের বিষয়ে গভীর চিন্তা ও প্রকাশ্য বিচার-বিশ্লেষণ করা কঠিনই রয়ে যাবে।

এটা হয়তো ইমরান খানের জন্য মানানসই হতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানে জনমত প্রভাবিত করতে সিকিউরিটি ইস্ট্যাবলিশমেন্টের (সামরিক বাহিনী) কুৎসিত ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণেরও ইতিহাস রয়েছে। মূলত পাকিস্তানিদের মনে শত্রুদের পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধের ব্যাপক ভীতি ছড়িয়ে সেটা করা হয়েছে। বোধশক্তি হারিয়ে আমরা এখন এর মাশুল দিচ্ছি। আমরা বোঝার চেষ্টা করছি, এসব ঘটনা কীভাবে ঘটেছে এবং দেশের ভাগ্যে কী আছে।

সচরাচর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতুষ্টিবাদের রাজনীতিতে যেমনটা হয়, ইমরান খান সেটাই করছেন। এ রাজনীতির কৌশল আদতে একই। এই কৌশলের তিনটি অংশ রয়েছে—

বড় মিথ্যা

প্রথম অংশটা হলো ‘বড় মিথ্যা’; সমর্থনকে মজবুত করার জন্য যা প্রয়োজন বলতে থাকেন অনেকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ধন্যবাদ যে গল্প তৈরি ও ছড়িয়ে দেওয়ার খরচ ব্যাপক হারে কমেছে। যে কাজ করতে হিলারি ক্লিনটনের বহু পিএইচডি আর লাখো ডলার লেগেছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প আধা ঘণ্টারও কম সময়ে টেলিভিশনে হাজির হয়ে সেটা করেছেন। যখন ট্রাম্প টুইটারে লিখতেন, সেখানে দরকার হতো ২২০ শব্দেরও কম।

নিয়ম মেনে প্রথম অংশে আপনাকে যেটা বলতে হবে, সেটা হলো ‘দুর্নীতি’ অথবা ‘দেশপ্রেম’ কিংবা আমাদের ‘সংস্কৃতি’। প্রথম অংশই সেরা। কারণ এটা কেবল কম খরচের নয়, কম ঝুঁকিরও। অবাস্তব তথ্য প্রদান কিংবা মিথ্যা বলার জন্য কোনো জরিমানা নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রয়েছে পুরস্কার। যত বড় মিথ্যা, তা তত বেশি নিন্দনীয়ভাবে চোখে দেখা দেয়, কানে বাজে। আপনি যদি যথেষ্ট বড় মিথ্যা বলতে পারেন, আপনার বিরোধীরা এর জবাব দিতেই ব্যস্ত থাকবে। ইতিমধ্যে আপনি যখন পরবর্তী মিথ্যা নিয়ে প্রস্তুত, কিন্তু বিরোধীরা আগের মিথ্যা সামলাতেই ব্যস্ত। এটা করতে গিয়ে তারা সত্যের গুণগান গাইবে। আর আপনার শ্রোতারা? আপনি যে মিথ্যা কথা বলছেন, তা লুফে নেবে। অধীর আগ্রহে, কষ্ট সয়েও তারা পরবর্তীটার জন্য অপেক্ষায় থাকবে।

বাকি সবাইকে দোষারোপ করা

দ্বিতীয় অংশ হলো ‘বাকি সবাইকে দোষারোপ করা’। যা–ই ঘটুক না কেন, এর জন্য অন্য কাউকে দোষারোপ করুন। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতুষ্টিবাদ কৌশলে এটি অপরিহার্য এবং কম গুরুত্ব দেওয়া অংশ বটে।

প্রকৃত সংস্কার বা নীতি উদ্ভাবনের কারণেই এ ধরনের অনেক নেতা তাঁদের সমর্থকদের কাছে প্রিয়। কিন্তু খুব কমই, যদি থেকে থাকে, জানে আসলে কীভাবে সংস্কার করতে হয় বা নীতি কীভাবে কাজ করে। জনতুষ্টিবাদীদের কাজের একটি অংশ হলো আগে থেকেই বলা যায় এবং নিশ্চিতও যে এ ধরনের সংস্কার বা নীতি ব্যর্থ হবে। তখন এর দায় অবশ্যই বাইরের কারও ওপর চাপিয়ে দিতে হবে।

সাধারণত বিদেশি, সংখ্যালঘু ও প্রতিদ্বন্দ্বী কিংবা বিরোধীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যেতে পারে। অথবা দুই পক্ষের ওপরই চাপিয়ে দেওয়া যেতে পারে। কারণ, যেকোনো কিছু এবং সবকিছুরই দায় অন্যদের ওপর অথবা বিরোধীদের ওপর চাপানো যেতে পারে। শাসন পরিচালনার ব্যর্থতা মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকার ক্ষেত্রে জনতুষ্টিবাদীদের লাভ নেই বললেই চলে। এটিই শাসন পরিচালনার ব্যর্থতার চক্রকে স্থায়িত্ব দেয়।

অনুগত সমর্থক গোষ্ঠী

তৃতীয় অংশটি হলো ‘অনুগত সমর্থক গোষ্ঠী’। কৌশল বাস্তবায়নে এটা হলো সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ। একজন জনতুষ্টিবাদী নেতার সফলতার জন্য অনুগত সমর্থক গোষ্ঠী লালনপালন, সৃষ্টি ও উজ্জীবিত করা এবং কাজে লাগানো হলো এই রাজনীতির অপরিহার্য উপাদান। এর জন্য প্রয়োজন নানা পদক্ষেপ নিয়ে সব সময় মূল সমর্থক গোষ্ঠীকে ক্ষুব্ধ এবং আশাবাদী রাখা।

সমর্থকেরা হলো সপ্তাহের ৭ দিনে ২৪ ঘণ্টাই চলতে থাকা মেশিনের মতো। এ মেশিন কখনো বন্ধ হবে না। নেতার মাথায় সমর্থক ও বিরোধী—দুই পক্ষের বিষয়ই থাকা প্রয়োজন। তিনি উদ্দীপনা দিয়ে তাঁদের আশাবাদী করে রাখার মাধ্যমে কাজটি করে থাকেন। একই সঙ্গে তাঁরা ভুল করতে পারেন—অব্যাহতভাবে এমন ধারণা তাঁদের মধ্যে জারি রাখবেন।

একজন জনতুষ্টিবাদী নেতা মানুষকে ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত রাখার মাধ্যমেই বিপর্যয়কর ক্ষতি থেকে অনুগত সমর্থকদের চোখ সরিয়ে রাখার কাজটি করে থাকেন। কারণ পরিস্থিত সামাল দেওয়ার মতো তেমন ধীশক্তি এসব নেতার নেই, যেমনটা আমরা ইতিহাসের বইতে পড়েছি। তাঁদের মধ্যে ইতিহাসের জানাশোনাও অনুপস্থিত। অবশ্য তাঁদের জন্য এসব কোনো বিষয় নয়।

সমর্থকদের কাছ থেকে এসব নেতার যে চাওয়া, সেটা হলো তাঁরা জানেন কীভাবে প্রশংসা আদায় করে নিতে হয়। সংস্কার ও পরিবর্তনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেসব বাস্তবায়ন আর বেশি দূরে নয়—এমন ধারণার মধ্যেই সমর্থকদের মগ্ন রাখা তাঁদের কাজ। এসবের মধ্যে বাধা কেবল অন্যরা এবং বিরোধীরা। এ বাধা দেওয়ার একমাত্র কারণ তাঁরা দুর্নীতিবাজ, রাষ্ট্রদ্রোহী এবং আমাদের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিবিরোধী।

শাসনের এ চক্রের মাধ্যমে অব্যাহতভাবে তাণ্ডব চালানো থেকে জনতুষ্টিবাদী নেতাদের কোন জিনিসটি থামাতে পারে? প্রকৃত অর্থে মাত্র একটি বিষয়—যথেষ্ট বড়সড় একটি জোট প্রতিষ্ঠা করা, যারা এ জনতুষ্টিবাদীর বিরুদ্ধে আগ্রাসী প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। এটা করতে হলে প্রথাগত ‘এলিট কম্পোর্ট জোন’ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতুষ্টিবাদী নেতাদের সমর্থকদের সমানে সমান মোকাবিলা করতে হবে।

ফিলিপাইন, হাঙ্গেরি, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, ভারত, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রসহ অধিকাংশ প্রথাগত এলিটরা ব্যর্থ হয়েছে। অনাস্থা ভোট খারিজে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫ প্রয়োগে বিরোধীদের হতভম্ব হওয়া দেখে মনে হয় তারাও ব্যর্থ হতে যাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট কী বলছেন, সেটা কোনো বিষয় নয়; দেখুন, ইমরান খান বড় মিথ্যা বলেই যাচ্ছেন, সবাইকে দোষারোপ করে যাচ্ছেন এবং নিজের ক্ষমতা সুসংহত করতে তাঁর অনুগত সমর্থকদের কাজে লাগাচ্ছেন। তাঁর বাজি? সামরিক বাহিনীর বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত যথেষ্টসংখ্যক অনুগত সমর্থক। তাঁদের উদ্দীপ্ত করে চাপ সৃষ্টিতে প্রচুর হইচই করা হবে।