ব্রাজিল মানবজাতির জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে

নোসা সেনহোরা দা কনসেইকাও হাসপাতাল। করোনা রোগী সামাল দিতে গিয়ে দেশটির স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এখন ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তেছবি: রয়টার্স।

ব্রাজিলে করোনাভাইরাসের (কোভিড–১৯) করোনার নতুন ধরন (স্ট্রেইন) জেঁকে বসেছে। দেশটিতে করোনায় মৃত্যু ও শনাক্ত যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। গত বুধবার এক দিনে দুই হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ব্রাজিলে ছড়িয়ে পড়া করোনার নতুন ধরন ওই অঞ্চলসহ আশপাশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ব্রাজিল মানবজাতির জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এই ধরনটির উৎপত্তি আমাজন সিটি মানাউসে বলে মনে করা হচ্ছে।

বুধবার দেশটিতে ২ হাজার ২৮৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশটিতে মোট ২ লাখ ৬৮ হাজার ৩৭০ জনের মৃত্যু হয়। বিশ্বে মৃত্যুর দিক দিয়ে শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের পরই ব্রাজিলের অবস্থান।

নোসা সেনহোরা দা কনসেইকাও হাসপাতালে জরুরি বিভাগে রোগীদের ভিড়। পোর্তো এলেগরি, ব্রাজিল, ১১ মার্চ
ছবি: রয়টার্স

দেশটির জীববিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফিউক্রুজের চিকিৎসক ও গবেষক মার্গারেথ ডালকলমো বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, দেশটি এখন মহামারির সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে। ২০২১ সাল খুব কঠিন হবে। ফিউক্রুজের তথ্যমতে, দেশটির ২৭টি রাজ্যের ২৫টিতে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের ৮০ শতাংশের বেশি আসনে এখন রোগী।

গতকাল বৃহস্পতিবার করোনাভাইরাসকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ‘মহামারি’ হিসেবে ঘোষণার বর্ষপূর্তি ছিল। বিশ্বজুড়ে ১১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। আর মৃত্যু হয়েছে ২৬ লাখের বেশি মানুষের।

ব্রাজিলের পরিস্থিতি কী

করোনায় নিহত ব্যক্তিদের দাফনের সময় সুরক্ষা পোশাক পরে নেন কর্মীরা। সাও পাওলো, ব্রাজিল, ৯ মার্চ
ছবি: রয়টার্স

গত বুধবার দেশটিতে নতুন করে ৭৯ হাজার ৮৭৬ জন শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো এক দিনে সর্বোচ্চ আক্রান্তের ঘটনা ঘটল।

ফিউক্রুজের তথ্যমতে, রিও ডি জেনিরো, সাও পাওলোসহ ১৫টি রাজ্যের রাজধানীগুলোতে আইসিউই সুবিধার ৯০ শতাংশের বেশি আসনে এখন রোগী। আর ব্রাসিলিয়ার রাজধানীতে আইসিইউতে কোনো শয্যা খালি নেই। পাশাপাশি পোর্তো এলেগরে ও ক্যাম্পো গ্রেনেডে আইসিইউর শয্যার চেয়ে রোগী ছাড়িয়ে গেছে।

প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে বলা হয়, অতিরিক্ত রোগীর চাপে দেশটিতে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ব্রাজিলের মহামারি বিশেষজ্ঞ পেদ্রো হালাল বিসিসির আউটসাইড সোর্স টিভি অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমরা যদি জনগণের জন্য টিকাদান কর্মসূচি দ্রুত শুরু না করি, তাহলে তা বিশাল ট্র্যাজেডি হবে।’ তিনি বলেন, লোকজন মনে করছে সরকারের কাছে তারা পরিত্যক্ত।

করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া এক ব্যক্তির স্বজনের শোক। সাও পাওলো, ব্রাজিল, ৯মার্চ
ছবি: রয়টার্স

আর ফিউক্রুজের মহামারি বিশেষজ্ঞ জেসেম অরেলানা এএফপিকে বলেন, ‘২০২০ সালে কোভিড-১৯–এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পরাজয় ঘটেছে। আর এই বছরের প্রথমার্ধে সেখান থেকে এক চুল উন্নতিরও কোনো সুযোগ নেই। এখন আমরা যা করতে পারি, তা হলো টিকাদান কর্মসূচির মধ্য দিয়ে যদি অলৌকিক কিছু ঘটে থাকে।
গত মঙ্গলবার দেশটিতে ৭০ হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত সপ্তাহের তুলনায় তা ৩৯ শতাংশ বেশি।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, করোনার নতুন ধরন অনেক বেশি সংক্রামক। এটা লাতিন আমেরিকা অঞ্চল এবং এর বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরিস্থিতি ভয়ংকর হবে।

ফিউক্রুজের মহামারি বিশেষজ্ঞ জেসেম ওরেলানা এএফপিকে বলেন, ‘ব্রাজিল মানবজাতির জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।’

বলসোনারোর সমালোচনা

করোনার টিকা ক্রয় কর্মসূচির অনুষ্ঠানে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো। ব্রাসিলিয়া, ব্রাজিল, ১০ মার্চ
ছবি: রয়টার্স

করোনার মহামারি শুরু থেকেই লকডাউনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো। করোনার ঢেউ সামলাতে লকডাউনকে পাগলামি বলেছেন বলসোনারো। জুলাই মাসে নিজেও করোনায় সংক্রমিত হন বলসোনারো। করোনায় সংক্রমিত হওয়ার পরেও তিনি মাঝেমধ্যে তাঁর বাসভবনের বাইরে আসতেন।

এমনকি একসময় এক র‍্যালিতে তিনি মাস্কও খুলে ফেলেন। শুধু করোনাকে হেলাফেলা নয়, করোনাভাইরাসের টিকা নিয়েও নানা সময় সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বলসোনারো। সাফ জানিয়েছেন, তিনি টিকা নেবেন না। ব্যঙ্গ করে বলেছেন, টিকা কেবল তাঁর পোষা কুকুরের জন্য। করোনার ব্যাপক সংক্রমণের পরও মাস্ক পরার তেমন কোনো কার্যকারিতা আছে বলে মনে করেন না বলসোনারো। ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে এসে তিনি বলেন, ‘বোকাদের আমি বলতে চাই, আমি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে গেছি। আমার শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে। তাহলে আমি আর কেন টিকা নেব?’ তিনি বলেন, ‘ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা নিলে মানুষ কুমিরে রূপান্তরিত হতে পারে বা নারীর দাঁড়ি গজাতে পারে। পুরুষকণ্ঠ পরিণত হতে পারে নারীকণ্ঠেও।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস ব্রাজিলের এই পরিস্থিতিকে ‘খুবই উদ্বেগজনক’ বলে উল্লেখ করেছেন। আঞ্চলিকভাবে এটি আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেন তিনি।

এখন বিরোধীরা করোনাকালে প্রেসিডেন্টের যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট লুলা ডি সিলভা। তিনি বলেছেন, বলসোনারো একের পর এক বোকার মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। গত সপ্তাহেও তাঁকে বলতে শোনা গেছে, ‘করোনা নিয়ে কেউ যেন ঘ্যান ঘ্যান না করে। কত দিন আপনারা করোনার জন্য বাড়িতে থাকবেন এবং সবকিছু বন্ধ করে রাখবেন। মৃত্যুর জন্য আমরা দুঃখিত কিন্তু আমাদের একটি সমাধান প্রয়োজন।’ তিনি বলেছিলেন, এসব কারণ যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে, তা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট ক্ষতির চেয়ে বেশি হবে।

সাবেক নেতা লুলা প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তকে ‘স্টুপিড’ বলে দাবি করে তা লোকজনকে অনুসরণ না করার অনুরোধ করেন এবং টিকা নেওয়ার অনুরোধ করেন। তবে বলসোনারো এই সমালোচনাকে অযৌক্তিক বলে দাবি করেন।

ব্রাজিলে করোনার ধরন

ব্রাসিলিয়ার রাস্তায় করোনাভাইরাসের গ্রাফিতি
ছবি: রয়টার্স

প্রাথমিক তথ্যে বলা হচ্ছে, পি১ নতুন ধরনের এই স্ট্রেইন আগের ধরনের চেয়ে দ্বিগুণ সংক্রামক। কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়ে থাকলে তার মধ্যে যে রোগ প্রতিরেধক্ষমতা তৈরি হয়, তা নতুন এই ধরনটি কমিয়ে দিয়ে পুনরায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এই ঝুঁকিটা ২৫ থেকে ৬০ শতাংশের মতো।

এক গবেষণার বরাত দিয়ে ফিউক্রুজ ইনস্টিটিউট জানায়, পি১ বেশ কয়েকটি উদ্বেগের একটি। এই ধরনটি ছয় থেকে আটটি রাজ্য ছড়িয়ে পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির তথ্যমতে, করোনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ২০টি দেশের মধ্যে ১১তম স্থানে এখন ব্রাজিল। দেশটিতে প্রতি এক লাখে মৃত্যুর হার ১২৮ জন।

ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকাকে কোভিড-১৯ ব্রাজিল অভজারভেটরির রবের্তো ক্রায়েনকেল বলেন, ‘এ তথ্য একটি আনবিক বোমার মতো।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস ব্রাজিলের এই পরিস্থিতিকে ‘খুবই উদ্বেগজনক’ বলে উল্লেখ করেছেন। আঞ্চলিকভাবে এটি আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেন তিনি।

কোন টিকা কার্যকর

চীনের সিনোভ্যাক টিকা দেওয়া হচ্ছে একজনকে
ছবি: রয়টার্স

ব্রাজিল অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরির ২০ কোটির বেশি টিকা কেনার চাহিদা দিয়েছে। এরই মধ্যে ৮০ লাখের বেশি মানুষকে টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪ শতাংশ।
প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পি১–এর বিরুদ্ধে কার্যকর। যদিও এই টিকার পেছনে কাজ করা দলটি প্রথম দিকে বলেছিল এটি তেমন সুরক্ষা দিতে পারবে না, কিন্তু এখন পর্যন্ত দেখা গেছে গুরুতর অবস্থায়ও এটি কার্যকর।

ব্রাজিলের আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে এই স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে চীনের সিনোভ্যাক কোম্পানির তৈরি করোনাভ্যাক টিকাও কার্যকর।

নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডেসিনে প্রকাশিত এ পরীক্ষাগারে গবেষণার তথ্যমতে, ফাইজার-বায়োটেকের টিকাও এই ধরনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্যকর। যাই হোক এখনো ফাইজারের টিকা ব্রাজিলে আসেনি। ব্রাজিল কর্তৃপক্ষ এখন এটি কিনতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়, দেশটির অর্থমন্ত্রী পাউলো গুইদেস বলেন, জুন নাগাদ ফাইজার ১ কোটি ৪০ লাখ টিকা পাঠাতে সম্মত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির তথ্যমতে, করোনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ২০টি দেশের মধ্যে ১১তম স্থানে এখন ব্রাজিল। দেশটিতে প্রতি এক লাখে মৃত্যুর হার ১২৮ জন। সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর হার চেক প্রজাতন্ত্রে। প্রতি লাখে সেখানে মৃত্যুর হার ২ হাজার ১৮ জন। যুক্তরাজ্যে এ হার ১৮৮।