অবকাশেও শান্তিতে ছিলেন না মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসের চাপ এড়াতে নয়, বরং হোয়াইট হাইসের সংস্কারকাজ চলছিল। তাই তিনি ওয়াশিংটন ছেড়ে নিউজার্সির বেডমিনস্টারে যান। সেখানে রয়েছে তাঁর নিজস্ব গলফ ক্লাব। কাছের হাডসন নদী পেরোলেই নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে তাঁর ব্যক্তিগত আবাসন ‘ট্রাম্প টাওয়ার’। এখান থেকেই তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর নিজের আবাসনেও ঢুঁ মেরেছেন বেডমিনস্টারের অবকাশ থেকে। তবে নিউইয়র্কের মানুষ এ সময় তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে।

১৭ দিনের অবকাশ শেষে ২০ আগস্ট রাতে তিনি ফিরে গেছেন হোয়াইট হাউসে। যাওয়ার সময় আবার খিস্তি করেছেন সংবাদমাধ্যমকে লক্ষ্য করে। এক টুইট বার্তায় বেডমিনস্টারের গলফ ক্লাবে অবকাশযাপনের সময় ‘হার্ড ওয়ার্ক’ করেছেন উল্লেখ করে বলেছেন, অসৎ সংবাদমাধ্যমের ভুয়া সংবাদ পরিবেশন দেখে তিনি ফিরছেন।

ট্রাম্পের লম্বা এই অবকাশ থাকলেও সময়টা ছিল ঘটনাবহুল। প্রথম সপ্তাহ গেছে উত্তর কোরিয়াসংক্রান্ত উত্তেজনায়। দ্বিতীয় সপ্তাহ গেছে ভার্জিনিয়ায় শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীদের সঙ্গে নাগরিক আন্দোলন-সংঘর্ষের উত্তেজনায়। এর মধ্যে হোয়াইট হাউসের প্রধান কৌশলবিদ স্টিভ ব্যাননকে চাকরিচ্যুত করার ঘটনায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পুরো সময় আলোচনা-সমালোচনার মুখে ছিলেন।

৪ আগস্ট প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউজার্সির বেডমিনস্টারে পৌঁছান। সেই দিনই অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশন ঘোষণা দেন, যেসব সংবাদমাধ্যম রাষ্ট্রীয় গোপন এবং স্পর্শকাতর বিষয় প্রকাশ করছে, তাদের জবাবদিহি করার বিষয়ে বিচার বিভাগের নিয়মনীতি পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।

৭ আগস্ট প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একনাগাড়ে বেশ কয়েকটি টুইট বার্তা প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি গলফ ক্লাবে ‘ওয়ার্কিং হার্ড’ করছেন এবং নিউইয়র্ক টাইমসের কঠোর সমালোচনা করেন। ওই দিন নিউইয়র্ক টাইমস তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছিল, ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স গোপনে ২০২০ সালের নির্বাচনের জন্য প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

৮ আগস্ট ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের প্রতিবেদনে প্রথমে জানায়, উত্তর কোরিয়া দূরপাল্লার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রযুক্তি আয়ত্ত করেছে। এ সংবাদ প্রকাশের পরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক বিবৃতিতে বলেন, উত্তর কোরিয়াকে অস্ত্রের মাধ্যমে উচিত জবাব দেওয়া হবে। উত্তর কোরিয়া দ্রুত পাল্টা জবাব দিয়ে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণাধীন গুয়াম দ্বীপে হামলা চালানোর হুমকি দিলে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়।

৯ আগস্ট ওয়াশিংটন পোস্ট আরেক প্রতিবেদনে জানায়, রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারের তদন্তের অংশ হিসেবে এফবিআই ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণা প্রধান পল মোনাফর্টের বাড়ি তল্লাশি করেছে। এটি ট্রাম্প শিবিরের জন্য উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

১০ আগস্ট প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রাশিয়ার ওপর নতুন অবরোধ আরোপ করেন এবং প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ‘ধন্যবাদ’ জানান। রাশিয়া থেকে আমেরিকার ৭৫৫ জন কূটনীতিক বহিষ্কার করার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ‘এমনিতেই আমরা লোক ছাঁটাই করতে চাচ্ছিলাম।’

১১ আগস্ট ভোরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক টুইট বার্তায় বলেন, উত্তর কোরিয়া গুয়ামে হামলার চিন্তা থেকে সরে না দাঁড়ালে পাল্টা হামলার জন্য মার্কিন সামরিক বিমান পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ভেনেজুয়েলাতে মার্কিন সামরিক শক্তি প্রয়োগের বিষয় বিবেচনায় রয়েছে। পেন্টাগন থেকে পরে বলা হয়, তাদের কাছে এ ধরনের কোনো নির্দেশ নেই। একই দিন বিকেলে জানানো হয়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার নিকোলাস মাদুরোর ফোন কল ধরতে অনীহা প্রকাশ করেছেন।

১২ আগস্ট ভার্জিনিয়ার চার্টোসভিলে শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীরা মিছিল করে কনফেডারেশন মূর্তি অপসারণের বিরোধিতা করলে পাল্টা শোভাযাত্রায় হাজার হাজার ক্ষুব্ধ মানুষের সমাগম ঘটে। বেধে যায় সংঘর্ষ। উত্তেজনাকর এ পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। একজন নারীর মৃত্যু ঘটে। হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুই সদস্যের। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ ঘটনায় দুই পক্ষকে দায়ী করেন। তিনি শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীদের চিহ্নিত করে ঘটনার নিন্দা না জানানোর কারণে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। খোদ রিপাবলিকান পার্টির নেতারাও প্রেসিডেন্টের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন।

১৩ আগস্ট দিনভর মার্কিন মিডিয়া মূলত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমালোচনায় মুখর থাকে। এদিন বিকেলে হোয়াইট হাউস থেকে দেওয়া এক ব্যাখ্যায় বলা হয় প্রেসিডেন্ট তাঁর বিবৃতিতে ঠিকই শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীদের সমালোচনা করেছেন।

১৪ আগস্ট মার্ক কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কেনেথ ফ্রেজিয়ার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উৎপাদনবিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। একই দিনে আন্ডার আরমোরের প্রধান নির্বাহী এবং ইন্টেল কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ট্রাম্পের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। সমালোচনার মুখে ট্রাম্প বর্ণবৈষম্যকারীদের শয়তান হিসেবে উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন। এই দিনে আমেরিকার প্রধান প্রধান নগরে বর্ণবৈষম্য এবং শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদের বিরুদ্ধে বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ হয়।

১৫ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভার্জিনিয়ার ঘটনায় দুই পক্ষের হামলাকারীদের আবার আক্রমণ করেন। তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্ন করেন, বাঁ দিক থেকে যারা হামলা চালাল, তাদের কি কোনো অনুতাপ নেই?

ওই দিনই জানা গেল, উত্তর কোরিয়া গুয়াম দ্বীপে হামলার চিন্তা থেকে আপাতত সরে এসেছে। এ সংবাদ ট্রাম্পের জন্য স্বস্তির কারণ ছিল। অবশ্য ট্রাম্পের উৎপাদনবিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদ থেকে আরও তিনজন নির্বাহীর পদত্যাগ তাঁকে আর সেই স্বস্তি উপভোগ করতে দেয়নি।

ভার্জিনিয়ার ঘটনা নিয়ে ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়ার জের ধরে ১৬ আগস্ট ট্রাম্পের উৎপাদনবিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদের সবাই পদত্যাগ করেন। তাঁদের পদত্যাগের কিছুক্ষণ পরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর উৎপাদনবিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদই বাতিল ঘোষণা করেন। এদিকে চার্টোসভিলের ঘটনার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতারা কংগ্রেসে একটি নিন্দা প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।

টেনেসি থেকে নির্বাচিত কংগ্রেসম্যান স্টিভেন কোহেন ১৭ আগস্ট বলেন, চার্টোসভিলে ঘটনায় নির্লিপ্ততার কারণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনে নৈতিকভাবে অক্ষম। স্টিভেন কোহেন কংগ্রেসে ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব আনবেন বলে ঘোষণা দেন।

১৮ আগস্ট হোয়াইট হাইসের প্রধান কৌশলবিদ স্টিভ ব্যানন পদত্যাগ করেন বা তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই দিনে ক্যাম্প ডেভিটে তাঁর সামরিক উপদেষ্টাদের সঙ্গে আফগানিস্তান ও দক্ষিণ এশিয়া পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করেন। ভার্জিনিয়ার ঘটনার জের ধরে ট্রাম্পের শিল্প ও মানবাধিকার কমিশন তাদের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়।

১৯ আগস্ট হোয়াইট হাউস থেকে জানানো হয়, এবারে কেনেডি সেন্টারের অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট বা ফার্স্ট লেডি যোগ দিচ্ছেন না। রাজনৈতিক গোলযোগ হতে পারে মনে করে—এমন আশঙ্কায় এ সিদ্ধান্ত। দীর্ঘদিন থেকে কেনেডি সেন্টার আয়োজিত সাংবাৎসরিক অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট এবং ফার্স্ট লেডি যোগ দিয়ে আসছেন।

২০ আগস্ট হোয়াইট হাউস থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আজ সোমবার রাতে প্রাইম টাইমে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন।