আরেক কৃষ্ণাঙ্গ হত্যায়ও বিচার হবে না শ্বেতাঙ্গ পুলিশের

যুক্তরাষ্ট্রের ফারগুসনের পর এবার নিউইয়র্কে গ্র্যান্ড জুরি ও পুলিশের নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণ-অসন্তোষ শুরু হয়েছে। গত জুলাই মাসে গ্রেপ্তারের সময় কৃষ্ণাঙ্গ এরিখ গার্নারের (৪৩) মৃত্যুর জন্য শ্বেতাঙ্গ পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে না। গতকাল বুধবার গ্র্যান্ড জুরির এমন সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরই বিকেল থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়।
রাতের নিউইয়র্ক বিক্ষোভের নগরে পরিণত হয়। মধ্যরাত পর্যন্ত অর্ধশতাধিক মানুষকে গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া গেলেও প্রতিবাদ মোটামুটি শান্তিপূর্ণ আছে। নগরজুড়ে পুলিশকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নিউইয়র্কের মেয়র জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পরিবেশ রক্ষা করার আহ্বান জানান।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সমস্যা সমাধানে নিজে উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলেছেন। নিউইয়র্কে কৃষ্ণাঙ্গসহ অভিবাসী গোষ্ঠী, নাগরিক অধিকারকর্মী এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো রাজপথে নেমে এসেছে। পুলিশের বৈষম্যমূলক নির্যাতনের প্রতিবাদে নানা স্লোগান দিয়ে নাগরিকদের সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
গত জুলাইতে নিউইয়র্কের এক ফেরি ঘাটে অবৈধ সিগারেট বিক্রি করছিলেন এরিখ গার্নার। ছদ্মবেশে টহল দেওয়ার সময় শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা ড্যানিয়েল প্যান্টালিও কৃষ্ণাঙ্গ এরিখকে গ্রেপ্তারের জন্য ধাওয়া করেন। একপর্যায়ে গলা চেপে ধরলে এরিখ মাটিতে পড়ে যান। কিছুক্ষণ পরই তিনি মারা যান।
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এরিখ গার্নার হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। ঘটনার সময় ধারণ করা ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, মৃত্যুর আগে এরিখ বলছিলেন, ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।’
এরিখের মৃত্যুর পরই নিউইয়র্কে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। নিউইয়র্ক পুলিশের বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ তীব্র হয়। ঘটনার পরপরই পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তদন্তের পর মামলাটি গ্রান্ড জুরির বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়। মার্কিন বিচার ব্যবস্থায় এ ধরনের অভিযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে আনার আগে গ্র্যান্ড জুরিতে শুনানি হয়ে থাকে।
এরিখ গার্নারের মৃত্যুর পর গঠিত গ্র্যান্ড জুরিতে ৩৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ২১ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। গতকাল বুধবার গ্র্যান্ড জুরির সিদ্ধান্তে জানানো হয়, এরিখের মৃত্যুর জন্য পুলিশ কর্মকর্তাকে দায়ী করার জন্য যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
জুরি বোর্ডের সিদ্ধান্ত জানার পর ফারগুসনের মতো প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়। হারলেম থেকে ব্রুকলিন পর্যন্ত প্রথমত কৃষ্ণাঙ্গরা নগর কেন্দ্রের দিকে আসতে শুরু করেন। ইউনিয়ন স্কয়ার, টাইম স্কয়ারসহ নগরের পশ্চিমের সব জনপদ বিকেলের দিকে প্রতিবাদকারীদের দখলে চলে যায়। লোকজন এরিখ গার্নারের শেষ উক্তি ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। নগরকেন্দ্রের অন্যতম স্থাপনা গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল টার্মিনালে মধ্যরাত পর্যন্ত সমবেত লোকজন স্লোগান দিতে থাকেন। অনেকেই মৃত ব্যক্তির মতো শুয়ে থেকে নীরবে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। ব্রুকলিন ব্রিজ থেকে নগরকেন্দ্রের বাইরেও প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হলে নগরে যান চলাচল ব্যাহত হয়। রকফেলার সেন্টার থেকে সেন্ট্রাল পার্কের গেট পর্যন্ত বিক্ষোভকারীরা দলে দলে অবস্থান নেন। অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। প্রতিবাদকারী ও পুলিশ পাশাপাশি অবস্থান করলেও সহিংসতার কোনো ঘটনা ঘটেনি। মোট কতজন এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন, তার হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম গতকাল মধ্যরাতের দিকে অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের কথা জানায়।
নিউইয়র্কের মতো যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য নগরেও বিক্ষোভ সমাবেশ ছড়িয়ে পড়েছে। অন্তত ৭০টি নগরে তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে নিউইয়র্কের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিউইয়র্ক পরিস্থিতি নিয়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘যখন দেশের কোনো লোক মনে করে তাঁকে আইনের দৃষ্টিতে সমান চোখে দেখা হচ্ছে না, তখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে সমস্যাটি সমাধানের জন্য সহযোগিতা করা আমার কাজ।’ বিষয়টি নিয়ে তিনি ইতিমধ্যে অ্যাটর্নি জেনারেল এরিখ হোল্ডারের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে জানান। জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল জানিয়েছেন, এরিখ গার্নারের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে বিস্তারিত তদন্ত করা হবে।
নিউইয়র্কের মেয়র বিল ডি ব্লাজিও জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ রাখার সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরিখ গার্নারের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তিনি বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেলের তদন্তের মাধ্যমে নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যাঁর হাতে গ্রেপ্তারের সময় এরিখের মৃত্যু হয়, সেই শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা ড্যানিয়েল প্যান্টালিও এক বিবৃতিতে এরিখের পরিবারের প্রতি তাঁর সমবেদনা জানান। তিনি বিবৃতিতে বলেন, কোনো মানুষকে হত্যা করার জন্য নয়, নিরাপত্তাহীনদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্যই তিনি পুলিশের চাকরি গ্রহণ করেছেন। ঘটনার সময় তিনি কেবলই দায়িত্ব পালন করেছেন বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেন।
নিহত এরিখ গার্নারের স্ত্রী ইসা গার্নার গতকাল রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘কোনো সমবেদনা প্রকাশই আমার জন্য যথেষ্ট নয়।’ স্বামী হত্যার বিচারের জন্য সোচ্চার থাকবেন বলে তিনি জানান।
নিউইয়র্কে গত দুই দশকে বড় বড় পুলিশি বর্বতার শিকার হওয়া লোকজনের অধিকাংশই কৃষ্ণাঙ্গ বা অভিবাসী। এসব ঘটনায় নিউইয়র্কের পুলিশের বিরুদ্ধে বর্ণ বৈষমম্যের অভিযোগ উঠেছে।