করোনা মহামারি
কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি যুক্তরাষ্ট্র
এ পর্যন্ত ২ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মৃত্যু।
শুধু নভেম্বরে মৃত্যু ৩৬,৯১৮, সংক্রমণ
৪৪ লাখ।
ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি ভয়াবহ
হতে পারে।
এবারের শীতে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। একদিকে ভ্যাকসিনের আশায় পথ চেয়ে বসে থাকা অসহায় মানুষ, অন্যদিকে একের পর এক নতুন সংক্রমণের রেকর্ড। জানানো হয়েছে, সব ঠিক থাকলে ১৫ ডিসেম্বর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সব জায়গায় ভ্যাকসিন পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অনেক ‘যদি’-‘কিন্তু’ এখনো জমা হয়ে আছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) শীর্ষ কর্মকর্তা সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের এখন পর্যন্ত করোনা মহামারিতে ২ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। এ পর্যন্ত সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৪১ হাজারের বেশি। শনাক্ত সংক্রমণ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। শুধু নভেম্বর মাসেই মারা গেছে ৩৬ হাজার ৯১৮ জন, সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ৪৪ লাখ।
প্রথম দফার চেয়ে দ্বিতীয় দফায় করোনা আরও বিধ্বংসী হয়ে উঠেছে। ২ ডিসেম্বর করোনাভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে ২ হাজার ৭৬০ জন মারা গেছে, মহামারির শুরু থেকে এ পর্যন্ত এটিই সর্বোচ্চ। হাসপাতালে কোভিড রোগী ভর্তির সংখ্যা একের পর এক রেকর্ড ভাঙছে। ১ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোয় কোভিড রোগী ভর্তির সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ। পরদিনই এটি বেড়ে ১ লাখ ২০০ হয়। এ সংখ্যা ভয়াবহ পরিস্থিতির ইঙ্গিতবাহী। ফলে যুক্তরাষ্ট্র আবার একটি অন্ধকার চক্রে আটকা পড়তে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা তীব্র হচ্ছে।
এদিকে থ্যাংকসগিভিং ডে’র মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়েছে উৎসবের মৌসুম। অনেক আগে থেকেই এই উৎসবের সময়ে কঠোরভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নীতি মেনে চলার বিষয়ে সতর্ক করে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু তাতে অনেক মানুষই সাড়া দেয়নি। ফলে করোনাভাইরাস এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব প্রান্তেই পৌঁছে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এ অবস্থায় ভীষণ রকম সতর্কবার্তা দিয়েছেন সিডিসির প্রধান ড. রবার্ট রেডফিল্ড। ২ ডিসেম্বর এ সম্পর্কিত এক ভিডিও বার্তায় রেডফিল্ড, সামনের সময়কে ‘দুঃসময়’ হিসেবে আখ্যা দেন।
রবার্ট রেডফিল্ড বলেন, আগামী কয়েক মাসে যুক্তরাষ্ট্র তার ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে স্বাস্থ্য সংকটের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। সবার কাছে ভ্যাকসিন পৌঁছাতে এখনো বেশ দেরি। এ অবস্থায় একমাত্র সহায় হতে পারে স্বাস্থ্য সুরক্ষানীতিগুলো।
রেডফিল্ড সবাইকে মাস্ক পরা, শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা ও হাত জীবাণুমুক্ত রাখার বিষয়ে সচেষ্ট থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে এখন প্রতিদিন করোনা আক্রান্ত হয়ে ২ হাজারের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। বিষয়টিকে হেলাফেলা করার কোনো সুযোগ নেই।
উৎসব মৌসুমের আগে থেকে দেওয়া নানা সতর্কবার্তা সত্ত্বেও বহু মার্কিন আগের সময়ের মতোই ভ্রমণ করেছেন। সামনেই বড়দিন। ফলে এই ভ্রমণে বাধ না দিলে সমূহ বিপদ হতে পারে। রেডফিল্ড সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে। দেশের প্রতিটি কোনায় ভাইরাসটি পৌঁছে গেছে। হাসপাতালগুলোর ৯০ শতাংশই করোনা হটস্পটে পরিণত হয়েছে। ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি-এই তিন মাস ভীষণ কঠিন হতে যাচ্ছে।’
এই পরিস্থিতিতে ভ্যাকসিনের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। যুক্তরাজ্য এরই মধ্যে ফাইজারের তৈরি করোনা টিকার অনুমোদন দিয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ওপর বাড়তি একটি চাপ সৃষ্টি হয়েছে। চাপ আছে বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসনের দিক থেকেও। এরই মধ্যে করোনা ভ্যাকসিন অনুমোদনে বিলম্বের কারণে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফকে তিনি এই বিলম্বের কারণ অনুসন্ধানের দায়িত্ব দিয়েছেন। যদিও অনুমোদন দেওয়ার এখতিয়ার যে ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ), তারা বলছে বিধি অনুযায়ীই তারা অনুমোদন দেবে। এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিনের অনুমোদন চেয়ে ফাইজার ও মডার্নার করা আবেদন পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। এ নিয়ে জরুরি সভায় বসতে যাচ্ছে তারা। আগামী ১০ ডিসেম্বর ফাইজার ও ১৭ ডিসেম্বর মডার্নার তৈরি টিকা নিয়ে জরুরি সভা করবে এফডিএ। অপেক্ষায় রয়েছে আরেক প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি ভ্যাকসিনও।
এই অনুমোদনের পরপরই টিকা সরবরাহ করতে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে পরিবহন খাত থেকে শুরু করে সব সংশ্লিষ্ট দপ্তর। সিডিসি এরই মধ্যে ভ্যাকসিন বিতরণের পদ্ধতি ঠিক করে নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছে। ওষুধ কোম্পানিগুলো এরই মধ্যে টিকা উৎপাদন শুরু করেছে। আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ১০ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে বলে জানানো হয়েছে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের সবার কাছে টিকা পৌঁছাতে সময় লাগবে। এই সময়ের মধ্যেই বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
বিষয়টি নিয়ে উদ্গ্রীব নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ সম্পর্কিত এক বক্তব্যে বাইডেন বলেন, ‘বড়দিন খুব কঠিন হতে যাচ্ছে। আমি কাউকে ভয় দেখাতে চাই না। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আগামী জানুয়ারির মধ্যে আমরা হয়তো আরও আড়াই লাখ মানুষকে হারাতে পারি। আপনারা কি শুনতে পাচ্ছেন?’
ভ্যাকসিন নিয়ে মুশকিল আরও আছে। যুক্তরাজ্যে ফাইজারের ভ্যাকসিনের অনুমোদন দেওয়ায় সেখানে এর প্রয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের আগেই শুরু হবে। ফলে সেখানে ভ্যাকসিনটি কেমন করছে, তার ওপর নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ একে কীভাবে নেবে। এমনিতেই প্রতি বছর ফ্লু ভ্যাকসিন দেওয়ার সময় কিছু মানুষ এর বিরোধিতা করে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে এর প্রয়োগ একেবারে সহজ হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।
এদিকে নিউইয়র্কসহ প্রায় এলাকাই আবার লকডাউনের দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু অর্থনীতির অবস্থা ভীষণ ভঙ্গুর। ফলে এবারের লকডাউন আগের মতো সহজ হবে না। সাইরেনের শব্দে মানুষ এখন আর ফিরে দেখে না। মার্চ মাসের শেষ দিকে নিউইয়র্ক, নিউজার্সির নগর জনপদ সাইরেন ও অ্যাম্বুলেন্সের জনপদ হয়ে উঠেছিল। পরিস্থিতি দ্রুতই সেদিকে মোড় নিচ্ছে। নিউইয়র্ক নগরের হাসপাতালগুলো এমনিতে ভরে উঠছে। হাসপাতালে অতিরিক্ত বেড প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
ক্রিসমাস উৎসবের পর অনেকেই হয়তো ঘরে ফিরবে না আর; বাস্তবতা আজ এতই নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। মৃত্যুর সংখ্যা আগামী ছয় সপ্তাহে আরও বাড়বে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। ২ ডিসেম্বর যত মানুষ বিভিন্ন হাসপাতালে কোভিড রোগ নিয়ে ভর্তি ছিল, মহামারি শুরুর পর এটাই সর্বোচ্চ। মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া করোনার ব্যাপক সংক্রমণ এখন আর নগরকেন্দ্রের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় থেমে নেই। বড় নগরকেন্দ্রের বাইরের হাসপাতালগুলোতে এরই মধ্যে কর্মী সংকট দেখা দিয়েছে।
এ কারণেই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ দেশের প্রধান জনস্বাস্থ্য সংস্থাগুলো বারবার সতর্ক করছে মানুষকে। ভ্যাকসিন এলেই হবে না। অন্তত ৭০ শতাংশ মানুষকে এ ভ্যাকসিন নিতে হবে। এর আগ পর্যন্ত এ ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। সিডিসি পরিচালক রবার্ট রেডফিল্ডের মতে, ‘আগামী তিন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোয় যত রোগী আসবে, তার চাপ সামাল দেওয়াই হবে বড় চ্যালেঞ্জ।’
রয়েছে আরও চ্যালেঞ্জ। গত এক সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ৬১ হাজার নতুন সংক্রমণ রেকর্ড করা হয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার পরোক্ষ প্রভাবে মৃত্যুর হিসাব করলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা সঠিকভাবে বোঝা যাবে। এ অবস্থায় আপাতত নিজেকে রক্ষার জন্য সংক্রমণ প্রতিরোধী নির্দেশনা মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। আসছে তিন মাসের জন্য মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে ভ্রমণ এড়িয়ে চলাসহ যেসব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানানো হচ্ছে, তা সবার মেনে চলা উচিত।