সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা। এর থেকে বাদ পড়ছেন না বাংলাদেশি মার্কিন নারীরাও। করোনাকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী নারীরা আরও বেশি সাইবার অপরাধ বা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

নারীর প্রতি সহিংসতা, অন্যায় আচরণ এবং তাঁদের ওপর আক্রমণ যেন কিছু পুরুষের কাছে ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিবাদ হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব ঘটনা চাপা পড়ে যায়। তাঁদের কথা বলা বা শোনার মানুষের অভাবে সমাজে নারীদের নানাবিধ সমস্যা যেন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। আর এ কারণেই নারীদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা, ভাঙছে সংসার। করোনাকালে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে নারীর প্রতি সাইবার অপরাধের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে। হয়রানির শিকার এসব নারী প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার কাছেও এ নিয়ে অভিযোগ করেন।

হয়রানির শিকার বাংলাদেশি মার্কিন সুলতানা নাসরিন (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমি এক বছর ধরে অনলাইনে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছি। গত বছর হঠাৎ আমার কিছু আত্মীয়-বান্ধবী ফোন করে বলে, কোনো এক লোক ভিডিওঅ্যাপ টিকটকে আমাকে নিয়ে খুব বাজে ভাষায় আপত্তিকর মন্তব্য করছে। এরপর আমি বিভিন্ন সময় প্রতিবাদ করলেও অনেক নারী প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। আমি অনেকবার ওই ব্যক্তির কাছে জানতে চেয়েছি, কী কারণে তিনি আমাকে সামাজিকভাবে হেয় করেছেন। কিন্তু তার কাছ থেকে এর কোনো উত্তর পাইনি। পরে জানতে পারি, ওই রকম অনেক নারীকে টার্গেট করে ওই ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব কাজ করে। এরপর আমি নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগে তার বিরুদ্ধে জিডি করি।’

গত বছরের মার্চ থেকে করোনার কারণের যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। এদের অধিকাংশই এখন অনলাইনে সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন। আর এই সুযোগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে নতুন করে আলোচনায় আসে ‘টিকটক’ নামের অ্যাপটি। এই অ্যাপ বর্তমানে প্রচুর অভিবাসী বাংলাদেশি ব্যবহার করে থাকেন। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও প্রতিদিন নানা ধরনের ভিডিও তৈরি করেন। আর এই ভিডিও পোস্ট করার পরই শুরু হয় আপত্তিকর মন্তব্য, পরিবার নিয়ে নোংরা কথাবার্তা, এমনকি মারামারি থেকে শেষ পর্যন্ত পুলিশে গড়িয়েছে—এমন ঘটনাও ঘটেছে।

গত বছরের ডিসেম্বরে নিউইয়র্ক নগরের বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা জ্যাকসন হাইটসে এক বাংলাদেশি টিকটকারকে জুতাপেটা করেন আরেক বাংলাদেশি নারী। এর পরই ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

এই ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, মোবারক দেওয়ান নামের এক বাংলাদেশি মার্কিন টিকটক ভিডিওর মাধ্যমে গত কয়েক মাস ধরে এক নারীকে খুব বাজেভাবে কথাবার্তা বলেন। একেক ভিডিওতে একেক রকম হুমকি দিয়ে ওই নারীকে চাপে রাখার চেষ্টা করেন এবং তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। একপর্যায়ে ওই নারীর সঙ্গে মোবারকের দেখা হয় বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা জ্যাকসন হাইটসে।

দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওই নারী মোবারকের ওপর চড়াও হন। এ সময় ওই নারী জনসম্মুখে এই ব্যক্তিকে জুতাপেটা করেন। আশপাশে থাকা অনেক বাংলাদেশি নানাভাবে ওই নারীকে শান্ত করার পর ঘটনাটি সেখানে শেষ হয়। তবে ততক্ষণে জুতাপেটার ভিডিও রেকর্ড করা হয়ে গেছে। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ আপলোড করে দিলে মুহূর্তেই সেটি ভাইরাল হয়ে যায়।

মোবারকের মতো আরও অনেক পুরুষ যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করছেন। কিন্তু এর কোনো সুষ্ঠু সমাধান বা প্রতিকার মিলছে না। যারা প্রতিবাদ করছেন, উল্টো তাদের সামাজিকভাবে হেয় করা হচ্ছে। নারীদের নিয়ে এসব আপত্তিকর মন্তব্যের প্রতিবাদ করেছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশি মো. শাহেদুল হক।

প্রতিবাদ করতে গিয়ে উল্টো সমস্যায় পড়তে হয় শাহেদুলকে। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, মোবারক দেওয়ান নামের ওই ব্যক্তি এবং তার একটি অনলাইন গ্রুপ শাহেদুল ও তার পরিবার নিয়ে বাজে ভাষায় গালাগালি ও আপত্তিকর মন্তব্য করেন।

ফাতেমা ইয়াসমিন (ছদ্মনাম) নার্সিং নিয়ে সদ্য পড়াশোনা শেষ করেছেন। নিউইয়র্কে নার্সিং পেশায় চাকরির জন্য তিনি আবেদন করছেন। নার্সিং পড়ার পাশাপাশি তিনি ফুলটাইম কাজ করতেন। সন্তানদের নিয়ে তিনি একাই সংসার চালান। মাঝেমধ্যে নিজের অবসরে ফেসবুক, টিকটিককে কিছু ভিডিও আপলোড করতেন। কিন্তু ভিডিও পোস্ট করার পর ঘটে যত বিপত্তি। বাংলাদেশি অনেকেই তার পোশাক, ভিডিও নিয়ে বাজে ভাষায় মন্তব্য শুরু করে। তিনি এর প্রতিবাদ করলে উল্টো তাঁকে ও তার পরিবারকে হুমকি দেয় কিছু প্রবাসী বাংলাদেশি।

ফাতেমা বলেন, ‘আমি এসব বিষয় স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেককেই অবগত করি। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার পায়নি। আমি সন্তান নিয়ে থাকি, এরপরও আমার ভয় নেই। তবে, অবাক লাগে একজন পুরুষ একজন নারীকে নিয়ে নোংরা কথাবার্তা বলছে কোনো কারণ ছাড়াই। অথচ প্রতিবাদ শুধু দু-একজন ছাড়া কেউই কথা বলছে না। নারী হয়ে জন্মানোই কী আমাদের অপরাধ?’

ওয়াশিংটন ডিসিতে ফারিয়া ইসলাম (ছদ্মনাম) নামের এক বাংলাদেশি নারী রেস্টুরেন্টের খাবারের লাইভ ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করার পর সেই ভিডিওতে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন আরেক বাংলাদেশি মার্কিন পুরুষ। পরের দিন লন্ডন থেকে তার পরিবারের এক আত্মীয় ফোন করে বলেন, মোবারক নামের এক লোক তাকে নিয়ে গালিগালাজ করে টিকটকে ভিডিও বানিয়েছে। এরপর তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।

যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশে বাংলাদেশি নারীরা কেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন? এ বিষয়ে নিউইয়র্ক বোর্ড অব ইলেকশনের কমিশনার, স্যাফেস্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা মাজেদা উদ্দিন প্রথম আলো উত্তর আমেরিকাকে বলেন, ‘আসলে সমস্যা নারীদেরও আছে। আমি নিজে একজন নারী, আমি জানি বিশ্বের প্রতিটি দেশে নারীরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছেন। বিশেষ করে বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে না জেনে, না বুঝে বন্ধুত্ব করা, স্বামী বাইরে কাজ করতে গেলে ঘরে বসে অন্য পুরুষের সঙ্গে চ্যাট করা, না জেনে অন্যকে বিশ্বাস করে নিজের সবকিছু একজন অচেনা মানুষকে শেয়ার করা বেশ বোকামির কাজ।’

মাজেদা আরও বলেন, এই সমস্যা আজকের নয়। তবে এটি সত্য, করোনার কারণে নারীদের অনলাইনে সাইবার হয়রানি আরও বেড়েছে। এ থেকে কীভাবে প্রতিকার পাওয়া যায় সে বিষয়ে আমরা কাজ করছি। তবে আমি এতটুকুই বলব, কারও সঙ্গে অনলাইনে পরিচয় হলে তার সম্পর্কে যাচাই-বাছাই না করে বন্ধুত্ব করবেন না। এমনকি আপনার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ছোট পরিসরে রাখুন। তা না হলে এর ভুক্তভোগী হবে আপনার পরবর্তী প্রজন্ম।