কৈশোর সংস্কৃতি: নৌকা বাইচ

আমার শৈশবের কিছু স্মৃতি হাতড়িয়ে আমার এ লেখার অবতারণা। এককালে বৃহত্তর সিলেটের গ্রামাঞ্চলে বর্ষাকালে নৌকা বাইচের প্রচলন ছিল। বিরাট লম্বা আকৃতির নৌকা তৈরি করে সারি গানের তালে তালে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা হতো। আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামটা ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বসবাস। তাদের অধিকাংশ পরিবারই ছিল বংশ পরম্পরায় কাঠ মিস্ত্রি। বর্ষাকালে তাদের একমাত্র পেশা ছিল নৌকা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করা।
বর্ষা কালে অনেক শৌখিন লন্ডনপ্রবাসী নৌকা বাইচের আয়োজন করতেন। আবার অনেকে এসব নৌকা তৈরি করাতেও উৎসাহী হতেন। এসব নৌকা তৈরি করতে একমাত্র জারুল কাঠ ব্যবহার হতো। প্রায় ৫২-৫৬ হাত (প্রতি হাত ১৮ ইঞ্চি) লম্বা হতো নৌকাগুলো। এগুলো তৈরি করতে প্রায় মাসখানেক সময় লেগে যেত। তারপর আলকাতরা মাখিয়ে তার ওপর নানা রঙের কারুকার্য করে আকর্ষণীয় করা হতো। কোনো কোনো নৌকার আগা বা গলুইয়ে বসানো হতো ময়ূর। ময়ূর সাধারণত টিন কেটে কেটে তৈরি করা হতো। তারপর নৌকাগুলো বাইচের উপযোগী করে তোলা হতো। নৌকার গোড়ায় দু সারি করে পাইক বসানো হতো। পেছনের গলুইয়ে একজন কান্ডারীসহ দুই সারিতে বারো-চৌদ্দজন লোক লম্বা লম্বা বইঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিযোগিতার জন্য সদা প্রস্তুত থাকত। নৌকার মধ্যখানে ঢোল করতাল আর কাশার তৈরি ঘণ্টা হাতে তিন-চারজন লোক দাঁড়িয়ে সারি গান গেয়ে তালে তালে বাজনা বাজাত। নৌকার পাইক সবাই যার যার অবস্থান থেকে বইঠা বাইতে থাকত।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল কাছে থেকে দেখার। নৌকা বাইচের সারি গান প্রথমে একজন শুরু করত; বাকি সবাই সুর মিলাত এর সঙ্গে। সারি গানের ধরন ছিল এমন—
১) সোনার নায়ে রুপার বইঠা
কে বাইয়া যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল
করেরে ময়ূরপংকি নায়।
অথবা
২) কোন মিস্তিরি নাও বানাইছে
তারে দেখা যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করেরে
ময়ুরপংকি নায়।
অথবা
৩. আগার পাইকে মারে টান
নায়ে মারে উড়া
পিছের বইঠায় মারে টান
আগায় নায়ের গুরা,
ওরে শাবাশ শাবাশ হেইয়া।
এসব সারি গান গাওয়া হতো প্রতিযোগিতার সীমানায় পৌঁছার আগে। প্রতিযোগিতা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সারিগান বন্ধ হয়ে বাদ্য দ্রুতগতি ধারণ করত এবং ‘বাইওরে হেইয়া, বাইওরে হেইয়া’, এ ধরনের সমস্বরের মাধ্যমে একসময় সব প্রতিযোগী সীমান্তে পৌঁছে যেত। তখন স্থান নির্ধারণের পালা। প্রথম পুরস্কার হিসেবে সাধারণত ভেড়া দেওয়া হতো। যারা বিজয়ী হতো, তারা ভেড়া পেয়ে খুবই আনন্দিত হতো। কারণ, ভেড়া ভূরিভোজের উপকরণ হিসেবে খুবই আকর্ষণীয় ছিল।
প্রথম স্থান অধিকারী পুরস্কার হিসেবে যা পেত, তা নিয়ে আবার একটা সারিগান গাওয়া হতো। যেমন-
বিলপার গ্রামের মধুমিয়া
বড় ভাগ্যবান
সোনার বাটায় পান খাবাইয়া
পাঠা করলা দান। (পাঠা-ভেড়া)
এসব সারিগানের রচয়িতা কে ছিল আমি জানি না। যারা গাইত, তারাও জানত না। তবে একটি গানের মিল প্রয়াত বাউল শাহ আব্দুল করিমের রচিত গানের সঙ্গে পাওয়া যায়। গ্রামবাংলার এসব সংস্কৃতি আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। তার একমাত্র কারণ হিসেবে বলা যায়, অনেক বিল বা জলাশয় ভরাট হয়ে বর্ধিত জনসংখ্যার কিছু অংশের বসতি স্থাপন করে এ সংস্কৃতির অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেটের গ্রামবাংলার এসব সংস্কৃতি হারিয়ে অপসংস্কৃতির রূপ নিয়েছে। এখন নৌকা বাইচের প্রতিযোগিতা প্রায় বিলুপ্তির পথে। তার সঙ্গে সম্পৃক্ত জারি-সারিগানের সংস্কৃতি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের বর্তমান প্রজন্ম গ্রামবাংলার সংস্কৃতির যে চিরায়ত রূপ ছিল, নিঃসন্দেহে তারা যোজন যোজন দূরে চলে এসেছে। এখন তারা বেছে নিয়েছে বর্তমান প্রযুক্তিগত অত্যাধুনিক সামগ্রী।