তেতো নয় 'রাতের অতিথি'
আশরাফ আহমেদের রাতের অতিথি বইটা বলা যায় এক নিশ্বাসেই শেষ করলাম। স্লো রিডার হয়েও বইটা শেষ না করে পারছিলাম না। এই বইয়ে আশরাফ আহমেদ বিভিন্ন লেখকের ২৩টি বই নিয়ে আলোচনা করেছেন। সমালোচকের কষ্টিপাথর দিয়ে নয়, নিবিষ্ট পাঠকের দৃষ্টি দিয়ে। মজার বিষয়, তিনি বইগুলো কোনো বিশেষ কায়দায় নির্বাচন করেননি। সম্প্রতি যা পড়েছেন, তা নিয়েই আলোকপাত করেছেন।
তাঁর এই ২৩টি আলোচিত বইয়ের মধ্যে মাত্র কয়েকটি আমার পড়া, বেশির ভাগ অজানা। দুটি বাড়তি লাভ হলো। অনেকগুলো ভালো বই সম্পর্কে অল্প সময়ে সম্যক ধারণা পেলাম। বইগুলোর বিষয়বস্তু এবং আশরাফ আহমেদের সাবলীল মনোগ্রাহী লেখা, দুটিই উপভোগ করলাম।
তিতাস একটি নদীর নাম নিয়ে আলোচনাটিতে লেখকের ভাষা এত প্রাঞ্জল এবং হৃদয়স্পর্শী, শেষের দিকে তা প্রায় কবিতাই মনে হচ্ছিল। তিনি শেষে আবেগে আপ্লুত হয়ে সেই বইয়ের লেখক অদ্বৈত মল্ল বর্মণকে ডেকে বলছেন, ‘অসীম মায়া জাগানিয়া আপনার সেই অনুভবের মতোই ছোট হতে হতে...’
বইটির গভীরে ঢুকে আশরাফ আহমেদ সারবস্তু পাঠককে দিয়েছেন। আমার এখন তিতাস একটি নদীর নাম বইটি ভীষণ পড়ার ইচ্ছা জেগেছে।
তেমনি বঙ্গবন্ধুর কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায় লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটিও পড়ার লোভ হচ্ছে। বইটির অথেন্টিসিটিও আশরাফ আহমেদ সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। কিছু কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরে বইগুলোর ভেতরে নিয়ে গেছেন তিনি।
শরৎ চন্দ্রের দেবদাস উপন্যাসের আলোচনা করলেন ভিন্ন ঢঙে। তাঁর বন্ধু আবদুল মান্নানের বিষাদময় শেষ জীবন এবং একাকী মৃত্যু তিনি এমন ভাবে দেবদাসের জীবনের সঙ্গে মেলালেন, যে পাঠকের বুক চিরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসবেই। ‘...অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর প্যারামেডিকসরা নানা যন্ত্রপাতি দিয়া তাহাকে বাঁচাইবার চেষ্টা নিশ্চয়ই করিয়াছিল। কিন্তু কেহ তাহাকে চিনিল না! কোনো ধর্মগ্রন্থ হইতে কেহ এক স্তবক দোয়া বা মন্ত্র উচ্চারণ করিল না।.... কেহ তাহার জীবনের শেষ ইচ্ছার কথা জানিতে চাহিল না।...প্রাণ বায়ুটি দেহত্যাগের কষ্টে গড়াইয়া পড়া শেষ অশ্রুটুকু কেহ মুছাইয়া দিল না!’ দেবদাসের মতোই আরও একটি বিরহী প্রাণ হালে আমেরিকায় নিভে যাওয়ার অত্যন্ত মানবিক একটি বর্ণনা।
হাল আমলের অনেক বই তাঁর লেখায় স্থান পেয়েছে। যেমন হাসনাত আবদুল হাইয়ের সুপ্রভাত বিষণ্নতা, হাসান আজিজুল হকের উঁকি দিয়ে দিগন্ত, আশীফ এন্তাজ রবির চন্দ্রমুখী, নুরজাহান বোসের আগুনমুখার মেয়ে, সন্তোষ বড়ুয়ার কাঠবিড়ালি ক্রসফায়ার এমন আরও কতগুলো বই।
লেখক আশরাফ আহমেদের পাণ্ডিত্য অনেক। সেটা তিনি লুকাতেও পারেননি, কিন্তু স্বজ্ঞানে জাহিরও করেননি।
যদিও লেখক নিজেই কৌতুকচ্ছলে বলেছেন, ‘... জন্ম সূত্রেই সবকিছুতে খুঁত ধরার আমার যে প্রবণতা, তার প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে...’, কিন্তু তার প্রকাশ আসলে ঘটেনি। এই বইটি গতানুগতিক সমালোচনার বইয়ের মতো তেতো বই নয়। এই বইটি মধুর, বইটি সবার জন্য।
একজন লেখক যখন নিজের সময় অন্য লেখকদের বই মানুষের কাছে পরিচিত করানোর কাজে নিঃস্বার্থ ভাবে ব্যয় করেন, তখন তাঁকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।
বইটির সুন্দর প্রচ্ছদ করেছেন আনোয়ার ইকবাল কচি। ২০১৯ সালের একুশে বই মেলায় বইটি প্রকাশ করেছে আগামী প্রকাশনী। পাঠকের এ বইটি অনেক ভালো লাগবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।