বুয়েটিয়ানদের বনভোজন গত ২৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ব্ল্যাক হিল পার্কে। দুই শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুর জমায়েত হয়েছিল এই আয়োজনে। অ্যালামনাইদের কারও ঠিকমতো দাঁড়ি গোঁফ ওঠেনি থেকে শুরু করে, কেউ কেউ একেবারে সফেদ দাঁড়ি নিয়ে জীবনের প্রতি উদাস হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সর্ব বয়োজ্যেষ্ঠ পাওয়া গেল একজনকে, তাঁর বুয়েটে ভর্তি হওয়ার সালটা বুকেই লেখা ছিল, ১৯৬২। উৎসাহ নিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে গেলাম। বললেন, তখন তো বুয়েট বলত না, ছিল আহসানউল্লা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। তারপর আমরা থাকতে থাকতে ১৯৬২ সালে সেটা বিশ্ববিদ্যালয় হয়। তার নাম ছিল ‘ইপুয়েট’। তারপর দেশ স্বাধীন হলে হলো ‘বুয়েট’।
একেবারেই নবীন, ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে বলে মনে হয় এমন ছেলে মেয়েদেরও দেখলাম। পরে কথা বলে জানলাম, অনেকেই এখানে পিএইচডি করছেন অথবা শেষ করে ফেলেছেন। নিজের বিদ্যার দৌড় কম, আবার ছাত্রও ভালো ছিলাম না, তাই অন্য বিষয় নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলাপ শুরু করলাম। এই যেমন আমেরিকা কেমন লাগছে? সবেধন নীলমণি ছাত্রীদের একটা হল ছিল, সেটার কোনো নাম তখন ছিল না। বলা হতো ‘ছাত্রী হল’, এখনো কি তাই আছে? উত্তর পেলাম, এখনো সেই হলের কোনো নামকরণ হয়নি। কী আশ্চর্যের বিষয়! এত দিন এটা খেয়াল করিনি! বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের কোনো নাম নেই! হতে পারে?
তারপর একজন সাবেক ছাত্র, পরে শিক্ষক হয়েছে, মনে করিয়ে দিলেন শহীদ স্মৃতি হলে শুধু ছাত্ররাই থাকত না, শিক্ষক আবাসন সমস্যার কারণে লেকচারারদেরও সেখানে রুম দেওয়া হতো।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রসিক বুয়েটিয়ান ইকবাল হাসান অঞ্জন বললেন, ‘আমাদের সময় পলাশীর যুদ্ধ হয়েছিল।’ অনেকে হতভম্ব। আমিও ভাবলাম এ আবার কেমন কথা? নবাব সিরাজদ্দৌলা যে পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধ করেছিলেন, সেটা কি বুয়েটের সেই পলাশী? তিনি খুলে বললেন, পলাশীতে অবস্থান করি, দখলদার কিছু মানুষের সঙ্গে জায়গা নিয়ে বুয়েটের ছাত্রদের লড়াই হয়। বুয়েটের তখনকার দুই হাজার ছাত্র তাদের সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না। তাঁদের পক্ষের কেউ নাকি কৌতুক করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘হায়রে, এতগুলো ছাত্র, একজনের কাছেও অস্ত্র নেই?’ এর উত্তরে পাশেই দাঁড়ানো পুলিশ সার্জেন্ট বললেন, ‘এ জন্যই তাঁরা বুয়েটের ছাত্র।’ এই পর্যায়ে অনেক হাততালি পরে।
যাই হোক, তাঁর ভাষ্যমতে, ‘পলাশীর যুদ্ধের’ কারণেই সেই জায়গাটি বুয়েট বরাদ্দ পায়। তারপর কমিটিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। আশঙ্কায় ছিলাম, কত যে কথা শুনতে হবে। তবে তাঁদের বক্তব্য দীর্ঘ ছিল না। খুব প্রয়োজনীয় সব কথা। কমিটির প্রেসিডেন্ট কবির আহমেদ, কথা বলতে গিয়ে লম্বা হয়ে যায় কিনা ভেবে চারটি লাইন লিখে পকেটে করে নিয়ে এসেছেন। তাঁদের সবার সংযম ও নিষ্ঠা দেখে আনন্দিত না হয়ে পারলাম না।
একপর্যায়ে উপস্থিত সবাইকে তাঁদের বিভাগ, হলের নাম এবং ভর্তির সাল বলতে বলা হলো। একজন বললেন, ‘বিভাগ যন্ত্র, হল বয়লার।’ যন্ত্র এবং বয়লার ভয়াবহ একটা কম্বিনেশন। এ কিন্তু ব্রয়লার মুরগি নয়, যার ভেতরে কারখানার পানি গরম হয়ে বাষ্প হয় তা হলো বয়লার। তো কেন তিনি এমনটা বললেন? বুয়েটের প্রতিটি ডিপার্টমেন্টের বাংলা নাম আছে। আমরা যখন পড়তাম তখন নামকরণ এমন ছিল—ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বাংলা হলো তড়িৎ কৌশল, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং হলো কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং হলো পুরকৌশল, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং হলো যন্ত্রকৌশল, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং হলো কেমিকৌশল, ওয়াটার রিসোর্স হলো পানি সম্পদ কৌশল, নেভাল আর্কিটেকচার হলো নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল, আর্কিটেকচার হলো স্থাপত্য বিভাগ ইত্যাদি। কাজেই, তিনি যন্ত্র কৌশলকে বলেছেন যন্ত্র, আর বয়লার হলো নজরুল ইসলাম হলের ডাক নাম। এই হলটি খুব গরম হওয়ায় তার বয়লার নাম দেওয়া হয়। কবে কে এই নাম দিয়েছেন কেউ বলতে পারবেন না, তবে হলটিকে বয়লার নামে বুয়েটের ছেলে-বুড়ো সবাই চেনেন।
তারপর একজন হলের নাম বলার আগেই পাশ থেকে আরেকজন বললেন, ‘বলাকা হল’। বোঝা গেল তিনি ঘনঘন নিউ মার্কেটের বলাকা হলে ছবি দেখতে যেতেন, তাতে হাসির রোল উঠল।
অনেকে কীর্তিমান মানুষ। আই-ইইই (আই ট্রিপল ই) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারদের একটি পেশাজীবী সংগঠন। বলা হচ্ছে, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্রযুক্তিবিদদের পেশাভিত্তিক সংগঠন। একজন অ্যালামনাই এই ‘আই ট্রিপল ই’র পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি সোসাইটির সভাপতি ছিলেন। তিনিই নাকি সর্বপ্রথম অ-শ্বেতাঙ্গ যে কিনা এই পদটিতে কাজ করেছেন। এবার পুরো ‘আই ট্রিপল ই’র সভাপতি পদে তিনি নির্বাচন করার মনোনয়নও পেয়েছেন। সেসব তাঁর মুখ থেকেই শোনা হলো। তাঁর নাম সাইফুর রহমান।
বনভোজনে উদ্যোক্তারা দেশের জন্য কিছু করার কথা বললেন। বললেন, দেশের প্রতি আমাদের দায় অনস্বীকার্য। এই ফোরাম থেকে কীভাবে দেশের জন্য সবাই এক যোগে কিছু করা যায়, সে কথা হলো। কিছু কিছু কাজ শুরু হয়েও গেছে। তাঁরা এই সংগঠনের নাম দিয়েছেন ‘বুয়েটিয়ান ইউএসএ-ক্যাপিটাল রিজিয়ন।’
সবচেয়ে যেটা চোখে পড়ে, সেটা হলো প্রজন্মের বৈচিত্র্য। কত ভিন্ন প্রজন্মের সাবেক শিক্ষার্থীরা জুটেছেন সেখানে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেন ফলবান গাছ অথবা বহমান নদী, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জ্ঞান-বারি বিতরণ করে যায়। আর সেই জ্ঞান যেন দেশ-দশ ও মানবতার উৎকর্ষে ব্যবহার হয়, নদীটির শুধু সেই প্রত্যাশা।