যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক নগরের ট্যাক্সি শিল্পকে বাঁচাতে নেওয়া নতুন সহায়তা পরিকল্পনা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। নগর কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে ক্যাবিদের নিয়ে কাজ করা কিছু সংগঠন এই পরিকল্পনাকে ইতিবাচকভাবে দেখলেও সমালোচকেরা বলছেন, এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে পুরো ক্যাব শিল্প ও এর বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
নিউইয়র্ক পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্যাবিদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন নিউইয়র্ক ট্যাক্সি ওয়ার্কার্স অ্যালায়েন্স চলতি মাসে একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাব চালকদের সহায়তার লক্ষ্যে হলুদ ট্যাক্সিক্যাবের মেডালিয়ন লাইসেন্সের দাম ও এর বিপরীতে দেওয়া ঋণের অঙ্ককে কমিয়ে আনা হবে। মেডালিয়নের অনুমোদনের জন্য এখন ব্যয় করতে হবে ১ লাখ ২৫ হাজার ডলার। পুরো বিষয়টির নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকবে নগর কর্তৃপক্ষ।
নতুন এই পরিকল্পনা প্রস্তাব করেন ট্যাক্সি ওয়ার্কার্স অ্যালায়েন্সের নির্বাহী পরিচালক ভৈরবী দেশাই। এতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মেডালিয়নের দাম কমানোর ওপর। ২০১৩ সালে এই ট্যাক্সি মেডালিয়নের দাম বেড়ে এমনকি ১০ লাখ ডলার ছাড়িয়ে যায়। নতুন পরিকল্পনায় এ জায়গাটিতেই বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ট্যাক্সি মেডালিয়ন কিনতে নেওয়া ঋণ পরিশোধে মাসিক কিস্তির পরিমাণ তিন-চার হাজার ডলার থেকে কমিয়ে ৮০০ ডলারে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে পরিকল্পনায়। এ ক্ষেত্রে ঋণের বিপরীতে সুদহার থাকবে ৪ শতাংশ।
নিউইয়র্কের ট্যাক্সি শিল্প দীর্ঘদিন ধরেই খুব বাজে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর আগেই এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আর্থিক সংকট চরমে ওঠে। বিষয়টি মীমাংসার জন্য ক্যাবিরা একাধিকবার আন্দোলন করেছেন। আর্থিক সংকটের কারণে অনেক ক্যাবি আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছেন। এ অবস্থায় ক্যাব শিল্পের সংকট মোকাবিলায় নগর কর্তৃপক্ষ কিছু ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু সংকট সমাধানে এগুলো ছিল অপ্রতুল। এ প্রেক্ষাপটেই নতুন এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হয়।
এক সময় যে ট্যাক্সি মেডালিয়নের দাম ছিল ১০ লাখ ডলারের বেশি, তার দাম কমতে কমতে এক সময় ২ লাখ ডলারের নিচে নেমে আসে। এ অবস্থায় ক্যাব শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের পক্ষে আর্থিক সংকটের মধ্যেও এই পেশা ছেড়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি
এ সম্পর্কিত এক বিবৃতিতে নিউইয়র্ক নগরের কম্পট্রোলার ও ২০২১ সালে মেয়রপ্রার্থী স্কট স্ট্রিংগার নিউইয়র্ক পোস্টকে বলেন, ‘ক্যাবচালকদের ঋণের পরিমাণ কমানো ও করদাতাদের অর্থের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতে ট্যাক্সি ওয়ার্কার্স অ্যালায়েন্সের দেওয়া প্রস্তাবটি বেশ দায়িত্বশীল। আমাদের এই পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। একই সঙ্গে উচিত কাজে নেমে পড়া।’
ক্যাব শিল্পে বছরের পর বছর ধরে হওয়া অনিয়মের প্রেক্ষাপটে গত ফেব্রুয়ারিতে নগর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ৮১ কোটি ডলারের মামলা করেন নিউইয়র্ক নগরের অ্যাটর্নি জেনারেল ল্যাটিসিয়া জেমস। ওই মামলায় তিনি অভিযোগ আনেন, ২০০৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রতারণার মাধ্যমে ট্যাক্সি মেডালিয়নের দাম বাড়ানো হয়েছে।
এ নিয়ে গত ১৮ নভেম্বর দেওয়া বিবৃতিতে ল্যাটিসিয়া জেমস বলেন, ভৈরবী দেশাই উপস্থাপিত পরিকল্পনাটি গ্রহণ করা হলে তিনি তাঁর করা মামলাটি প্রত্যাহার করে নেবেন।
এক সময় যে ট্যাক্সি মেডালিয়নের দাম ছিল ১০ লাখ ডলারের বেশি, তার দাম কমতে কমতে এক সময় ২ লাখ ডলারের নিচে নেমে আসে। এ অবস্থায় ক্যাব শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের পক্ষে আর্থিক সংকটের মধ্যেও এই পেশা ছেড়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। অনেকের অবস্থা এতটাই সঙিন হয়ে পড়ে যে, মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে অন্তত নয়জন ক্যাবি আত্মহত্যা করেন। এই প্রসঙ্গের কথা উল্লেখ করে ল্যাটিসিয়া জেমস বলেন, ‘আমি মনে করি, আমাদের অতিসত্বর এই পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত।’
এই বাজারের অন্যতম প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান কানেকটিকাটের গ্রিনউইচের মার্বেলগেট অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট। এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় রয়েছে চার হাজারের বেশি ক্যাব। এই বছরের শুরুর দিকে প্রতিটি গড়ে ১ লাখ ১০ হাজার ডলার মূল্যে ৩ হাজার ম্যাডালিয়ন কেনে
এদিকে ক্যাব শিল্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিকল্পনায় ক্যাবচালকদের স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও বেসরকারি ঋণদাতাদের বিষয়টির দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। গত মার্চে প্রস্তাবিত এই পরিকল্পনা গৃহীত হলে ক্যাবিদের সম্মিলিত ঋণের পরিমাণ ৫০ কোটি ডলার থেকে নেমে ৭ কোটি ৫০ লাখ ডলারে আসবে। এতে ক্যাবচালকেরা ভীষণ উপকৃত হলেও বিপদে পড়বেন ঋণদাতারা।
নিউইয়র্ক পোস্টের তথ্যমতে, এই বাজারের অন্যতম প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান কানেকটিকাটের গ্রিনউইচের মার্বেলগেট অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট। এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় রয়েছে চার হাজারের বেশি ক্যাব। এই বছরের শুরুর দিকে প্রতিটি গড়ে ১ লাখ ১০ হাজার ডলার মূল্যে ৩ হাজার ম্যাডালিয়ন কেনে। এ বিষয়ে এর চেয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
পরিকল্পনাটির বিষয়ে মেডালিয়ন মালিক সার্জিও ক্যাবরেরা বলেন, ‘দেশাইয়ের ভুললে চলবে না যে, এই খেলায় মার্বেলগেটের মতো অনেক বড় খেলোয়াড় আছে। মার্বেলগেট কেন এমন কোনো পরিকল্পনায় সম্মত হবে। পরিকল্পনাটিকে সবার কথা মাথায় রেখে করতে হবে।’
এ বিষয়ে অবশ্য কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি মার্বেলগেট। তবে তারা জানিয়েছে, এই মহামারির সময়ে তারা ক্যাবিদের জন্য অনেক কিছু করেছে। এখন পর্যন্ত তারা কাজে বের হতে না পারা মেডালিয়ন মালিকদের সহায়তায় ৭ কোটি ডলার ব্যয় করেছে। তবে মার্বেলগেটের এই ভাষ্যের সঙ্গে একমত নন সার্জিও ক্যাবরেরা। তাঁর মতে, ‘মার্বেলগেটের সহায়তা ছিল লোক দেখানো।’
সার্জিও ক্যাবরেরার মতের সঙ্গে অনেক বিশেষজ্ঞও একমত। তাঁরা মনে করেন, মার্বেলগেটের তো প্রতিষ্ঠানগুলোকে এড়িয়ে ক্যাবশিল্পে বড় কিছু করা যাবে না। এ বিষয়ে ঈগল আলফার প্রধান পরামর্শক ডিন বার বলেন, ‘যেনতেন একটি পদক্ষেপ নেওয়া খুবই হঠকারী হবে। এভাবে কোনো দিকে না তাকিয়ে মেডালিয়নের নতুন দাম নির্ধারণ করা হলে পুরো বাজারে ধস নামবে। এভাবে হঠাৎ করে ১ লাখ ২৫ হাজার ডলার দাম নির্ধারণ করলে বিনিয়োগকারীরা বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। এতে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেখা যাবে, মেডালিয়ন কেনার জন্য কেউ আর ঋণ দিচ্ছে না।’
আলোচনায় রয়েছে আরেকটি পরিকল্পনা, যার নাম ‘মেডালিয়ন অ্যাসেট রিলিফ প্রোগ্রাম’। গত মে মাসে ব্রঙ্কসের কাউন্সিলম্যান ও নবনির্বাচিত কংগ্রেসমেন রিচি টোরেস পরিকল্পনাটি প্রস্তাব করেন, যেখানে মেডালিয়ানের দাম আড়াই লাখ ডলারের মধ্যে নিয়ে আসতে ঋণদাতা, ক্যাবচালকসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনার কথা বলা হয়েছে। এই প্রস্তাবে ঋণ পরিশোধে মাসিক কিস্তির পরিমাণ ১ হাজার ১০০ ডলারের মধ্যে রাখার কথা বলা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই প্রস্তাবটির প্রতি মার্বেলগেটসহ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি আগ্রহ দেখাবে।