যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের এল পাসো ও ওহাইওর ডেটনে ১৩ ঘণ্টার ব্যবধানে পরপর দুটি নির্বিচার গুলিবর্ষণে বেশ কয়েকজন হতাহত হওয়ার ঘটনায় দেশটির রাজনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গত শনিবার মেক্সিকান-অধ্যুষিত এল পাসোতে একজন শ্বেতকায় যুবকের হাতে কমপক্ষে নয়জন মেক্সিকানের মৃত্যুর পর সমালোচনার আঙুল উঠেছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দিকে। গত তিন বছর তিনি অনবরত অভিবাসী, বিশেষত মেক্সিকো থেকে আগত অভিবাসীদের প্রতি যে ভাষায় আক্রমণ করেছেন, অনেকে এই ঘটনার পেছনে সেই উসকানি কাজ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
গতকাল সোমবার হোয়াইট হাউসে তড়িঘড়ি করে ডাকা এক অনুষ্ঠানে ট্রাম্প ঘোষণা করেন, দেশের মানুষকে বর্ণবাদ, বর্ণবিদ্বেষ ও শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদের বিরুদ্ধে সমস্বরে নিন্দা জানাতে হবে। এল পাসোর হত্যাকাণ্ডে জড়িত শ্বেতকায় যুবকটি অভিবাসনবিরোধী ইশতেহার প্রকাশ করে। ট্রাম্প এর নিন্দা করে বলেন, ঘৃণা বিকৃতির জন্ম দেয়, হৃদয়কে রক্তাক্ত করে এবং আত্মাকে হনন করে।
১০ মিনিট স্থায়ী এই বিবৃতিতে ট্রাম্প এল পাসো ও ডেটনের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের জন্য ভিডিও গেমস ও মানসিক বৈকল্যকে দায়ী করেন। তবে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে তিনি একটি কথাও বলেননি। এই বিবৃতি পাঠের আগে পাঠানো এক টুইটে তিনি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড চেকের’ কথা প্রস্তাব করেছিলেন।
হোয়াইট হাউস থেকে জানানো হয়েছে, কাল বুধবার ট্রাম্প তাঁর সমবেদনা প্রকাশ করতে এল পাসো সফরে আসবেন। এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এল পাসো থেকে নির্বাচিত ডেমোক্রেটিক কংগ্রেস সদস্য ভেরোনিকা এসকোবার বলেছেন, ট্রাম্প এই শহরে আসুন, তা তাঁরা চান না। ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ও এল পাসোর সাবেক কংগ্রেস সদস্য বেটো ও’রুরকও একই কথা বলেছেন।
এল পাসোর ঘটনার পেছনে ট্রাম্প-অনুপ্রাণিত বর্ণবিদ্বেষ কাজ করেছে—এই অভিযোগে অধিকাংশ ডেমোক্র্যাট নেতা প্রেসিডেন্টের বক্তব্য পর্যাপ্ত নয় বলে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, এ ঘটনার জন্য ট্রাম্প নিজ দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তাঁদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। এক বিবৃতিতে তিনি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দেশের মানুষকে বিভক্ত করার রাজনীতির বিরুদ্ধে সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন।
ওবামা বলেন, ‘ভীতি ও ঘৃণার আবহ সৃষ্টিতে সাহায্য করে অথবা বর্ণবাদী মনোভাবকে স্বাভাবিক বলে প্রতিপন্ন করে—যেকোনো নেতার এমন বক্তব্য সর্বতোভাবে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।’ দেখতে ভিন্ন মানুষ বা অভিবাসীকে নগ্নভাবে আক্রমণ করে—তেমন নেতাদের ব্যাপারে ওবামা কঠোর সমালোচনা করেন।
ওবামা বলেন, ‘আমাদের রাজনীতি ও নাগরিক জীবনে এমন ভাষার কোনো স্থান নেই, এখন এ কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলার সময় এসেছে।’
ট্রাম্পের নাম একবারের জন্য উচ্চারিত না হলেও এ কথা যে তাঁর উদ্দেশেই বলা, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক কায়দায় আগ্নেয়াস্ত্রের মাধ্যমে নির্বিচার গুলিবর্ষণের ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে পড়েছে। একটি হিসাবে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের পর থেকে চারজনের অধিক মানুষ নিহত হয়েছে—এমন গুলিবর্ষণের ঘটনা প্রতি ৪৭ দিন অন্তর ঘটে চলছে। তা সত্ত্বেও ‘প্রার্থনা ও সমবেদনা’ ছাড়া রিপাবলিকান আইনপ্রণেতারা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছেন। নির্বাচিত হওয়ার পরপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড চেক’ ও অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছিলেন। পরে গান লবি (অস্ত্রের পক্ষে ওকালতি করা গোষ্ঠী) ও রিপাবলিকান নেতৃত্বের চাপে সেই পথ থেকে সরে আসেন।
এবারেও সেই একই নাটকের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বলে ডেমোক্র্যাটরা অভিযোগ করেছেন। ডেমোক্রেটিক নিয়ন্ত্রিত প্রতিনিধি পরিষদ এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ব্যাকগ্রাউন্ড চেকের ব্যবস্থাসংবলিত দুটি খসড়া আইন পাস করে, কিন্তু সিনেটে প্রস্তাব দুটির একটিও বিবেচনার জন্য উত্থাপিত হয়নি। সিনেটে রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাককনেল এ নিয়ে আলোচনায় কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। ডেমোক্র্যাটরা অভিযোগ করেছেন, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে ট্রাম্পের কোনো আগ্রহ থাকলে তিনি অনায়াসে রিপাবলিকানদের ওপর এই প্রস্তাব গ্রহণের ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করতে পারতেন।
কংগ্রেসের উভয় কক্ষই এখন অবকাশে। স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটি বিবেচনার জন্য অবিলম্বে সিনেট অধিবেশন পুনরায় আরম্ভের দাবি করেছেন। চারদিকে যেভাবে সমালোচনা ঝড় উঠেছে, তাতে সিনেট নেতা মিচ ম্যাককনেলকেও নড়েচড়ে বসতে হচ্ছে। একজন মুখপাত্রের মাধ্যমে তিনি জানিয়েছেন, সিনেটে রিপাবলিকানরা তাঁদের করণীয় দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত। তবে ঠিক কী করণীয় বলে তিনি বিবেচনা করেন, সে কথা অবশ্য তিনি খোলাসা করেননি।