কোভিড-১৯ সংক্রমণে বিশ্বে শীর্ষে থাকা দেশ যুক্তরাষ্ট্রে টিকা নেওয়ায় অন্যদের চেয়ে এগিয়ে আছেন শ্বেতাঙ্গরা। টিকাদানের ক্ষেত্রে সবার সমান সুযোগ থাকার পরও কৃষ্ণাঙ্গ ও অন্যান্য জনগোষ্ঠী টিকা গ্রহণে পিছিয়ে থাকা নিয়ে রীতিমতো উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ১৭টি রাজ্যে টিকা গ্রহণের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য জানিয়েছে একাধিক মার্কিন সংবাদপত্র। ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দেওয়া করোনা টিকার তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গ ও অন্যান্য গাত্রবর্ণের লোকজনের টিকা গ্রহণ আশঙ্কাজনকভাবে কম।
এমন অবস্থা চলতে থাকলে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ দুরূহ হয়ে উঠবে বলে বলা হচ্ছে। শুধু সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যেই নয়, কৃষ্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যকর্মীসহ করোনাকালের সম্মুখসারির কর্মীদের মধ্যে যাঁরা টিকাপ্রাপ্তির অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছেন, তাঁদেরও এটি গ্রহণের হার শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কম। উদাহরণ হিসেবে, নর্থ ক্যারোলাইনার জনগোষ্ঠীর ২২ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ। আর রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্মীর ২৬ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ। অথচ রাজ্যের মাত্র ১১ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ টিকা নিয়েছেন। বিপরীতে রাজ্যের ৬৮ শতাংশ হিসপ্যানিক ও নন–হিসপ্যানিক শ্বেতাঙ্গদের ৮২ শতাংশই টিকা গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে করোনার সংক্রমণে। আগামী দুই মাসে আরও ২ লাখ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কার কথা জানা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত মোট মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (সিডিসি) বলেছে, শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর চেয়ে তিন গুণ বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে অন্যান্য গাত্রবর্ণের লোকজনের।
নিউইয়র্কের ‘অ্যাডভান্সিং হেলথ ইকুইটি’ নামের সংস্থার প্রধান নির্বাহী উচে ব্ল্যাকস্টোক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিরাজমান অসাম্য ও অসংগতির বিষয় টিকা গ্রহণে কৃষ্ণাঙ্গদের পিছিয়ে থাকায় প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে।
যেসব কারণে এ ঘটনা ঘটছে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা এখন আলোচনা শুরু করেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যকাঠামো নিয়ে ঐতিহ্যগতভাবে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে গভীর অবিশ্বাস বিরাজমান। এই জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক বিষয়ে বৈষম্যের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া কৃষ্ণাঙ্গবহুল এলাকায় টিকা প্রদান কেন্দ্রে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রবেশে সীমাবদ্ধতার কথা নিয়েও কথা উঠেছে। টিকা গ্রহণের জন্য নাম তালিকাভুক্ত করাসহ তথ্য বিনিময়ের বেশির ভাগই হচ্ছে অনলাইনে। প্রযুক্তিগত প্রবেশাধিকারেও কৃষ্ণাঙ্গরা শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর চেয়ে পিছিয়ে থাকাকেও একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে করোনার সংক্রমণে। আগামী দুই মাসে আরও ২ লাখ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কার কথা জানা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত মোট মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (সিডিসি) বলেছে, শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর চেয়ে তিন গুণ বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে অন্যান্য গাত্রবর্ণের লোকজনের।
টেনেসি রাজ্যের টিকা কর্মসূচি পরিচালনা করছেন মাইকেল ফিসকাস। তিনি বলেছেন, রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করা হলেও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অনাস্থা তাঁদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। কৃষ্ণাঙ্গ লোকজন টিকা গ্রহণে এগিয়ে আসছেন না। এই কঠিন সমস্যা মোকাবিলার উপায় বের করার তাগিদ দেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ লোকজন ব্যাপকভাবে সংক্রমণের শিকার হচ্ছেন, হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন এবং করোনা জটিলতায় মারা যাচ্ছেন। এরপরও টিকা গ্রহণে তাঁদের অনীহা বা আস্থার সংকট বিশেষজ্ঞদের ভাবিয়ে তুলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে হিসপ্যানিক লোকজনের মধ্যে টিকা গ্রহণের হার কৃষ্ণাঙ্গদের চেয়ে বেশি। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেশির ভাগ হিসপ্যানিক মানুষ কম বয়সী। এখন পর্যন্ত টিকা প্রদানে অল্প বয়সীদের হিসাবে ধরা হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে। নিউইয়র্কেও দেখা গেছে টিকা গ্রহণের জন্য কেন্দ্র খোলা হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ ও হিসপ্যানিক প্রধান এলাকায়। অথচ টিকা গ্রহণে এগিয়ে রয়েছে শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী।
ভিন্ন একটি কারণেও এমন ঘটনা ঘটছে বলে মনে করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে ৬৫ ঊর্ধ্ব অধিকাংশ মানুষ শ্বেতাঙ্গ। ফলে প্রথম দফার টিকা প্রদানে শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে এটি গ্রহণের হার বেশি দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে টিকা প্রদানে বিভিন্ন রাজ্যে বয়স্ক মানুষ ছাড়াও সম্মুখসারির কর্মীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি উন্মুক্ত করা হয়েছে।
টেনেসি রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করা হলেও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অনাস্থা তাঁদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। কৃষ্ণাঙ্গ লোকজন টিকা গ্রহণে এগিয়ে আসছেন না।
টিকা গ্রহণের জন্য পরিচয়পত্র দেখিয়ে নাম তালিকাভুক্ত করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন বাস্তবতার সঙ্গে বেশ কিছু সম্প্রদায়ের টিকা গ্রহণের যোগসূত্র থাকতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। নথিপত্রহীন অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়নের ভয়ে কোনো সরকারি পর্যায়ে নিজের নাম তালিকাভুক্ত করতে সংশয়ে থাকার সংগত কারণ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, টিকা প্রদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বেশি করে কৃষ্ণাঙ্গ ও অন্যান্য কমিউনিটির লোকজনকে নিয়োগ দিতে হবে। করোনায় পরিবারের সদস্যের মৃত্যু হয়েছে এমন কৃষ্ণাঙ্গ লোকজনেরও টিকা গ্রহণে অনীহা দেখা যাচ্ছে। সংক্রমণ মোকাবিলা করতে হলে জনগণের সর্বস্তরে টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এটি না পারলে পরিস্থিতি স্বভাবিক হওয়ার পর্যায়ে যাওয়ার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে। এর মধ্যে মৃত্যুর তালিকাও দীর্ঘ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দেশজুড়ে টিকা দ্রুত সরবরাহ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। বহু স্থানে লোকজন নিজের নাম তালিকাভুক্ত করেও টিকা গ্রহণের জন্য ডাক পাচ্ছেন না। মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে টিকার সরবরাহ বাড়বে বলে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। ফেডারেল সরকার থেকে টিকা সরবরাহ করা হলেও এখন পর্যন্ত রাজ্য সরকারগুলোই প্রতিটি রাজ্যে টিকা প্রদানের বিষয়টি পরিচালনা করছে।