যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্বেষমূলক অপরাধ বাড়ছে

যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্বেষমূলক অপরাধের ঘটনা বেড়ে চলেছে। সদ্য প্রকাশিত সরকারি তথ্যে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে গত এক যুগের মধ্যে বিদ্বেষমূলক অপরাধের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে গত বছর। বিদ্বেষমূলক আচরণ দণ্ডযোগ্য অপরাধ হলেও ক্রমশ এসব ঘটনা বেড়ে যাওয়া নিয়ে রীতিমতো উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।

মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৭ হাজার ৭৫৯টি বিদ্বেষমূলক অপরাধের ঘটনা ঘটেছে বলে তথ্য প্রকাশ করেছে। চলতি সপ্তাহে এ প্রকাশিত তথ্যে গত ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিদ্বেষমূলক ঘটনার হিসাব দেওয়া হয়েছে।

বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, প্রকৃত বিদ্বেষমূলক ঘটনা প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছোটখাটো ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট করা হয় না। এ কারণে এসব ঘটনা জাতীয় হিসাব থেকে বাদ পড়ে যায়।

সংজ্ঞা অনুযায়ী, জাতি, ধর্ম, বিশ্বাস, শারীরিক অক্ষমতা, লিঙ্গ পরিচয়, গাত্রবর্ণ ইত্যাদি নিয়ে অন্যকে হেয় করা বা হামলা করাকে বিদ্বেষমূলক অপরাধ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। ২০২০ সালের আগে এফবিআইয়ের তালিকায় ২০০৮ সালে সর্বোচ্চ এমন ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছিল। তথ্য থেকে দেখা গেছে, ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৭ হাজার ৭৮৩টি বিদ্বেষমূলক অপরাধের ঘটনা ঘটে।

যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্বেষমূলক অপরাধের ৬৪ শতাংশই জাতি, বংশ বা ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করার মধ্য দিয়ে ঘটেছে বলে এফবিআই জানিয়েছে। সংগঠিত ঘটনার গড়ে ৩টির মধ্যে দুটি ঘটনাই ঘটে জাতিগত বৈষম্যের কারণে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৩৬ শতাংশ বিদ্বেষমূলক ঘটনা ঘটেছে কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে, তাদের গাত্রবর্ণের কারণে। প্রায় ১০ শতাংশ বিদ্বেষের ঘটনা ঘটেছে শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে এবং ইহুদিদের বিরুদ্ধে ঘটেছে ৯ শতাংশ বিদ্বেষের ঘটনা।

যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রায়ই বিদ্বেষমূলক ঘটনা ঘটলেও সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যে এ বিষয়টিকে আলাদা করে উল্লেখ করা হয়নি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক ঘটনার হার ৮ শতাংশের কাছাকাছি হতে পারে। সবগুলো ঘটনা সঠিকভাবে রিপোর্ট না হওয়ার কারণেও এ নিয়ে পুরো তথ্য, প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে ভিন্ন বলে অনেকেই মনে করেন।

* ২০২০ সালে ৭ হাজার ৭৫৯টি বিদ্বেষমূলক অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। গত এক যুগের মধ্যে বিদ্বেষমূলক অপরাধের ঘটনা এটাই সবচেয়ে বেশি। * ২০০৮ সালে সর্বোচ্চ বিদ্বেষমূলক অপরাধের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছিল। ওই বছর যুক্তরাষ্ট্রে ৭ হাজার ৭৮৩টি অপরাধের ঘটনা ঘটে।

অ্যান্টি ডিফেমেশন লিগ নামক সংস্থার প্রধান নির্বাহী জনাথন গ্রিনব্লাট বলেছেন, যখন মাত্র একজন লোকও বিদ্বেষমূলক অপরাধের শিকার হয়, তখন পুরো জনসমাজ আক্রান্ত হয়। একজন লোকের ওপর বিদ্বেষমূলক আক্রমণের কারণে আক্রান্ত লোকটির সঙ্গে সম্পৃক্ত জনসমাজ নিজেকে সমাজে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে।

জনাথন গ্রিনব্লাট এফবিআই কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ১৫ হাজারের বেশি স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিদ্বেষমূলক অপরাধের ঘটনা কেন্দ্রীয়ভাবে রিপোর্ট করেছে। এসব রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, বহু এলাকায় এক লাখের বেশি লোকজনের বসবাস থাকলেও এমন কোনো ঘটনা কেন্দ্রীয়ভাবে রিপোর্ট করা হয়নি। তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রকৃত বিদ্বেষমূলক ঘটনা প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি হবে।

২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মিনিয়াপোলিস রাজ্যে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েড নিহত হন শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে। এমন বড় ঘটনার জের ধরে দেশজুড়ে নাগরিক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। মার্কিন সমাজে বৈষম্য ও ঘাপটি মেরে থাকা বিদ্বেষ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনগণ রাজপথে নেমে আসে। এ আন্দোলনের জের ধরে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সভা-সমাবেশ হয়েছে।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জঙ্গি বিমান হামলার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে মুসলিমদের ওপর হামলার ঘটনা ক্রমশ বেড়েছে। আফগানিস্তান, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্য টানা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণেও যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে মুসলিম বিরোধী মনোভাব উসকে ওঠে।

২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম বিরোধী মনোভাব চাঙা হয়ে ওঠে। ট্রাম্প তাঁর অভিবাসন নীতিসহ নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে এ বিদ্বেষকে উসকে দিয়েছেন পুরো চার বছর। সর্বশেষ মহামারি করোনাকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘চায়না ভাইরাস’ বলে বারবার উল্লেখ করায় যুক্তরাষ্ট্রে এশীয় লোকজন বিদ্বেষমূলক হামলায় পড়েছেন। চীনসহ দেখতে একই আদলের লোকজনকে এখনো এমন বিদ্বেষমূলক অপরাধের শিকার হওয়ার ভয়ে থাকতে হচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পর বিদ্বেষ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিজেদের কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। যে মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে মহান দেশ হিসেবে পরিচিত, বিদ্বেষ বৈষম্য যুক্তরাষ্ট্রের সে মাহাত্ম্যকে বারবার ম্লান করছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার অন্যতম উপাদান হয়ে উঠেছে বিদ্বেষ বৈষম্যের ঘটনা। উদারনৈতিক মার্কিন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এ অস্থিরতা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় খুঁজতে হচ্ছে।