রুথ বডের গিন্সবার্গ
ওয়াশিংটন রিগ্যান বিমান বন্দর থেকে এসেছে ৪ আগস্ট বিকেলের আগমনী ফ্লাইট। তিনজন এজেন্ট পেছনের দরজা দিয়ে নেমে আসা যাত্রীদের অভ্যর্থনায় রানওয়েতে নেমে গেলাম। দেখি একটা নীল সাদা পুলিশের গাড়ি ও দুটি পাজেরো কালো গাড়ি। কালো স্যুট পরা এক কৃষ্ণাঙ্গ ভদ্রলোক নেমে এলেন। পাশে ইউনিফর্ম পরা শ্বেতাঙ্গ পুলিশ। র্যাম্পের কর্মী এয়ারক্র্যাফটের দরজা খুলে দিলেন। আমি সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে, যাত্রীরা নেমে আসছেন। উনি তাঁদের সঙ্গে মিশে গেলেন। রানওয়েতে সাধারণত পুলিশের গাড়ি আসে আসামি ধরতে বা বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকলে। যেমন ইঞ্জিন বন্ধ করার মুহূর্তে বিধ্বস্ত হওয়ার মতো কোনো লক্ষণ থাকলে। ফ্লাইট আসার আগেই ফায়ার ব্রিগেড, পুলিশ এসে প্রস্তুত থাকেন। আজ মনে হচ্ছে কোনো নাম করা ডনকে পাকড়াও করবেন!
চারদিকে ভয়ংকর পরিস্থিতি। এদিকে এক উড়োজাহাজ ঘোরে তো আরেকটা বের হয়! কানে এয়ার প্ল্যাক লাগানো থাকলেও শব্দ দূষণ আছে। ভিআইপি কেউ একজন ফ্লাইটে আছেন জানি। তাদের অভ্যর্থনার জন্য স্বয়ং ম্যানেজার থাকেন রেডিও হাতে প্রতি মুহূর্তে যোগাযোগ থাকে। ভিআইপি এদিকে আসতে পারেন এটা আমার মাথায় একদম নেই। ধরেই নিয়েছি বড় ধরনের কোনো আসামিকে ধরতে সিভিল ড্রেসে অফিসার যাত্রীদের মধ্যে মিশে গেছেন। দেখি উনি ফ্লাইটের জেট ব্রিজের সঙ্গে থাকা সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন। একজন র্যাম্প ম্যানেজার সঙ্গে আছেন। সিনেমাটিক কিছু হবে কি? এটা আমরা কর্মীদের জন্য,তবে পোর্ট অথোরিটি পুলিশের সর্বত্র অ্যাকসেস আছে।
কৌতূহল ভুলে নিজের কাজে মনোনিবেশ করলাম। এর মধ্যে মোটামুটি সব যাত্রী নেমে গেছেন। ঘুরে দেখি শেষ যাত্রী এক মেয়ে মোবাইল ধরে সেলফির জন্য বলছে। সেই ভদ্রলোক ইশারায় না করে দিলেন। সঙ্গে নেমে আসলেন মধ্য বয়সের এক সুপুরুষ। ফরসা সুন্দর চেহারা মাথা ভরা কালো চুল। হাতে স্যুটের ব্যাগ এবং অন্য হাতে একটা ব্যাগ। ভাবলাম উনি বুঝি সেই মহান ব্যক্তি! কিন্তু না তিনি নিজে তটস্থ, এগুলো রেখে আবার ঘুরে গিয়ে নিজের হাতে ধরে নিয়ে এলেন, বয়স্ক শীর্ণকায় একজন ভদ্র নারীকে। ততক্ষণে আমি চলে এসেছি। দেখে মনে হচ্ছিল নিজের ছেলে মাকে আগলে নিয়ে আসছেন। তবে ছেলে নয় তিনি এই মহিমান্বিত নারীর দেহরক্ষী। গাড়ি আমার পাশেই ছিল। তাঁর গায়ে পাতলা পশমি চাদরের মতো কম্বলটা পড়ে যাচ্ছিল, ভদ্রলোক ইশারা করতেই আমি ধরে গায়ে জড়িয়ে দিলাম। কাছে থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখলাম এবং ভাবলাম একেই বলে ক্ষমতা! কে তিনি? পরে জানলাম এই মহীয়সী নারী আর কেউ নয়, তিনি হচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি রুথ বডের গিন্সবার্গ।
সহকর্মী ক্ল্যারিবেল ছিলেন এ পাশে। তিনি বললেন, পাবলিক আটকায় কে? যারা চিনতে পেরেছে তারা হাঁটতে হাঁটতে ঠিকই ছবি নিয়ে নিয়েছেন। জিজ্ঞেস করলাম কে তিনি? ক্ল্যারি পরিচয় দিলেন এবং গুগল ঘেঁটে ছবি দেখালেন। দেখলাম, পড়া শুরু করলাম। যতই পড়ি ততই মুগ্ধ হই। চলতি বছর ২২ জানুয়ারি রুথ বডের গিন্সবার্গের জীবন নিয়ে নির্মিত একটি চলচ্চিত্র ‘আরবিজি’ সেরা ডকুমেন্টে অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। তিনি এখন বয়সে ও অসুখে কাবু। তাই এই বিশেষ ব্যবস্থায় তাঁকে উড়োজাহাজ থেকে নামানো হয়েছে। দুইবার ক্যানসার থেকে সংগ্রাম করে বেঁচে উঠেছেন। উনি শুধু ক্ষমতাবান নন মানুষকে বেঁচে থাকার প্রেরণাদাতাও বটে। আমি যখন ইউটিউবে তাঁর মুভির ট্রেলার দেখতে ক্লিক করলাম, দেখি বাস্তবের উনি ৮০ বছর বয়সেও পুশআপ করছেন। কতটা প্রাণশক্তি থাকলে নিজেকে এমন করে শান দেওয়া যায়!
রুথ বডের গিন্সবার্গ আমেরিকান রক আইকনিক। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের জন্য ফিটনেস প্রভাবক। এলজিবিটিকিউ অধিকারের আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্টের সেবাদানকারী তিনিই দ্বিতীয় নারী হিসেবে পরিচিত। এ দেশে নারীদের আজকের অবস্থানে আসার পেছনে রয়েছে রুথের বিশেষ অবদান। ছাত্রাবস্থায় লক্ষ্য করেন বিস্তর লিঙ্গবৈষম্য। জার্নাল ঘেঁটে ছবি দেখেন, সব বড় বড় পদগুলো পুরুষের দখলে। কোনো চেয়ারে নারী নেই। নারীরা নিয়োজিত সেলাই, সাফাই নিম্নস্তরের পদে। কলম্বিয়া ল’ স্কুলে পড়াকালীন তিনি চিন্তা করেন এ নিয়ম পাল্টে দেবেন। বিচারপতিদের বসার শূন্য চেয়ারগুলোর দিকে তাকিয়ে তিনি মনে মনে কি সংকল্প করেছিলেন? তাঁর সেই সংকল্পই বাস্তবে পরিণত হয়েছে। আমার আবারও বলতে ইচ্ছে করছে, ‘আমরাই আমাদের ভাগ্য লিখি’। আজকের নারীর ক্ষমতায়নে তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। তাঁর এ ক্ষমতা আর সম্মান দেখে ভাবলাম, কেন সবাই শুধু ডাক্তার, প্রকৌশলীর হতে চায়? এই যে কত সম্মানজনক পদ পড়ে আছে, এগুলো কেন স্বপ্ন হয় না?
ব্রুকলিন, এনওয়াই, নেটিভ কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক এবং কলম্বিয়া ল’ স্কুল থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর হার্ভার্ডের আইন স্কুলে যান রুথ বডের গিন্সবার্গ। তিনি আইন ক্লার্ক শিপ গ্রহণ করেছিলেন, রুটজার এবং কলম্বিয়া উভয় ক্ষেত্রেই আইন শিখিয়েছিলেন। এসিএলইউর জেনারেল কাউন্সেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তাঁকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
শুধু পেশাগত নয় ব্যক্তি জীবনেও একজন সফল মানুষ রুথ বডের গিন্সবার্গ। সাফল্যের জন্য তিনি স্বামী মার্টিন গিন্সবার্গের কথা বলেন। ছয় যুগের ভালোবাসার বন্ধন ছিন্ন করে ২০১০ সালে তাঁর স্বামীর মৃত্যু হয়। তাঁদের দুই সন্তান আছে। ৮৬ বছর বছর বয়সী রুথ গিন্সবার্গ ৫ ফুট লম্বা, ১০০ পাউন্ড ফ্রেমে প্যাক করা এক রক স্টার। তাঁর জন্ম তারিখ ১৫ মার্চ, ১৯৩৩। মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৪ মিলিয়ন ডলার।