আত্মার সঙ্গে আলাপচারিতা

হাসপাতালে সহকর্মীদের সঙ্গে লেখক
হাসপাতালে সহকর্মীদের সঙ্গে লেখক

ব্যাপারটা আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকছিল। ভদ্রমহিলা খুবই পরিপাটি হয়ে বসে আছেন। গলার স্বরও বেশ নামানো। কথা বলছেন অনেকটা ফিসফিস করে। শুনতে আমার কষ্ট হচ্ছিল তাই চেয়ারটা একটু এগিয়ে নিয়ে এলাম। মনে হচ্ছিল ইচ্ছে করেই তিনি গলার স্বর নামিয়ে রেখেছেন।

মিস ক্যারোল স্মিথকে দেখার জন্য পুলিশ আমাদের (সাইকিয়াট্রিক টিম) সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এই সকালে। ৩২ বছরের ক্যরোলের ব্যাপারে পুলিশের কাছে তাঁর প্রতিবেশীরা রিপোর্ট করেছে যে, সে নাকি গত রাতে তাঁর বাসার সঙ্গে লাগানো ছোট বাগানে কাঠ আর পাতা দিয়ে আগুন জ্বালাচ্ছিল। ব্যাপারটা পুরোপুরি অস্বাভাবিক। সাগর তীরের ইংল্যান্ডের যে ছোট শহরের কথা আমি বলছি, সেখানে কেউ তার বাগানে বা বাসায় রাতে আগুন জ্বালাবে তা খুবই অস্বাভাবিক ঘটনা। প্রতিবেশীরা পুলিশকে ফোন করে তাদের উদ্বেগের কথা বলেছেন। পুলিশ ক্যারোলের বাসায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে। বোঝার চেষ্টা করেছে কেন ক্যারোল রাতের বেলা বাসার বাইরে আগুন জ্বালাচ্ছিল।
পুলিশ এ ভদ্রমহিলার কাছ থেকে কিছুই উদ্ধার করতে পারেনি। নিয়ে আসা হয়েছে তাকে হাসপাতাল ইমার্জেন্সিতে। অস্বাভাবিক আচরণের অভিযোগে তাঁকে দেখার জন্য খুবই যুক্তিসংগত কারণে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট ডাকা হয়েছে।
চেয়ারটা আরেকটু এগিয়ে নিয়ে এলাম। ক্যারোলকে ফ্যাকাশে লাগছিল। খুব কষ্টে দু–একটা কথা শুনলাম হয়তো। কিছুই বুঝতে পারছি না।
নার্সকে বললাম আমাকে সাহায্য করার জন্য। এবার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলো মনে হয়।
—তোমার নাম? ক্যারোলকে জিজ্ঞেস করলাম পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য।
—আমার কোনো নাম নেই। ফিসফিস করে বলল সে।
—তাই নাকি? তো কার সঙ্গে আমি কথা বলছি?
—ক্যারোলের আত্মার সঙ্গে। আত্মাদের নাম থাকতে নেই। আমারও কোনো নাম নেই।
—কেন বলছ আমি কথা বলছি আত্মার সঙ্গে? আমিতো একজন জীবন্ত মানুষ দেখছি। একি ক্যারোল নয়?
—ক্যারোল মারা গেছে অনেক আগে। ক্যারোল এখন মৃত। তুমি কথা বলছ মৃত ক্যারোলের আত্মার সঙ্গে।

ইমার্জেন্সি বিভাগের নার্সটা মনে হয় ভয় পেয়েই গেল।
কথা ঘোরানোর চেষ্টা করি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য।

—তোমার ঘুম কেমন?
—মৃত মানুষের ঘুম নেই। ওরা ঘুমায় না।
—খাওয়া দাওয়া?
—তুমি কিন্তু আমাকে প্রচণ্ড বিরক্ত করছ। আত্মারা কি খাওয়া দাওয়া করে?
কথা বলার স্টাইল বদলাতে হয় আমাকে।
—তো কখন তুমি মারা গেলে? কীভাবেই বা মারা গেলে? আমাকে কি জীবিত ক্যারোল মানে মারা যাওয়ার আগের ক্যারোল সম্পর্কে কিছু বলবে?

ব্রিটেনে টিভি ওয়ানে টক শো হ্যালো ডক্টরে লেখক
ব্রিটেনে টিভি ওয়ানে টক শো হ্যালো ডক্টরে লেখক

স্কুল টিচার ক্যারোল বাবা–মার একমাত্র সন্তান। সম্পর্কের চিড় ধরে কোনো এক কারণে। স্কটল্যান্ড থেকে সে চলে আসে ইংল্যান্ডে। চাকরি নেয় এখানের এক স্কুলে। সবকিছু ভালোই যাচ্ছিল তাঁর। মর্টগেজ করা নিজের বাসায় থাকে সে। স্থায়ী কোনো সম্পর্ক হয়নি কারও সঙ্গে। কাজ আর বাসা। আর সপ্তাহের ছুটির দিনে টুকটাক নাইট আউট। এই হলো তাঁর জীবন।
গত দুই সপ্তাহ ধরে সে স্কুলে যাচ্ছে না অনুমতি ছাড়াই। কারণ ঠিক দুই সপ্তাহ আগে সে মারা গেছে হঠাৎ করেই। মৃত লোকের স্কুলে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
গত তিন দিন ধরে সে প্রস্তুতি নিচ্ছে তার আত্মাকে শরীর থেকে মুক্ত করার। ক্যারোলের মনে হচ্ছে যে শরীরের ভেতর তার আত্মা এখন আটকা পড়ে আছে, তা থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। গতকাল রাতে সে বাগানে আগুন জ্বালাচ্ছিল তার শরীরকে পুড়িয়ে ফেলার জন্য। সে বেশ অনুতপ্ত যে, সে তার শরীর থেকে আত্মাকে মুক্ত করতে পারেনি।
মনে হলো ক্যারোল বেশ ক্লান্ত।
—চা অথবা কফি?
—আত্মা কি চা পান করে? প্রশ্ন ছুড়ে মারল সে আমার দিকে। নিজের বোকামির জন্য সত্যিই লজ্জা পেলাম।
আমার এখন জানা প্রয়োজন ক্যরোলের মতো এক তরুণীর হঠাৎ শরীর ছেড়ে আত্মা হয়ে ওঠার কাহিনি।

দুই.
ক্যারোলকে বেশ অন্যমনস্ক লাগে। গলার স্বর বারবার ওঠা নামা করতে থাকে। মনে হলো আমাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না।
ঘটনার শুরু প্রায় এক মাস আগে। স্কুল ইন্সপেকশন টিমের ভিজিট ছিল ক্যারোলের স্কুলে। স্কুলের বাদবাকি টিচারদের মতো ক্যারোলও মারাত্মক চাপের মুখে ছিল। স্ট্রেস সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে তাঁর জন্য।
স্কুল ভিজিটের পর থেকেই তাঁর মন খারাপ লাগা শুরু হয়। জীবনের অনেক কিছুই তাঁর আর ভালো লাগছিল না। শনিবার রাতের নাইট আউট ও তাঁর কাছে আকর্ষণ হারায়। সামান্য কিছু করলেই তাঁর খুব ক্লান্ত লাগছিল। মনে হচ্ছিল সে তখন বিষণ্নতায় ভুগছে। ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজনটা অবশ্য সে অনুভব করেনি।
জীবনটা কেন জানি ঝাপসা হয়ে ওঠে তাঁর কাছে। কিছুটা গুটিয়ে নেয় সে নিজেকে। বাসার ভেতরেই সময় কাটানো শুরু করে। স্কুলে গেলেও অন্য টিচারদের সঙ্গে সে খুব একটা কথাবার্তা বলছিল না।
এ পর্যন্ত কথা বলে ক্যারোল অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে আবার। যেহেতু আমি ক্যারোলের আত্মার (spirit) সঙ্গে কথা বলছি, খুব কষ্টে তাঁকে চা বা কফি অফার করার ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখি।
ইমার্জেন্সি বিভাগের নার্স (সাইকিয়ার্টি নার্স নয়) চোখ বড় বড় করে কথাগুলো শুনে যাচ্ছিলেন। তিনি হয়তো বা বুঝতে পারছিলেন না এ কাহিনি কোথায় গিয়ে শেষ হবে। ক্যারোল কিছু না খেলেও, নার্সকে দেখলাম ইতিমধ্যে এক গ্লাস পানি শেষ করে বসে আছে।
—ঠিক দুই সপ্তাহ আগে, ক্যারোল বলতে থাকে। এক রাতে আমি ঘুম থেকে উঠলাম।
—তারপর?
—ওনাকে আমি স্পষ্ট করে দেখতে পেলাম।
—ওনাকে মানে? কাকে দেখলে তুমি?
—অ্যাঞ্জেলকে।
—তার মানে তুমি একজন অ্যাঞ্জেল দেখলে যখন তুমি জেগে ছিলে?
—হ্যাঁ।
—ঘুমের মধ্যে ছিলে নাতো!
—প্রশ্নই ওঠে না। আমি তখন অবশ্যই জেগে ছিলাম। এ ঘটনা ঘটার পরপরই তা আমি ডায়েরিতে লিখে রাখি। ইচ্ছে করলে তুমি তা দেখতে পারো।
—ঠিক আছে। বলে যাও তুমি।
—উনি ধবধবে সাদা এক ড্রেস পরে আছেন। চেহারা থেকে দ্যুতি বেরোচ্ছিল। প্রথমে তিনি বাতাসের মধ্যে ভাসছিলেন। তারপর তিনি আমার বিছানায় বসলেন। ক্যারোল বলে যায় তার আত্মা হয়ে ওঠার কাহিনি।
অ্যাঞ্জেল তাকে বলল, ক্যারোল তোমার এখন মৃত্যু হলো। আমি হলাম মৃত্যুর দূত। তোমার এ পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। আমার সঙ্গে চলো।
ক্যারোল অবাক হয়ে তার কথা শুনতে থাকে। অ্যাঞ্জেলের কাছে সে নিজেকে খুবই অসহায় ভাবতে থাকে।
আমাকে কি সত্যি সত্যিই চলে যেতে হবে? আমার তো বয়স মাত্র বত্রিশ। এই বয়সেই আমাকে চলে যেতে হবে?
কেন কম বয়সে কি মানুষ মারা যায় না? তোমার চেয়ে কত কম বয়সের ছেলেমেয়েরা মারা যায়। তোমার কী এমন কাজ বাকি আছে যে তুমি আমার সঙ্গে যেতে চাও না?
ক্যারোল নীরব বসে থাকে। দেয়ালে ঝোলানো ভ্যানগগের তেলচিত্রের দিকে সে তাকিয়ে থাকে। টেবিলে রাখা বইপত্র আর ফাইলের দিকেও সে চোখ বোলায়। কিছু সাহস করে বলতে পারে না।

ব্রিটেনে টিভি চ্যানেল চ্যানেল এসএ–এর হেলথ টক অনুষ্ঠানে লেখখ
ব্রিটেনে টিভি চ্যানেল চ্যানেল এসএ–এর হেলথ টক অনুষ্ঠানে লেখখ

অ্যাঞ্জেল কথা বলে আবার—ঠিক আছে, তুমি এ পৃথিবীতে ক্যারোলের মৃত শরীরের ওপর ভর করে আত্মা হিসেবে ঘোরাফেরা করতে পারো কিছুদিন। কিন্তু তুমি এখন মৃত। তোমার সঙ্গে দেখা হবে অন্য কোথাও আবার। আত্মারা যা করে তুমি তাই করবে। কখনো যদি ভুল হয়, আমার সঙ্গে তোমার আবার দেখা বা কথা হবে। তোমাকে স্মরণ করিয়ে দেব যে তুমি এখন আর রক্তমাংসের মানুষ নও। তুমি এখন থেকে স্পিরিট বা আত্মা।
তারপর থেকেই ক্যারোলের ‘আত্মার’ সঙ্গে বসবাস। ভয়ে কাউকে সে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারে না। দু–একবার সে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রতিবারই সে শুনতে পায় অ্যাঞ্জেল তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ‘তুমি কিন্তু মানুষ নও আর, তুমি এখন আত্মা। যদি শর্ত ভঙ্গ করো, তোমাকে আমার সঙ্গে চলে আসতে হবে।
স্কুলে সে যাচ্ছে না, এ কথা বলার জন্য যেই সে ফোন হাতে নিয়েছে অমনি সেই গুরুগম্ভীর আওয়াজ—আত্মারা স্কুলে যায় না। তোমার ফোন করার প্রয়োজন নেই। ক্যারোল ফোন রেখে দেয় ভয়ে।
গত দুই সপ্তাহে সে অ্যাঞ্জেলকে দেখেছে আরও তিনবার। একবার রাস্তায় সে যখন হাঁটছিল পোস্ট অফিসে যাওয়ার জন্য। আরও দুবার সুপারমার্কেটে। তিনবার সরাসরি দেখা হলেও, সে তাঁর সঙ্গে কথা বলছে প্রায়ই। বলে দিচ্ছে কোনটা করতে হবে এবং কোনটা করতে হবে না।
অ্যাঞ্জেলের সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়ার পর ক্যারোল এখন নিশ্চিত যে সে এখন মৃত। তাঁর হার্ট কাজ করছে না, তাঁর ব্রেনও কাজ করছে না। সে অবশ্য স্বীকার করে যে তাঁর হাতের পালস (pulse) ফিল করা যায়, বুকে তাঁর প্যালপিটিশনও হচ্ছে। কিন্তু এসব তাঁর নয়, এগুলো হচ্ছে ক্যারোলের আত্মার।
গত কদিন ধরে সে টের পাচ্ছে যে তাঁর শরীর পচে যাচ্ছে। গন্ধ পাচ্ছে সে তাঁর পচা শরীরের। অ্যাঞ্জেলকে সে জিজ্ঞেস করেছে এ বিষয়ে।
এ শরীর নিয়ে আত্মা হয়ে তোমার ঘোরার মানে হয় না। তুমি তাঁকে পুড়িয়ে ফেলো। তারপর চলে আসো আত্মার জগতে যেখানে তুমি আমার মতো বিচরণ করতে পারো।
অ্যাঞ্জেল এ আদেশ দিয়েছে তিন দিন আগে। ক্যারোলের তাঁর কথাকে অবিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না।
তিন দিনের প্রস্তুতি শেষে গতরাতেই ক্যারোল চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসে যে, সে তাঁর শরীর থেকে আত্মাকে অবমুক্ত করবে নিজেকে আগুনে নিক্ষেপ করে। সে খুব সরি ফিল করছে, সে তাঁর মিশনে সফল হয়নি।
ক্যারোল এখন নিশ্চিত যে, সে মৃত এবং সে আত্মার জগতে চলে যেতে চায়। মৃত শরীর নিয়ে সে আর চলতে চায় না। সে বাসায় গিয়ে আবার চেষ্টা করবে আগুন জ্বালানোর এবং সে আগুনে সে তাঁর মৃতদেহকে ভস্মীভূত করার। তাহলেই তাঁর আত্মা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে।
সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে আমি তাঁর ইচ্ছের সঙ্গে একমত হই না। তাঁর হাসপাতালে আসা প্রয়োজন। ক্যারোল Severe Depressive Episode with Psychotic Symptoms বা Psychotic Depression রোগে ভুগছে। তার Depression ছাড়াও auditory, olfactory, visual hallucination এবং Nihilistic Delusion রয়েছে। আমি নিশ্চিত চিকিৎসার মাধ্যমে ক্যারোলের ‘আত্মাকে’ তার রক্তমাংসের শরীরে আবার আমরা ফিরিয়ে আনতে পারব।

*এ কাহিনি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া। Patient confidentiality issues থাকায় স্থান, কাল ও পাত্রে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে।

ডা. আলী জাহান: ইংল্যান্ডে কর্মরত সাইকিয়াট্রিস্ট। ইমেইল: <[email protected]>


ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: http://www.prothomalo.com/durporobash/article/1397856