দিঘল মেঘের দেশে-উনিশ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এমেন্ডারদের ল ফার্মটা পুরোনো বিল্ডিঙের ভেতর। আগে অবশ্য তাদের অফিস এখানে ছিল না। হেস্টিংসের ওয়ারেন স্ট্রিটে ছিল। রাকিব অনেক বার সেই অফিসের গিয়েছে। এমেন্ডার বস একজন প্রোপার্টি ল ইয়ার। রেসিডেন্সিয়াল, কমার্শিয়াল, ফার্মিং, সব সেক্টরই তারা দেখে। হেস্টিংস থাকতেই তাদের বেশ প্রসার ছিল।

রাকিব চেয়ারে বসে চেয়ারের পেছনে গা ছেড়ে রুমের চারদিক দেখল। এমনি। দেয়ালে একটা বড় দেয়াল ঘড়ি। সেই ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটাটা ঠিক স্বাভাবিক শব্দ করে চলছে না। শব্দ একটু বেশিই হচ্ছে-ক্লিক ক্লিক, ক্লিক ক্লিক। দেয়াল ঘড়ির পেন্ডুলামটা দুলছে যেন নিয়তির বিধান হয়ে। একবার এদিক একবার ওদিক।

রুমটা দেখতে দেখতে রাকিব এমেন্ডার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। তার মধ্যে গত এক সপ্তাহ ধরে যে উত্তেজনা ও এত আবেগ কাজ করছিল, এমেন্ডার মধ্যে তার বিন্দুমাত্র সে খুঁজে পেল না। পাঁচটা বছর ওরা একসঙ্গে ছিল! ভালোবাসা, বিয়ে, সংসার ও একটা মেয়ের জন্ম দেওয়া। এত স্মৃতি! একটা স্মৃতিও কী এমেন্ডার ভেতর আজ কাজ করছে না? হয়তো করছে। কিন্তু এমেন্ডা প্রকাশ করছে না। ওদের দাম্পত্য জীবনে এমেন্ডাই তো বেশি আবেগপ্রবণ ছিল। একটু সামান্য দুঃখেও সে কেঁদে ফেলত। একটু ভালোবাসলে মোমের মতো গলে যেত।

এমেন্ডা ফাইলের কাজ করতে করতে একবার চোখ তুলল। জিজ্ঞেস করল, গতকালই নিশ্চয় এসেছ?

রাকিব বলল, হ্যাঁ।

: কাল কখন এসেছ?

: এসেছি বিকেলের দিকে। নেপিয়ার শহরটা একটু ঘুরে দেখলাম।

: ব্লাফ হিলে গিয়েছিলে?

রাকিব এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল। তারপর আস্তে করে বলল, হ্যাঁ।

এমেন্ডা মৃদু হাসল। এবার তার হাসিটা কেমন জানি করুণ মনে হলো। রাকিবের ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে কম্পিউটারের স্ক্রিনে দৃষ্টি রেখেই জিজ্ঞেস করল, আর মেরিন প্যারেডে?

রাকিব পাল্টা জিজ্ঞেস করল, তুমি এসব জিজ্ঞেস করছ কেন?

এমেন্ডা না তাকিয়ে বলল, এমনি। জানতে ইচ্ছে হলো।

রাকিব বলল, হ্যাঁ।

: কেন গিয়েছিলে?

: তুমি অবান্তর প্রশ্ন করছ।

: হ্যাঁ রাকিব। প্রশ্নগুলো অবান্তরই। কারণ, আমি অবান্তর জেনেও কখনো মন খারাপ থাকলে ব্লাফ হিলের চূড়ায় গিয়ে বসে থাকি। মেরিন প্যারেডে হাঁটাহাঁটি করি।

: কেন কর?

: ওই যে বললাম, অবান্তর কারণে!

রাকিব চুপ হয়ে গেল।

এমেন্ডাও কথা না বাড়িয়ে কাজে মন দিল।

ঠিক এগারোটার মধ্যেই এমেন্ডা কাজ শেষ করল। ফাইল গুছিয়ে, কম্পিউটার বন্ধ করতে করতে বলল, আর বলো না, এত ব্যস্ততা যাচ্ছে, এখন মেলবোর্নে যেতে পারলে বাঁচি।

রাকিব বলল, তোমার বস তো তোমাকে এই কাজে সহযোগিতা করতে পারে। আফটার অল এই কাজগুলো কিন্তু তারই।

এমেন্ডা বলল, তিনি সহযোগিতা করেন তো। গত উইকএন্ডে এসেছিলেন। এই উইকএন্ডে আসেননি। গত বৃহস্পতিবার রাতে মেলবোর্নে গেছেন।

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ও, আচ্ছা। তুমি মেলবোর্ন কবে যাচ্ছ?

: জানি না।

: জানি না মানে?

: না, একেবারেই যে জানি না, তা নয়। ফেব্রুয়ারির ফার্স্ট উইক বা সেকেন্ড উইকে যাব। নির্ভর করছে বসের ওপর। এবার তিনি মেলবোর্ন থেকে এলেই তারিখ ঠিক করা হবে। তারপর টিকিট কাটব।

: ওখানে গিয়ে উঠবে কোথায়?

: বস বাসা ঠিক করে আসবেন।

: তুমি কি বসের বাসাতেই থাকবে?

: আরে না, বসের ফ্যামিলি আছে না। আর আমারও তো প্রাইভেসি দরকার। কারও বাসায় থাকা আমি পছন্দ করি না। তিনি আমার জন্য ছোট্ট একটা এক বেডরুমের বাসা ভাড়া করে আসবেন।

রাকিব মাথা ঝাঁকাল। কিছু বলল না।

এমেন্ডা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল, চল, আমার অফিসের পাশেই শিমলা অ্যাভিনিউয়ে একটা ভালো কফি শপ আছে। ওখানে কফি খেতে খেতে গল্প করব।

রাকিবও চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল, হ্যাঁ, চল।

বাইরের রোদটা মাথার ওপর না হলেও সর্বত্র ঠিকই দুপুরের আঁচড় পড়েছে। এমনিতেই নিউজিল্যান্ডের মধ্যে হকস বে অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে গরম একটু বেশি পড়ে। আজ গরমটা যেন স্বাভাবিকের তুলনায় একটু বেশিই পড়ছে। তবে শিমলা অ্যাভিনিউয়ের খানিকক্ষণ পর পর পুরোনো গাছ আছে বলে গাছের ছায়ায় রোদ থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে।

এমেন্ডা কফি শপটা তার অফিসের কাছে বললেও আসলে ওটা শিমলা অ্যাভিনিউয়ের শেষ মাথায় টিমাতা রোডের কোণায়। ওরা দুজন কফি শপের অভিমুখে হাঁটছে। রোদের বিপরীতে হাঁটছে বলে সামনের ছোট্ট ছায়া দুটো একটা আরেকটার সঙ্গে টক্কর খাচ্ছে। যদিও ওরা ফুটপাত ধরে একজন আরেকজন থেকে সামান্য দূরত্ব নিয়ে হাঁটছে।

ছায়া দুটোর দিকে তাকিয়ে থেকে রাকিবের তখন নদীর কথা মনে পড়ল। কিছুদিন আগে প্রফেসর রজারসনের বাসায় যাওয়ার পথে ম্যাকফার্লেন স্ট্রিটে নদীর সঙ্গে তার এমন ছায়ার টক্কর লেগেছিল। কিন্তু পার্থক্য শুধু একটাই, সেদিন সূর্যটা পশ্চিমে খানিকটা হেলে পড়েছিল। আর আজ সূর্যটা এখনো পুবে হেলে রয়েছে।

রাকিব ছায়া দুটোর দিকে তাকাতে তাকাতে আড়চোখে কয়েকবার এমেন্ডার দিকে তাকাল। এমেন্ডা মাত্র এক হাত দূরত্বে পাশাপাশি হাঁটছে। সে এমেন্ডার শরীরের সুন্দর গন্ধটা পাচ্ছে। পাশাপাশি হাঁটতে গিয়ে নারীদের শরীরের সুগন্ধ রাকিবকে বরাবরই মোহিত করে।

রাকিব এমেন্ডার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ভাবল, মাত্রই তো এক হাত দূরত্বে অবস্থান। কিন্তু সে তাকে মোটেও স্পর্শ করতে পারছে না। অথচ এই নারীটা একদিন তার স্ত্রী ছিল। যে জীবন ও শরীরের উষ্ণতার পাশাপাশি ভালোবাসার উষ্ণতাও অকাতরে বিলিয়ে দিত। আজ সেই নারী মাত্র এক হাত দূরত্বে হাঁটছে। কিন্তু জীবন ও ভালোবাসার দিক দিয়ে সে আজ যোজন যোজন দূরত্বে অবস্থান করছে।

রাকিবের মনে পড়ল, এভাবে ফুটপাতে হাঁটতে গেলে এমেন্ডা বরাবরই তার বাহু চেপে ধরে হাঁটত। দিঘল ফুটপাত কিংবা প্রশস্ত সমুদ্র সৈকতে, কোনো শপিং মল বা বাড়ির আঙিনায়, এমেন্ডা তার হাতটা ছাড়ত না। সাদিয়ার জন্মের পরও এমেন্ডা এমনটা করত। রাকিব সাদিয়ার স্ট্রলার ঠেলত, আর এমেন্ডা তার বাহু ধরে রাখত। সেই পাঁচটা বছর! কিন্তু আজ?

এমেন্ডা ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল, কী ভাবছ?

রাকিব তাড়াতাড়ি বলল, নাতো, কিছু না।

: একদম চুপচাপ যে? কিছু তো একটা ভাবছিলে?

: তুমিও তো চুপচাপ।

: আমি তো একটা কিছু ভাবছি।

: কী ভাবছ?

: হুম, সেটা বলা যাবে না।

রাকিব বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে বলো না।

এমেন্ডা জিজ্ঞেস করল, তোমার জানতে ইচ্ছে করছে না?

রাকিব নিস্পৃহ গলায় বলল, নাহ, কী জানব? কেন জানব?

এমেন্ডা বলল, তাই তো! আচ্ছা, বাদ দাও ওসব কথা।

ওরা দুজন কফি শপে গিয়ে ঢুকল। এই সময়টা ঠিক দুপুরের খাবারের সময় না, আবার নাশতা করার সময়ও নয়। তাই কফি শপ প্রায় ফাঁকা। এ ছাড়া আজ রোববার।

এমেন্ডা কফির অর্ডার দিতে গেলে রাকিব সৌজন্যতা দেখিয়ে বলল, আমি কফির কথা বলি?

এমেন্ডা মৃদু হেসে বলল, তুমি কিন্তু আমার এখানে এসেছ?

রাকিবও মৃদু হেসে চুপ হয়ে গেল।

এমেন্ডা দুই কাপ ফ্লাট হোয়াইট কফি ও দুটো চকলেট মাফিনের অর্ডার দিল।

রাকিব যদিও আজকাল লং ব্ল্যাক কফি খায়, তারপরও সে এমেন্ডাকে কিছু বলল না।

ওরা একটা ছোট্ট টেবিলে মুখোমুখি দুটো চেয়ারে বসল। রাকিব চেয়ারে বসেই কফি শপটার চারদিক একবার তাকাল। কফি শপটা বেশি বড় নয়। ভেতরে একধরনের গম্ভীর-নিস্তব্ধ ভাব। হয়তো রোববার বলে লোকজন না থাকাতে কফি শপের ভেতরটা এত গম্ভীর-নিস্তব্ধ লাগছে।

এমেন্ডা তার ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করল। রাকিবের দিকে দিতে দিতে বলল, এটা ধর। এটার জন্যই তোমাকে চিঠি দিয়েছিলাম।

রাকিব হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিল। প্যাকেটটা খুলে দেখল, সাদিয়ার কিছু ফটোগ্রাফ ও ডেথ সার্টিফিকেট। কোর্ট সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র।

রাকিব বলল, তুমি তো এগুলো পোস্ট করে দিতে পারতে?

এমেন্ডা বলল, হ্যাঁ, পারতাম। পোস্ট করার জন্যই প্যাকেট করছিলাম। কিন্তু পরে পোস্ট করিনি।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, কেন?

: তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল। মেলবোর্ন চলে যাচ্ছি। জীবনে আবার কবে দেখা হবে!

: এ জন্য তুমি আমাকে এত দূর ডেকে এনেছ?

: হ্যাঁ, এ জন্যই। অবশ্য তুমি শেষপর্যন্ত রাজি না হলে আমি পোস্ট করেই দিতাম।

: সেটাই ভালো ছিল। শুধু শুধু আমাকে এত দূর ডেকে আনলে।

: শুধু শুধু নয় রাকিব।

: তাহলে কী? আর ছবিগুলো তোমার কাছেই রেখে দিতে? সাদিয়ার এসব ছবির কপি আমার কাছেও আছে।

: তোমাকে আরেকটা কথা বলার জন্য এত দূর ডেকে এনেছি।

: ও, তুমি যে ফোনে বলছিলে কোনো ইম্পর্ট্যান্ট কথা, সেটা?

এমেন্ডা আস্তে করে বলল, হ্যাঁ।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, কী সেই কথা?

এমেন্ডা ঝুঁকে রাকিবের একটা হাত মুঠো করে ধরে বলল, আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো, প্লিজ। আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো!

রাকিব তার হাতটা টেনে নিতে গিয়ে নিল না। হাতের স্পর্শে সে তখন এমেন্ডার সেই আগের উষ্ণতা অনুভব করল। সে দেখল, এমেন্ডার চোখ ভিজে আসছে।

রাকিব মূক হয়ে তাকিয়ে রইল।

ওয়েটার তখনই কফি ও চকলেট মাফিন নিয়ে এল। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন