দিঘল মেঘের দেশে-আঠারো

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সাড়ে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে রাকিবকে হেভলুক নর্থে এমেন্ডার অফিসে গেলেই হবে। পৌনে দশটার সময়ই সে রিনেই ভাবির বাসা থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেল। বাইরে আজ চকচকে রোদ উঠেছে। রোদটা যেন মেঘকে একটুও শুষছে না। গরমটাও বেশ পড়েছে। তবে দক্ষিণের বাতাসটাই যা রক্ষে। আকাশে ছেঁড়া মেঘ অনেক দূরে দূরে। অনেক দূরের ধূসর হওয়া পাহাড়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে এই চক চকে রোদের কারণে।

রিনেই ভাবির বাসাটা হেস্টিংসের পূর্ব পাশে বলে তাঁর বাসা থেকে হেভলুক নর্থ যেতে বেশি সময় লাগে না। গাড়িতে মাত্র দশ মিনিট লাগে। হেভলুক নর্থ হেস্টিংস শহরেরই একটা অংশ। কিন্তু হেভলুক নর্থের বাসিন্দারা নিজেদের হেস্টিংস থেকে আলাদা ভাবতে পছন্দ করে। এর পেছনে কারণ, হেভলুক নর্থের বাসিন্দারা বেশির ভাগই কৃষক ও ধনী সম্প্রদায়ের।

যেহেতু তাড়া নেই, তাই রাকিব রিনেই ভাবির বাসা থেকে বের হয়ে সেন্ট অবেন স্ট্রিট ধরে ড্রাইভ করতে শুরু করল। এই সেন্ট অবেন স্ট্রিট ওয়েস্টে তার বাসাটা ছিল। পুরো পাঁচ বছর সে ছিল ওই বাসায় ছিল। ওটাই ছিল এমেন্ডাকে নিয়ে তার হেস্টিংসের প্রথম ও শেষ বাসা।

রাকিব সেই বাসাটার সামনে এসে ড্রাইভওয়ে ঘেঁষে গাড়িটা পার্ক করল। বাসাটা ঠিক আগের মতোই আছে। লাল সিরামিক ইট। অ্যালুমুনিয়ামের জানালা। লাল টাইলসের ছাদ। তবে বাসার সামনের পাইন গাছগুলো বেশ বড় উঠে অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। বাসার পেছনের বাউন্ডারি ঘেঁষে যে গোলাপের বাগানটা এমেন্ডা ও সে মিলে করেছিল, ওটা আর এখন নেই। দুটো ক্যাবেজ গাছের চারা এনে এমেন্ডা বাসার পেছনে একপাশে পুঁতে দিয়েছিল। সেই ক্যাবেজ গাছটা এখন বেশ বড় হয়ে বাসার টাইলসের ছাদ ছাড়িয়ে আরও ওপরে উঠে গেছে।

রাকিব গাড়িতে বসেই বাসার ভেতর লোকজনের আনাগোনা দেখল। তার একবার বাসার ভেতরটা দেখে আসার ইচ্ছে হলো। কিন্তু সে ইচ্ছেটা দমন করে নিল। ভাবল, বাসার ভেতরটা কী আর আগের মতো আছে? একেকজন মানুষ একেকটা বাসা ভাড়া নিয়ে নিজেদের রুচিমতো একেক রকম করে সাজায়। সব মানুষের রুচি তো আর এক নয়। তাই নতুন নতুন ভাড়াটিয়ার সঙ্গে একই বাসার ভেতরের চেহারাও বদলায়।

রাকিব গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সেন্ট অবেন স্ট্রিট থেকে নেলসন স্ট্রিট, রাসেল স্ট্রিট, ইস্টবার্ন স্ট্রিট ও ওয়ারেন স্ট্রিটগুলোতে একবার চক্কর দিল। এই স্ট্রিটগুলো ধরেই হেস্টিংস সিটি সেন্টার গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন পাব, রেস্টুরেন্ট, নাইট ক্লাব, ভিলেজ সিনেমা, শপিং মল প্রধানত এই স্ট্রিটগুলোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

নিউজিল্যান্ডে একেকটা শহরের বৈশিষ্ট্য একেক রকম। কাছাকাছি নেপিয়ার শহরকে যেমন আর্ট ডিকো শহর বলা হয়, তেমন হেস্টিংস শহরকে বলা স্প্যানিশ মিশন স্টাইলের শহর। প্রায় প্রতিটা দালানে রয়েছে রাফকাস্ট স্ট্যাকু দেয়াল। অর্কিডের জানালা। ছোট্ট ঝুলন্ত ব্যালকনি ও ঝুলন্ত টেরাকোটা টাইলসের ছাঁদ।

যদিও হাতে বেশ সময় আছে তারপরও রাকিব হেস্টিংস সিটি সেন্টারের কোথাও গাড়ি থামাল না। সে হেভলুক নর্থের অভিমুখে রওনা হলো। হিরিটাঙ্গা রোড ধরেই হেভলুক নর্থে যাওয়ার পথ।

হিরিটাঙ্গা রোডে উঠলে যে দৃশ্যটা সবচেয়ে আগে চোখে পড়ে, গাড়ির উইন্ড-স্ক্রিন গলে কয়েক কিলোমিটার দূরের হেভলুক নর্থের কাছে টিমাতা পিক দেখা যায়। টিমাতা পিকের দিকে তাকালে মনে হয় যেন আস্ত একটা মানুষ হাত-পা টান টান করে শুয়ে আছে। তার নাম-রঙ্গাকাকু। রঙ্গাকাকু প্রায় তিন শ মিটার দীর্ঘ। মাউরি দেবতা।

রঙ্গাকাকুর প্রেমের কাহিনি রাকিব প্রথম এমেন্ডার কাছেই শোনে। এমেন্ডা খুঁজে খুঁজে রাকিবকে এসব প্রেমের কাহিনি শোনাত।

মাউরি মিথে আছে, দেবতা রঙ্গাকাকু একদিন দেবী হিনোরাকইয়ের প্রেমে পড়ে। রাঙ্গাকাকু হিনোরাকইয়ের পরিবারের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু বিয়েতে একটা শর্ত বড় হয়ে দাঁড়ায়। রঙ্গাকাকু হিনোরাকইকে বিয়ে করতে পারবে এই শর্তে, যদি সে এ অঞ্চলের পাহাড়গুলো খেয়ে সমতল করে দিতে পারে। রঙ্গাকাকু এতে রাজি হয়ে যান। তিনি একের পর এক পাহাড়গুলো খেয়ে সমতল করতে শুরু করেন। কিন্তু হেভলুক নর্থের কাছে এসে একটা পাহাড় খেতে গিয়ে গলায় আটকে মারা যান। রঙ্গাকাকুর সেই মারা যাওয়ার স্থানটাই টিমাতা পিক।

দেবী হিনোরাকই নাকি গোধূলি লগ্নে টিমাতা পিকে এসে আজও কাঁদেন। অনেক পর্যটক হঠাৎ হঠাৎ ধোঁয়াশার মতো তাঁকে দেখতে পান। দিঘল দেহী। নীল আলখেল্লার মতো পোশাক পরা।

রঙ্গাকাকুর পাহাড়গুলো খেয়ে সমতল করা টিমাতা পিকের পাশের সেই সমতল ভূমিতে এখন আঙুরের বড় বড় বাগান। টুকি টুকি নদীটা গেছে সেই সমতল ভূমির বুক চিরে। অনেকে বলে, হিনোরাকইয়ের চোখের কান্নার জল দিয়েই নাকি টুকি টুকি নদীর সৃষ্টি।

রাকিব জানে, বাস্তবের মতো রূপকথা বলে একটা প্রবাদ আছে। নিউজিল্যান্ড যেন সেরকমটাই। মতি ভাইয়ের স্ত্রী মিনু ভাবি একবার অকল্যান্ড থেকে হেস্টিংসে বেড়াতে এসে টিমাতা পিক দেখে বলেছিলেন, সত্যি বিধাতার চোখের চেয়ে বড় ক্যামেরা পৃথিবীতে নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটকেরা নিউজিল্যান্ডে এসে ঠিক এ কথাটাই বলেন। বলার ভাষা হয়তো অন্য।

রাকিব কবি মানুষ। তার চোখের ভাষা আরও গভীর। সে মনে করে, পৃথিবীর প্রত্যেকটা দেশেই একেক ধরনের সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু মানুষকে সেই সৌন্দর্য খুঁজে বেড়াতে হয়। কিন্তু নিউজিল্যান্ডে আছে প্রতিটা পদক্ষেপেই সৌন্দর্য। মানুষকে আর খুঁজে বেড়াতে হয় না। ঘর থেকে পা ফেললেই হয়। ভার্জিন বিউটি বলে একটা কথা আছে। নিউজিল্যান্ড হলো ভার্জিন বিউটি। বিধাতার সৃষ্টি মর্ত্যের স্বর্গভূমি।

রাকিব ঠিক সাড়ে দশটার সময় হেভলুক নর্থে এসে পৌঁছাল। এমেন্ডার অফিস খুঁজে পেতে তার মোটেও সমস্যা হলো না। ছোট্ট শহর। মাত্র কয়েকটা রাস্তা। শিমলা অ্যাভিনিউতে এমেন্ডার অফিস। হেভলুক রোড দিয়ে টাউন সেন্টারে ঢুকে টিমাতা রোড ধরে ডানে মোড় নিলেই শিমলা অ্যাভিনিউ।

হেভলুক নর্থ, নেপিয়ার ও হেস্টিংসের অনেকগুলো রাস্তার নাম ভারতের কোনো শহর বা প্রসিদ্ধ স্থানের নামে রাখা হয়েছে। সিন্ধ প্লেস, হায়দরাবাদ রোড, শিমলা অ্যাভিনিউ বা লৌখনো স্ট্রিট।

রাকিব গাড়িটা পার্ক করে এমেন্ডার অফিসের সামনে এসে দাঁড়াল। একটা পোস্ট শপের পাশেই অফিসটা। দরজার সামনে বেশ বড় করেই ল ফার্মের লোগো সহ একটা সাইনবোর্ড।

রাকিব অফিসের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। অফিসের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।

রাকিব দরজায় নক করল। একবার, দুবার, তিনবার। তার ভেতরে কেন জানি মৃদু একটা কম্পন। কত আবেগ ও কত দ্বিধা! অতীতের কত স্মৃতি! কত দিন পর সে এমেন্ডাকে দেখবে!

অফিসের দরজা ভেতর থেকে খুলে গেল। রাকিব দরজার সামনে এমেন্ডাকে দেখল। কিন্তু দেখেই সে মৃদু ধাক্কা খেল। চোখের ধার আর সরু নাকটা না থাকলে সে এমেন্ডাকে চিনতেই পারত না।

এমেন্ডা ওজনে সব সময় সাতচল্লিশ কেজির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এ নিয়ে তার এক সময় গর্বও ছিল। এখন মনে হচ্ছে, পাল্লা পুরো উল্টে গেছে। চার-সাত এখন সাত-চার হয়ে গেছে। সাতচল্লিশ উল্টে গিয়ে চুয়াত্তর হয়েছে।

এমেন্ডা স্মিত হেসে বলল, এসো, ভেতরে এসো।

রাকিব সৌজন্যে স্মিত হেসে ভেতরে ঢুকল।

এমেন্ডা অফিসের দরজাটা আবার বন্ধ করে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ?

রাকিব বলল, ভালো। তুমি কেমন আছ?

এমেন্ডার গলায় অসহিষ্ণু ভাব। বলল, আমার কথা আর জিজ্ঞেস করো না। ব্যস্ত, মহাব্যস্ত। শরীরের দিকে তাকানোর সময় নেই।

রাকিব বলল, তাই! তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না।

: কেন? এ কথা কেন?

: না, মানে, তোমাকে হঠাৎ করে দেখে চিনতে অসুবিধা হচ্ছিল।

: বেশ মোটা হয়ে গেছি, তাই না?

: সে কী আর বলার অপেক্ষা রাখে?

: দেখ, এভাবে বলবে না। সারা দিন অফিস ডেস্কে বসে থাকি। অফিস ডেস্কে বসে থাকতে থাকতে এ অবস্থা।

রাকিব হাসল। কিছু বলল না।

তারা দুজন করিডর ধরে শেষ মাথার রুমটায় ঢুকল। রুমটা বেশ বড়। বেশ বড় একটা টেবিল। কয়েকটা চেয়ার ও রুমের একপাশে এক সেট ছোট আকারের সোফাও আছে। কিন্তু সোফা, টেবিল ও চেয়ার, এমনকি মেঝেতেও শুধু ফাইল আর ফাইল। ফাইলের স্তূপ দেখে ভিমড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা।

এমেন্ডা বলল, রুমের অবস্থা দেখছ?

রাকিব বলল, হ্যাঁ, রুমের অবস্থা তো খুব খারাপ। এটা কি তোমার রুম?

এমেন্ডা একটা চেয়ার থেকে ফাইল সরিয়ে রাকিবকে বসতে বলে নিজের চেয়ারে গিয়ে বলল, আরে না। আমি হলাম গিয়ে সলিসিটরের অ্যাসিস্ট্যান্ট। এত বড় রুম হলে তো হতোই। এটা আমার বসের রুম। আমার রুম সামনে। রিসেপশনের পাশের রুমটা।

: তুমি কি তোমার বসের সব কাজ করে দিচ্ছ?

: ঠিক তা নয়। বসের কাজ মানেই তো আমার কাজ। গত পঁচিশ বছরের পুরোনো ফাইলপত্র।

: পঁচিশ বছরের ফাইলপত্র মানে? তুমি তো এই ফার্মে কাজ করছ ছয়-সাত বছর ধরে।

: আমি কাজ করিনি। কিন্তু আমার বস তো পঁচিশ বছর ধরে এই ফার্মে কাজ করছেন।

: তো এই ফাইলপত্র কি মেলবোর্নে নিয়ে যাবে?

: আরে না। কম্পিউটারে এগুলোর ডেটা এন্ট্রি করছি। ইম্পর্ট্যান্ট পেজগুলো স্ক্যান করে রাখছি।

: এত সব ফাইলের সবগুলো করতে হবে?

: তাহলে আর কী বলছি? দেখো না, রোববারেও কাজ করছি?

: হুম, তাই তো দেখছি।

এমেন্ডা কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল, প্লিজ রাকিব, দশটা মিনিট বস। আমি জাস্ট এই ফাইলটা শেষ করে তোমার সঙ্গে বাইরে যাব।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, বাইরে কোথায়?

এমেন্ডা বলল, ওই তো, পাশেই। একটা কফি শপে।

রাকিব স্মিত হেসে বলল, ঠিক আছে। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন