দিঘল মেঘের দেশে-চব্বিশ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সাইদ আহমেদ পুলিশ স্টেশন থেকে বের হয়ে ছেলেটার বাবার নম্বরে ফোন দিলেন। বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর একজন ভদ্রলোক ফোন ধরলেন। সাইদ আহমেদ বুঝতে পারলেন, ফোনের ওপাশের ভদ্রলোকই ছেলেটার বাবা। তারপরও তিনি খুব নরম গলায় বললেন, আমি কি একটু ডেরেক স্টুয়ার্টের সঙ্গে কথা বলতে পারি?

ওপাশ থেকে ভদ্রলোক বললেন, হ্যাঁ বলছি।

সাইদ আহমেদ বললেন, আমাকে আপনি চিনবেন না। আমি সাইদ আহমেদ। মিস্টার আজমল হোসেনের বন্ধু।

ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, কোন আজমল হোসেন?

: জি, গতকাল আপনার ছেলের সঙ্গে যে এক ভদ্রলোকের মিস আণ্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে, সেই আজমল হোসেন।

: ও, আপনি আমাকে ফোন দিয়েছেন কেন?

: আজমল হোসেনের সেই মিস আণ্ডারস্ট্যান্ডিংটা নিয়ে কথা বলার জন্য।

: ওটাকে আপনি কীভাবে মিস আণ্ডারস্ট্যান্ডিং বলছেন? মিস্টার আজমল হোসেন তো একজন ক্রিমিনাল। শুধু ক্রিমিনাল বললে ভুল হবে। খুব লো ক্লাস ক্রিমিনাল।

: জি, ওখানেই তো মিস আণ্ডারস্ট্যান্ডিংটা হয়েছে। আমরা কী একটু দেখা করতে পারি?

: কেন দেখা করতে চান?

: সেই মিস আণ্ডারস্ট্যান্ডিংটা নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে, প্লিজ!

: আপনি ঘটনাটাকে বারবার মিস আণ্ডারস্ট্যান্ডিং বলছেন। আপনি কি জানেন মিস্টার আজমল হোসেন কী জঘন্য কাজ করেছেন? তিনি এখন পুলিশ কাস্টডিতে আছেন। হেস্টিংস পুলিশ স্টেশনে। আপনি ওখানে গিয়েই যোগাযোগ করুন।

: আমরা এখন ওখান থেকেই এসেছি।

: ভালো কথা। তাহলে আমাকে ফোন দিয়েছেন কেন?

: আপনার একটু সহযোগিতার জন্য, প্লিজ! আমরা পাঁচ মিনিটের জন্য দেখা করতে চাই। আপনি যেখানে বলবেন সেখানেই দেখা করব।

: আমার সঙ্গে দেখা করে কী হবে?

: হয়তো কিছুই হবে না। তারপরও আমরা পাঁচটা মিনিটের জন্য দেখা করতে চাই। আপনি না করবেন না, প্লিজ।

: কী মুশকিল। আমার সঙ্গে আপনার দেখা করা ঠিক নয়। পুলিশ যেহেতু ব্যাপারটা দেখছে।

: আমি জানি। তারপরও একটি বার দেখা করতে চাই। আপনি না করবেন না।

: ওটা মনে হয় সম্ভব হবে না।

: দেখুন, আমি পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলেছি।

: পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কী কথা বলেছেন?

: মিস্টার আজমল হোসেনের কেসটা নিয়ে।

: পুলিশ অফিসার কী বলেছেন?

: পুলিশ অফিসার বলেছেন, আপনার সঙ্গে কথা বলে কেসটার একটা সমাধান করা যাবে।

: আমি কী সমাধান করব। সমাধান তো কোর্ট করবে।

: আচ্ছা, তা না হয় কোর্ট করবে। আমরা কী একটা বার বসতে পারি না, পাঁচ মিনিটের জন্য। প্লিজ, প্লিজ!

: আপনি তো আমাকে সমস্যার মধ্যে ফেললেন।

: প্লিজ, না করবেন না। আই অ্যাম বেগিং ইউ!

: আচ্ছা, আপনি আমার বাসায় আসুন। তবে অযৌক্তিক কোনো কথা বলতে আসবেন না। আমি অযাচিত কোনো অনুরোধও শুনব না।

: অবশ্য, অবশ্য। থ্যাংক ইউ। রিয়েলি থ্যাংক ইউ।

ছেলেটার বাবা-মা লরেন্স স্ট্রিটে থাকে। লরেন্স স্ট্রিটটা একিনা সাবার্বে। জাহিদদের পার্ক রোডের বাসা থেকে খুব বেশি দূরে নয়।

সাইদ আহমেদ গাড়ি চালাচ্ছেন। জাহিদ তার পাশের সিটে। রাকিব পেছনের সিটে। গাড়িটা লং লিনডন রোড ধরে উইলোপার্ক রোড হয়ে হিরিটাঙ্গা রোডে মোড় নিতেই সাইদ আহমেদ বললেন, জাহিদ, একবার তোমাদের বাসা হয়ে গেলে মনে হয় ভালো হয়।

জাহিদ জিজ্ঞেস করল, কেন সাইদ ভাই?

: আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।

: কী আইডিয়া?

: আজমল স্যারের ছেলেটার দুই-তিনটা ছবি সঙ্গে করে নিয়ে যাব।

: আমার মোবাইলে ছেলেটার ছবি আছে। ফেসবুকে পাঠিয়েছিল।

: কবেকার ছবি?

: ওই তো চৌদ্দতম বার্থ ডের ছবি।

: ওটা হবে না। আজমল স্যারের ছেলের পুরোনো ছবি দরকার। সেই সাত-আট বছর বয়সী ছবি। তাহলে সাবজেক্ট রিলেটেড হবে।

জাহিদ বলল, আইডিয়াটা চমৎকার।

সাইদ আহমেদ মৃদু হেসে বললেন, আইডিয়াটা কাজে লাগলেই হয়। ছেলের বাবা যে ঝাড়িটা মারলেন। জানি না কত দূর কী করতে পারব।

: যেহেতু ছেলেটার বাবা কথা বলতে রাজি হয়েছেন। আমার মনে হয় একটা সমাধান হবে।

: সেটাই যেন হয়। ও হ্যাঁ, একটা কথা। তোমাদের বাসায় আজমল স্যারের ছেলের আট বছর বয়সী কোনো ছবি আছে তো? না হলে শুধু শুধু বাসায় যাব কেন?

: হ্যাঁ, আছে। একটা ছবি আছে। ফ্রেমে বাঁধাই করা। স্যার যে ছবিটা বুকে নিয়ে মাঝেমধ্যে কাঁদেন।

: আহা স্যার!

জাহিদ আর কিছু বলল না।

রাকিব প্রথম থেকেই চুপচাপ। এদিকে বিকেলের সূর্যটা পশ্চিম আকাশে অনেকটাই হেলে পড়েছে। যদিও গ্রীষ্মের দীর্ঘ বিকেল। সবে সাতটা বাজে। সূর্য ডুবতে এখনো প্রায় তিন ঘণ্টা বাকি। কিন্তু তার যে হ্যামিল্টনের উদ্দেশে রওনা হওয়া প্রয়োজন। এখন রওনা হলেও হ্যামিল্টন ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে এগারোটা বা বারোটা বেজে যাবে। কাল সকালে তার অফিস। কিন্তু এ অবস্থায় সে কীভাবে রওনা দেবে? আজমল স্যারের একটা গতি না করে যাওয়াটা অমানবিক।

গাড়িটা পার্ক রোড ধরে যাচ্ছে। গাছপালার ফাঁক গলে সূর্যের নরম আলো গাড়ির ওপর পড়ে ঝিকিমিকি করছে। রাকিব আজমল হোসেনের কথা ভাবতে বসল। সে যেহেতু কলেজে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিল না, তাই আজমল হোসেনের সঙ্গে তার কখনো তেমন কথা হয়নি। তবে সে দেখেছে, তিনি কলেজে খুব নিরিবিলি চলতেন। কলেজের শিক্ষক ও ছাত্ররা তার যে খুব কাছের ছিল, তা নয়। কেউ তাকে নিয়ে মাথা ঘামাত না, আবার তাকে কেউ অপছন্দও করত না। তবে তার একটা বদনাম ছিল, তিনি কলেজের বিভিন্ন পরীক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের খুব নকল ধরতেন। নকল ধরলে রেহাই দিতেন না।

রাকিব ভাবল, আজ সেই আজমল হোসেন স্যারের এই অবস্থা!

জাহিদের বাসার সামনে গাড়ি পার্ক করে সাইদ আহমেদ বললেন, জাহিদ, আমরা গাড়িতেই থাকি। তুমি চটজলদি করে বাসা থেকে আজমল স্যারের ছেলের সেই ছবিটা নিয়ে আস।

জাহিদ সায় দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল।

সাইদ আহমেদ জাহিদের গমন থেকে এবার ঘাড় ঘুরিয়ে রাকিবের দিকে তাকালেন। বললেন, রাকিব, সরি।

রাকিব জিজ্ঞেস করল, সরি কেন সাইদ ভাই?

: এমন একটা পরিস্থিতিতে তুমি এসে পড়লে।

: আমাকে নিয়ে চিন্তিত হবেন না। আপনি এত চেষ্টা করছেন। আজমল স্যারের ঝামেলাটা শেষ হলেই হয়!

: মনে হয় না ঝামেলাটা এত সহজে শেষ হবে। তবুও চেষ্টা করছি। এ ছাড়া আর কোনো উপায় তো নেই। আচ্ছা, এ কথা বাদ দাও। দেখি না ছেলেটার বাবার বাসায় গিয়ে। এবার তোমার কথা বলো। এত দিন পর তোমার সঙ্গে হয়েছে। অথচ কোনো কথাই বলতে পারছি না।

রাকিব বলল, হ্যাঁ, সাইদ ভাই।

সাইদ আহমেদ জিজ্ঞেস করলেন, এখন কী করছ?

: ওই তো চাকরি।

: কোথায়?

: একটা কন্সট্রাকশন ফার্মে। ফ্লিটচার কন্সট্রাকশন ফার্ম।

: ওটার অফিস তো মনে হয় হেস্টিংসেও আছে।
: হ্যাঁ, ওটা অস্ট্রেলিয়া বেজড ফার্ম। নিউজিল্যান্ডের বড় বড় শহরগুলোর প্রায় সব কয়টাতেই আছে।

: কত বছর ধরে ওখানে চাকরি কর?

: সাড়ে চার-পাঁচ বছরের মতো তো হয়ে যাচ্ছে। হ্যামিল্টন যাওয়ার কয়েক মাস পরই চাকরিটা পাই।

: বেশ ভালো তো। হঠাৎ হেস্টিংসে আসলে?

: জি হঠাৎই।

: অফিসের কাজে?

: না, সাইদ ভাই। এমনই এসেছি।

: কোথায় উঠেছ?

: রিনেই ভাবির বাসায়।

: খুব ভালো মানুষ রিনেই ভাবি। এখানকার আমাদের কমিউনিটি থেকে তাকে খুব সম্মান দেওয়া হয়। আমরা কখনো মনে করি না যে তিনি আমাদের বাঙালি কমিউনিটির কেউ নন।

: জি, তিনি অত্যন্ত ভালো মানুষ।

: হাসান যে কেন তাকে ছেড়ে চলে গেল?

রাকিব মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ, এটা আমারও মাথায় আসে না।

সাইদ আহমেদ প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল, যাক, তুমি আজ রাতে আছ তো। আমার বাসায় ডিনার কর। রাতে আমার বাসায় থেকেও যেতে পার। গল্প করব।

: আজ তো থাকতে পারব না। আমাকে হ্যামিল্টন চলে যেতে হবে। আগামীকাল আমার অফিস আছে। আজমল স্যার এই সমস্যায় না পড়লে আমি অনেক আগেই হ্যামিল্টনের উদ্দেশে রওনা হয়ে যেতাম।

: আজমল স্যারের কি একটা সমস্যা রাকিব। তার হাজার সমস্যা। দেখ, স্যারকে যেখানেই কাজ দিই, তিনি দুই দিনের বেশি টিকতে পারেন না। আজ এটা ভুল করেন তো, কাল ওটা ভুল করেন। আর দেখা যায়, বারবার বলার পরও তিনি একই ভুল করেন।

: স্যারের বয়স হয়েছে তো, তাই।

: আমার কী কম বয়স হয়েছে? আমি আজমল স্যারের চেয়ে না হয় এক-দুই বছরের ছোট হব?

: সবাই তো এক রকম নয়। এ ছাড়া স্যার দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন, ওটাও একটা কারণ।

: হ্যাঁ, তা ঠিকই বলেছ। ¾এ জন্যই তো আজমল স্যারের যাতে বাসায় বসে থাকতে না হয় তার জন্য বিভিন্ন অরচার্ডে খুঁজে খুঁজে কাজ বের করি। মালিকপক্ষ ও অরচার্ড ম্যানেজারদের অনুরোধ জানাই।

: আমি জানি, আপনি মানুষের খুব উপকার করতে ভালোবাসেন।

: আর উপকার! বলেই সাইদ আহমেদ কী ভেবে এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেলেন। বললেন, থাক ওসব কথা। এবার তোমার কথা বলো।

রাকিব বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, আমার কী কথা সাইদ ভাই?

সাইদ আহমেদ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি বিয়েশাদি করেছ তো?

: না, সাইদ ভাই।

: কেন? এমেন্ডার সঙ্গে তোমার তো বহু আগেই ডিভোর্স হয়ে গেছে। তোমরা ডিভোর্স লেটার সাইন করোনি?

: করেছি। বহু আগেই করেছি।

: তাহলে এত দিন বিয়ে করোনি কেন? অন্য বাঙালিরা তো সেপারেশনে গিয়েই বাঙালি মেয়ে বিয়ে করে ফেলে। ডিভোর্স পর্যন্ত অপেক্ষা করে না।

: ইচ্ছে হয়নি, তাই।

সাইদ আহমেদ বললেন, ও।

এরই মধ্যে জাহিদ বাসার ভেতর থেকে আজমল হোসেনের ছেলের ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটা নিয়ে এল।

সাইদ আহমেদ বললেন, ছবিটা আনতে এত দেরি করলে?

জাহিদ বলল, খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ভেবেছিলাম আজমল স্যারের রুমে ছবিটা টানানো। কিন্তু স্যারের রুমে ঢুকে দেখি দেয়ালে ছবিটা নেই। পরে বেডের এক পাশে ছবিটা পাই। ছবিটা একটা চাদর দিয়ে ঢাকা ছিল।

সাইদ আহমেদ সায় দিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি গাড়িতে ওঠ। এ দেশি মানুষেরা খুব তাড়াতাড়ি ডিনার করে বেডে চলে যায়। আমরা ডিনারের আগেই ভদ্রলোকের বাসায় যেতে চাই।

জাহিদ বলল, হ্যাঁ, সাইদ ভাই। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <mohibulalam.k@gmail,com>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: