হঠাৎ স্বর্ণকেশী!-তিন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

লতা আমার এড়ানোটুকু খেয়াল করল ঠিকই, কিন্তু তাতে অপ্রস্তুত হলো না। বরং স্মিত হেসে অদ্ভুত পরিষ্কার উচ্চারণে আমার নামটা ধরে বলল, ‘অনীক, পরিচিত হয়ে ভালো লাগল। আচ্ছা, ওই কথাই থাকল, ডাক্তারের টারমিন শেষে এক ঘণ্টা পর, মানে এগারোটায় আমি ক্যাফেটায় থাকব। চলে আসবেন কিন্তু।’ আমি নির্লিপ্ত উত্তর দিলাম, ‘দাঁতের ব্যাপার, কিছুই বলতে পারি না। ডাক্তার কতক্ষণ বসিয়ে রাখবেন, তার ওপর নির্ভর করবে আসতে পারব কিনা। না পারলে ধরে নেবেন, চেম্বারে আটক বসে আছি।’

বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে লতা সায় দিয়ে কিছুটা ক্ষান্ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘আচ্ছা, কোনো জোরাজুরি নেই। না আসতে পারলে ওই যে বললেন, ধরে নেব ডাক্তারের ষড়যন্ত্র।’ আর সেই সঙ্গে খিলখিল হাসি। ঠিক যেন পাহাড়ি ঝরনা। আরও একবার বেসামাল ভ্রান্তিতে পড়ে গেলাম। সম্পূর্ণ অপরিচিত এই স্বর্ণকেশীর হাসিটুকু বিচিত্র কোনো কারণে বড্ড পরিচিত ঠেকতে লাগল। কোনোমতে একটুকরো ভাঙা হাসি দিয়ে বিড়বিড় করে বললাম, ‘দেরি হয়ে যাচ্ছে, আসি তাহলে এখন।’ কী উত্তর এল, না শুনেই পা চালালাম বিক্ষিপ্তভাবে। আর বাতাসে এলোমেলো হাত চালিয়ে ভ্রান্তিটাকে তাড়িয়ে দিতে চাইলাম। আজকের দিনটা এমন গোলমেলে কেন?

ভ্রান্তির অতলান্তিক থেকে আমাকে বের করে আনল কফিশপটাই। চলতে চলতেই চোখে পড়ল, বেশ বড়সড় জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাফেটা। একটাই দোকান। তার এক দিকে কফির আয়োজন। আরেকদিকে তুর্কি ডোনার কাবাব রেস্তোরাঁ। ডোনার কাবাব মানে আমাদের দেশে হালের শর্মা আর কী। কয়েক বংশ ধরে জার্মানিতে ঘাঁটি গাড়া তুর্কিদের প্রতি জার্মানদের একটা সহজাত প্রচ্ছন্ন বিদ্বেষ কাজ করে। কিন্তু দুপুর কী সন্ধ্যায় জার্মান জাত্যভিমান বুক পকেট থেকে নামিয়ে রেখে সেই তুর্কিদেরই হাতে বানানো এক আধটা ডোনার কাবাব পেটে চালান না দিলে চলেই না এদের। এখন বাঙাল আমার মনটাও দ্রুতলয়ে ভেবে চলছে, একটা চিকেন ডোনার কাবাবযোগে দুপুরের খাবারটা সেরে ফেললে কেমন হয়?

এই-সেই ভেবে শেষ পর্যন্ত রাস্তার ওপার থেকে ভেসে আসা ম ম কাবাবের ঘ্রাণেরই জয় হলো। ঠিক করলাম, দাঁতের একটা গতি করেই সোজা ডাক্তারের হাত থেকে ছুটে কফিশপে চলে আসব। স্বর্ণকেশী না স্বর্ণলতা কী যেন নাম, তার দেখা পেলে ভালো, না পেলে কবজি ডুবিয়ে ডোনার কাবাব আর সঙ্গে ঠান্ডা এক বোতল কোক মেরে দিয়ে ঘাউক ঢেকুর তুলে বাসায় গিয়ে অলস ভাতঘুম দেওয়া যাবে। তবে তারই মাঝে কেন যেন মনে হলো নীল টুপি লতাকে কফি কাপ হাতে নিয়ে বসে থাকতে দেখলে মন্দ হতো না। জীবনে ঘাস-লতা-পাতা আর সবুজের দরকার আছে। পরক্ষণেই নিজের ছেলেমানুষি চিন্তায় বিরক্ত হলাম। সহিস হয়ে মনের ঘোড়ার লাগাম টেনে ডানে বামে আর না তাকিয়ে সোজা আসল ঘোড়ার ডাক্তারের চেম্বারের পথে এগোতে থাকলাম।

গন্তব্যে পৌঁছানোমাত্রই অভ্যর্থনায় থাকা ফ্রাউ ক্যাথরিন আমার হাতে এক তাড়া কাগজ ধরিয়ে দিয়ে একটা প্রশস্ত হাসি হেসে কাজে ডুবে গেল। বলে রাখি, ফ্রাউ মানে ‘মিস’; সম্মানার্থে যেমন বলা হয়ে থাকে। আমি এক পলক কাগজগুলো দেখে ভুরু কুঁচকে বললাম, এগুলো তো গতবারই পূরণ করে গেলাম, আবার কেন? ফ্রাউ ক্যাথরিন সহাস্যে জানাল, ‘আরে বুঝলে না, জিডিপিআর, জিডিপিআর। তোমার আগের সব ডেটা আমরা মুছে দিয়েছি। কী আর করা, এখন আবার একটু কষ্ট কর।’ মনে পড়ে গেল, পুরো ইউরোপ জুড়ে জিডিপিআর মানে জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশন ওরফে তথ্য প্রতিরক্ষা আইন নিয়ে তোলপাড় চলছে।

অগত্যা বাধ্য ছেলের মতো কলম চেয়ে নিয়ে বসে গেলাম ফরম পূরণ করতে। নামধাম, ঠিকানা, ডায়াবেটিস আছে কিনা জাতীয় মামুলি প্রশ্নের তালিকা। কিন্তু ধৈর্যের বিচ্যুতি ঘটল যখন এসে ঠেকলাম—আপনি কি অন্তঃসত্ত্বা? কোন মাস চলছে? এটি কি আপনার প্রথম সন্তান? এর আগের কয়টি সন্তান আছে, নিচে উল্লেখ করুন। সন্তান প্রসবকালীন জটিলতা থেকে থাকলে তাও উল্লেখ করুন, ইত্যাদি ইত্যাদি...।

ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং ক্রস চিহ্ন দিয়ে কোনোমতে কাগজগুলো ফ্রাউ ক্যাথরিনের হাতে ফেরত দিলাম আর মহিলা একটা চটুল হাসি দিয়ে ঘোষণা দিল, ক্রস দিয়েছ কেন? ক্রস মানে তো ‘হ্যাঁ’। এই বলে সে হা–হা করে পুরুষালি ভঙ্গিতে হেসে উঠল। বিব্রত আমিও হাত বাড়িয়ে দিয়েছি ঘ্যাচাংগুলোকে শুধরে দেব বলে। ‘ওমা, তোমার গালে কি টোল পড়ে? কি দারুণ!’ ফ্রাউ ক্যাথরিনের কথায় অজান্তেই হাত চলে গেল গালে। সাত দিনের দাঁড়িও কী যথেষ্ট না হতচ্ছাড়া মেয়েলি টোলটাকে ঢেকে দিতে? কী লাভ হলো তাহলে এত কষ্ট করে ভাব নিয়ে দাঁড়ি না কামিয়ে থেকে? মাঝখান দিয়ে খালি গাল কুটকুট করছে। ধুর! বাঁচাল এই মহিলা লাগামহীন বলে চলছে, ‘এই তোমার দেশে সব ছেলেই কি তোমার মতো লম্বা, এমন তামাটে গায়ের রং? খাঁড়া নাক আর কালো চুলের সঙ্গে নিকষ কালো চোখ? ইশশ্।’ তার চোখে মুখে কপট আফসোসের ছাপ।

বিরক্তির মাত্রা আমার এখন সপ্তমে চড়েছে। মহিলা বাঙালির ছেলের রূপটাই দেখেছে, বিরূপ দেখেনি। হুংকার দিয়ে বলতে ইচ্ছা করছে, ‘এ্যাই! একদম চোওওপপ! কিন্তু তার বদলে ভদ্রতার একটা নীরব হাসি দিয়ে ভুলগুলো শুধরে আবার এসে বসলাম প্লাস্টিকের কটকটে গোলাপি চেয়ারের সারিতে। কী রংরে বাবা। মনে হয় ডাক্তার বাবুর বউ পছন্দ করে কিনেছেন। তার ওপর চেয়ারগুলো ক্ষুদ্রাকৃতির। এই লিলিপুটের চেয়ারে কতক্ষণ গালিভারের মতো বসে থাকতে হবে ভাবছি আর তখনই কেমন করে যেন চোখ আটকে গেল দেয়ালে টাঙানো ছবির দিকে।

পাহাড়ি মেঠো পথ দিয়ে এক তরুণী হেঁটে যাচ্ছে। হাতের বাহারি ঝুড়ি উপচে পড়ছে রঙিন বুনো ফুলের ভিড়ে। অবাক হয়ে দেখলাম মেয়েটার মাথায় বাঁধা নীল রুমাল অবিকল লতার টুপিটার মতো নীল। আরও ভড়কে গেলাম যখন খেয়াল করলাম ঝুড়ি হাতে ছবির মেয়েটা ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটছে। কী দেখছি এসব? চোখ কচলে ভালো করে আবার তাকাব, কিন্তু চোখ খুলতেই হাত ঘড়িটায় দেখলাম কয়েক গাছি উলের সুতা আটকে আছে। নীল রঙের। ছাড়িয়ে আনলাম সযত্নে। আলতো করে দুই আঙুলের মাঝে ফেলে ছোট্ট একটা নরম নীল বল বানিয়ে ফেললাম। এর মাঝে আমার ডাক পড়ল। ‘হ্যান্ডসাম অনীক, এবার তোমার পালা।’ ফ্রাউ ক্যাথরিনের মিষ্টি গলা আমার মেজাজ আরেকবার তিরিক্ষি করে দিল। একদম পিত্তি জ্বলে গেল। উঠতে উঠতেই চটজলদি উলের বলটার জন্য একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজলাম। কী মনে করে মানিব্যাগটা খুলে কয়েন রাখার কোটরে সেটাকে রেখে দিলাম। কেন রাখলাম? জানি না। নেহাত ছেলেমানুষি হয় তো, ঠিক জানি না। উঠে দাঁড়িয়ে আরেকবার ছবিটার দিকে চোখ গেল। ক্রাচটা গেল কই? আশ্চর্য! ঝুড়ি হাতে মেয়েটার আরেক হাতে তো একটা ভেড়ার বাচ্চা! বেরসিক ভেড়াটা আবার ঝুড়ি থেকে ফুল টান দিয়ে মনের সুখে চিবোচ্ছে! (চলবে)

ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: মিউনিখ, জার্মানি।

ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
হঠাৎ স্বর্ণকেশী!-দুই