হঠাৎ স্বর্ণকেশী!-দুই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ক্রাচের পতন অনুসরণ করে দেখলাম ক্রাচের মালিকও হেলে পড়ে যাচ্ছেন আলোর গতিতে। হাতের লাঠি ছাড়া তিনি একেবারে অসহায়। পুরো ছবিটা আমি যেন স্লো মোশনে ঘটে যেতে দেখছি। যেন কোনো কোরীয় সিনেমার রূপক দৃশ্য। ক্রাচ মাটিতে পড়ে শূন্যে ডিগবাজি খাচ্ছে। নীল টুপি মেয়েটা তাল হারিয়ে পড়ে যেতে যেতে আকাশে হাত বাড়িয়েছে অদৃশ্য খড়কুটো ধরবে বলে।

সব দেখেশুনে আমি কেমন হতবিহ্বল হয়ে গেলাম এক মুহূর্তের জন্য। কিন্তু মুহূর্তটা শেষ হওয়ার আগেই নিজের অজান্তেই অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় ছয় ফুটি শরীরটা সামনে ছুড়ে একটা ইগল ছোঁ মেরে ধরে ফেললাম মেয়েটাকে। যেন জন্টি রোডস স্টাইলের দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ে আটকে দিলাম ভয়ংকর এক বাউন্ডারি। স্বস্তির নিঃশ্বাসটুকু ফেলার সময় পেলাম না। কারণ আমি এবার তাকেসহ একসঙ্গে পড়ে যাচ্ছি। আজকের পপাৎ ধরণিতল ঠেকাবে কোন ভূতে।

কিন্তু ভূতকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে ফুটপাথ ফুঁড়ে গজিয়ে উঠল প্রাচীন এক ল্যাম্পপোস্ট। যেটা একটু আগেও এখানে দেখিনি। নিজেকে মনে হলো রূপকথার জ্যাক নামের যুবক আর ল্যাম্পপোস্টটা তার সেই গগনবিদারী শিম গাছ। বিস্ময়ে বিমূঢ় আমি পড়ে যেতে যেতে এক হাত বাড়িয়ে মরিয়া হয়ে তা-ই আঁকড়ে ধরে ফেললাম। আরেক হাতে তখনো প্রায় ঝুলন্ত, প্রায় পড়ন্ত অচেনা বিদেশিনী। নাকি সে-ই এ দেশে দেশি আর আমিই বরং বিদেশি। এই বিপদের ভেতরও মাথায় এত আগড়ুম-বাগডুম ভেবে যাচ্ছে দেখে অবাক হলাম।

যা হোক, আমি নিজেকে সামলে নিয়ে আতঙ্কে নীল হয়ে যাওয়া মেয়েটাকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিলাম বটে, কিন্তু দেখলাম যে, ক্রাচের অভাবে তার দুই পায়ে ভর দেওয়া অসম্ভব। আমি সংকোচ ঝেড়ে বলে বসলাম—অসুবিধা নেই, আপনি আমার কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়ান।

জার্মান ভাষায় আবার বাংলার মতো আপনি, তুমি আছে। মেয়েটিও কিছুটা ধাতস্থ হয়ে আমাকে ধরে দাঁড়িয়েছে বটে কিন্তু আচমকাই আমার হাতঘড়িটায় তার নীল টুপিটা আটকে গিয়ে বেরিয়ে এল একরাশ সোনালি চুলের বন্যা। ভীষণ অপ্রস্তুত আমি আল পটকা টুপিটা ছুটিয়ে এনে কোনোমতে মেয়েটার হাতে গুঁজে দিয়ে এই প্রথম তার দিকে ভালো করে তাকালাম। সবুজ চোখের সঙ্গে পিঠ ঢেকে নেমে আসা সোনালি চুলের স্রোত মিলিয়ে তাকে মনে হচ্ছে যেন ভূমধ্যসাগর থেকে উঠে আসা এক জলকন্যা। আমি এই অতি সৌন্দর্যের কাছে আড়ষ্ট হয়ে দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলাম। আরেক দিকে তাকিয়ে বললাম—আপনি এই ল্যাম্পপোস্টটা ধরে একটু কষ্ট করে দাঁড়ান, আমি চট করে আপনার ক্রাচটা এনে দিচ্ছি।

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই দেখি এক লোক হন্তদন্ত হয়ে ক্রাচ কুড়িয়ে নিয়ে চলে এসেছেন। তার মাথার হলুদ হেলমেট আর গায়ের ফ্লোরোসেন্ট রঙের জ্যাকেট দেখে বুঝলাম, তিনি ফুটপাথ মেরামতের লোক হবেন। ক্রাচটা তিনি আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ক্রাচের মালিকের কোথাও লেগেছে নাকি, সব ঠিক আছে কিনা ইত্যাদি ঝটিকা কুশলাদির একটা ঝটিকা ঝাপটা মেরে এক দৌড়ে কোত্থেকে একটা ফোল্ডিং চেয়ার নিয়ে এলেন। চেয়ারের হতচ্ছাড়া চেহারাটা দেখে মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। এতে বসলে হিতে বিপরীতের আশঙ্কাই প্রবল। স্বর্ণকেশী এতক্ষণে নিজেকে পুরোপুরি গুছিয়ে নিয়েছেন। আমার হাত থেকে ক্রাচ নিয়ে, চুলের রাশি আবার নীল টুপির শাসনে পুরে বেশ স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃতজ্ঞতার একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে খুব নম্রভাবে লোকটাকে জানিয়ে দিলেন সে একদম ঠিক আছে, আর বসে বিশ্রাম নেবার দরকার নেই। লোকটাও ভদ্রতায় মাথা ঝাঁকিয়ে তার ফোল্ডিং সিংহাসনটা বগলদাবা করে বিদায় নিলেন।

আমিও তার পিছু পিছু সটকে পড়ব কিনা ইতস্তত করছি। এত ‘পথে হলো দেরি’ করে কী লাভ। বরং আমার এত সাধের ডাক্তারের টারমিনটা ছুটে যেতে পারে। তখন আরেক বিপদ। সটকে পড়ার জন্য পা বাড়াতে গিয়েছি আর স্বর্ণকেশী এবার ঝকঝকে একটা হাসি দিয়ে কিশোরীর সারল্য নিয়ে আমার দিকে তাকাল। সেই হাসির সুর কাচের চুড়ির রিনিঝিনির মতো কানে বেজে কেমন করে যেন আমার পালিয়ে যাওয়া থামিয়ে দিল। বাধ্য হয়ে ধরা পড়ে যাওয়া চোরের মতো দাঁড়িয়ে পড়লাম।

‘উফ, আপনি যে আজকে কোথা থেকে দেবদূতের মতো আসলেন। আমাকে ওভাবে সেকেন্ডের ভেতর খপ করে না ধরে ফেললে আজকে আমার ভাঙা পাটা আবার ভাঙত।’ বলেই স্বর্ণকেশী একটা অদৃশ্য দুর্ঘটনার কাল্পনিক দৃশ্য দেখে শিউরে উঠল। তারপর বললেন, ‘আমি কি ধন্যবাদ হিসেবে আপনাকে এক কাপ কফি খাওয়াতে পারি, প্লিজ না বলবেন না?’ আমি সলজ্জ হাসিতে ধন্যবাদটা ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আরে না, না এ তো এমন কিছু না। আর মাফ করবেন, আমার একটা টারমিন আছে, আজকে কফি খেতে পারছি না, সাবধানে চলবেন, আমি চলি।’

আসলে আমি পালিয়ে বাঁচতে পারলে বাঁচি। ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। আর তাড়া তো আছেই। পা বাড়িয়েছি যাব বলে, অমনি শার্টের হাতায় টান পড়ল। চমকে থেমে গেলাম। এই মেয়ে তো ভয়ানক!

‘আমারও টারমিন আছে, আমারটাও ডাক্তারেরই। তাহলে কি যে যার কাজ সারার পর কাছের একটা কফি শপে আসতে পারি না। এই তো রাস্তার ওপারেই একটা ক্যাফে আছে। আর আমি...।’ এই বলে তরুণী ক্রাচটা হাতবদলের বিরতি নিল। বুঝলাম সে তার নামটা বলতে যাচ্ছে। শূন্য আগ্রহ অনুভব করলাম। জার্মান এই তরুণীর নাম আবার কী হবে। হয় ক্যাথরিন, নয় আনা। আর ছেলে হলে হতো স্টেফান কিংবা মুলার। নামকরণের মতো একটা মামুলি ব্যাপারে এ দেশের মানুষের আগ্রহ বা সময় কোনোটাই নেই। এরা ফক্সওয়াগন, বিএমডব্লিউ বানিয়ে আর ফুটবল খেলেই কুল পায় না, তার ওপর আবার বাচ্চাকাচ্চাদের নতুন নতুন নাম খোঁজা তো একেবারেই বাহুল্য।

আমি অধৈর্য নিয়ে ক্রাচ কন্যার বৈচিত্র্যহীন নামটা শোনার অপেক্ষায় অনিচ্ছায় দাঁড়িয়ে আছি।

‘আমি লতা।’

আমি চমকে গেলাম।

পরক্ষণেই সে বলল, ‘লতা, শার্লতা।’

আমার চমক কমে গেল। খালি একটু অবাক হলাম আর কী। জার্মান উচ্চারণে খটমট শার্লট হয়ে যায় শার্লতা। আর তাও সংকুচিত হয়ে এসে থামে লতায়। এখানে সব শার্লতার ডাকনাম লতা। কী আশ্চর্য! আর কী কোমল। আমাকে ভাবনা থেকে বের করে নিল লতার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা। আমি হাত ঝাঁকানোটা এড়াতে এলোমেলো চুলে উদ্দেশ্যবিহীন হাত চালিয়ে বললাম, ‘আমি অনীক।’ (চলবে)

ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: মিউনিখ, জার্মানি।

ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
হঠাৎ স্বর্ণকেশী!