নীল কুমুদিনীর নৃত্য-এক

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বাইরে মেঘ করলেও আপাতত বৃষ্টি হবে না। নদী কিছুক্ষণ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থেকেই বুঝতে পারল। নিউজিল্যান্ডের আবহাওয়া এ রকমই। সারা দিন মেঘ করে থাকলেও বৃষ্টি হয় না। আবার দেখা যায়, খাঁ–খাঁ রোদে ঝরঝর করে বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝেমধ্যে রোদ-বৃষ্টির খেলা বেশ সুন্দর হয়। শিমুল ভাবি মজা করে বলেন, নদী, দেখো দেখো, রোদের মধ্যে বৃষ্টি হচ্ছে, খ্যাঁকশিয়ালের বিয়ে হচ্ছে!

নদী কখনো গ্রামে থাকেনি বলে এই খ্যাঁকশিয়ালের বিয়ে দেখেনি। খ্যাঁকশিয়ালের আসলে বিয়ে হয় কিনা সে জানে না। গ্রামের বাড়ি বলতে সে বুঝত দাদার বাড়ি। কিন্তু সেই দাদার বাড়িতেই তার কোনো দিন যাওয়া হয়নি। একবার তার ইচ্ছে হয়েছিল দাদার বাড়িটা দেখে আসবে। অন্তত দূর থেকে। কিন্তু মা কোনো দিন আগ্রহ দেখাননি বলে তার যাওয়া হয়নি। দাদার বাড়ির কারও সঙ্গেও তার কখনো যোগাযোগও হয়নি। বাবার মৃত্যু নিয়ে মা এমনিতেই তার দাদার বাড়ির লোকজনদের সন্দেহ করতেন। তার ওপর মার স্বীকৃতির বিষয়টাও একটা বড় ব্যাপার ছিল।

বাইরে মেঘ-রোদ্দুরের খেলায় চমৎকার একটা রংধনু উঠেছে। এত স্পষ্ট রংধনু যে, রংধনুর প্রত্যেকটা রং আলাদা করা যায়। রংধনুর দিকে তাকিয়ে নদীর মনে হচ্ছে, ফিন্সলি স্ট্রিট ধরে একটু এগিয়ে গেলেই ওটাকে ধরা যাবে। নদী একদিন রংধনু ধরার চেষ্টাও করেছিল। সে এগোচ্ছে, রংধনুটা পেছাচ্ছে। এ এক অদ্ভুত খেলা!

নদী সেই অদ্ভুত খেলাটার কথা চিন্তা করে মনে মনে হাসল। তার ঠোঁটেও সেই হাসির রেখা ফুটে উঠল। এ মুহূর্তে তার অবশ্য রংধনু ধরার ইচ্ছে হলো না। ওসব অলীক রংধনু ধরে লাভটা কী?

কোনো কিছু না ভেবেই নদী জানালা থেকে সরে এল। এদিকে বিকেলটা প্রায় পড়ে এসেছে। আকাশে মেঘ-রোদ্দুরের খেলার জন্য হয়তো বিকেলটা একটু আগেই পড়ে এসেছে। আর নয়তো দীর্ঘ বিকেল অত সহজে কী শেষ হতে চায়?

নদী আপাতত কী করবে, ভেবে পেল না। রাকিবের সঙ্গে তার যোগাযোগটা একরকম বিচ্ছিন্ন হতেই বসেছে। রাকিব কথা দিয়েছিল, হেস্টিংস-নেপিয়ার থেকে ফিরে ফোন দেবে। কিন্তু পাঁচ দিন হয়ে গেল আজও ফোন দেয়নি।

নদীও কেমন গো ধরে বসে আছে। সে-ও রাকিবকে একবারের জন্য ফোন দেয়নি। যদিও নদী গত পাঁচটা দিন প্রতিটা মুহূর্ত রাকিবের ফোনের অপেক্ষায় থেকেছে। কতবার তার মন চেয়েছে নিজ থেকে ফোন দিতে! কিন্তু বারবারই ফোন দিতে গিয়ে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। কেন সে ফোন দেবে? তবে সে অত সহজে সম্পর্কটা ভেঙে দেবে না। মানুষটাকে সে বিশ্বাস করে। সে এটুকু বিশ্বাস করে, মানুষটার সঙ্গে সে হাজার মাইল হেঁটে এলেও মানুষটা তাকে স্পর্শ করবে না, বরং সম্মান দেবে।

নদী ভেবে রেখেছে, আগামীকালই সে রাকিবের বাসায় যাবে। ওখানে গিয়ে সরাসরি সে রাকিবের সঙ্গে কথা বলবে। তাকে সে সমস্যাটা কী, জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু সে কোন সমস্যা নিয়ে জিজ্ঞেস করবে, ওটা ভেবে রাখেনি।

জানালা থেকে সরে এসে নদী কম্পিউটারের সামনে বসল। এমনিই। তার তিন নম্বর অ্যাসাইনমেন্টের কাজ শেষ। এখন শুধু চার নম্বরটা বাকি। চার নম্বর অ্যাসাইনমেন্টটা সে পরেও করতে পারবে। হাতে প্রচুর সময় বাকি।

কম্পিউটারে বসে সে ফেসবুক অন করল। কিছুক্ষণ হোমে গিয়ে বিভিন্নজনের স্ট্যাটাসগুলো দেখল। ফেসবুকে তার খুব যে বন্ধু আছে, তা নয়। তার বুয়েটের ক্লাসমেটগুলোর অর্ধেকও তার ফ্রেন্ড লিস্টে নেই। এ ছাড়া সে ফেসবুকে বেশিক্ষণ সময় কাটাতে খুব একটা পছন্দ করে না।

নদী ফেসবুক বন্ধ করে ইমেইলগুলো চেক করল। তেমন বিশেষ কোনো ইমেইল নেই। নেট ব্যাংকের দুটো ইমেইল। একটা অ্যাসাইনমেন্টের ফলোআপ। এ ছাড়া কিছু জাঙ্ক মেইল।

নদী কম্পিউটার অফ করে দিল। কম্পিউটার টেবিলের একপাশ থেকে মোবাইলটা নিয়ে আবার জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। এবার বিকেলটা পুরোপুরি পড়ে এসেছে। বাইরে ধুপছায়া আলো। আকাশেও পুরোপুরি মেঘ করে এসেছে।

আকাশে মেঘ দেখে নদীর তখন মার কথা মনে পড়ল। আকাশে মেঘ দেখলেই মা বৃষ্টির আশা করতেন। আর বৃষ্টি দেখলেই তিনি কী যে উচ্ছ্বসিত হতেন! নদীকে ছাদে টেনে নিয়ে গিয়ে বলতেন, নদী, একটা গান ধর। অথচ মা জানতেন, তার গলায় গান ওঠে না। কখনো বলতেন, একটা কবিতা আবৃত্তি কর। আমার কবিতা। নদী কখনো শুদ্ধভাবে কবিতা আবৃত্তি করতে পারত না। কিন্তু মার অনুরোধে ঠিকই ফ্যাস ফ্যাসে গলায় কবিতা আবৃত্তি করত।

নদী কিছু না ভেবেই মেসেঞ্জারে মাকে ফোন দিল। তিনবার রিং বাজতেই মা ওপাশে ফোন ধরলেন। নদী জিজ্ঞেস করল, হ্যালো মা, তুমি খুব ব্যস্ত?

: হ্যাঁ, একটু ব্যস্তই। তুই কী কারণে ফোন দিয়েছিস? খুব জরুরি?

: না মা, এখানে আকাশে মেঘ করেছে তো, তোমার কথা মনে পড়ল। তাই ফোন দিয়েছি।

: ও, আমি তো কলেজের একটা মিটিংয়ে।

: শুক্রবারেও কলেজে মিটিং?

: হ্যাঁ, জরুরি মিটিং। সোমবারে কলেজে এক মন্ত্রী আসবেন।

: কলেজে কোনো অসুবিধা হয়েছে?

: না না, মন্ত্রী সাহেবের শখ হয়েছে কলেজে আসবেন। একসময় তিনি এই কলেজে লেখাপড়া করেছেন। কিন্তু আমাদের ওপর তো বিশাল দায়িত্ব পড়ে গেছে। বুঝছিসই তো, মন্ত্রী সাহেব বলে কথা! আচ্ছা নদী, আমি তোকে পড়ে ফোন দিই?

: ঠিক আছে মা, তোমাকে পরে ফোন না দিলেও হবে। আমি এমনিই ফোন দিয়েছি।

: তাহলে রাখি।

: হ্যাঁ, মা, রাখ।

ওপাশে নদীর মা ফোন কেটে দিলেন। নদী এপাশে মোবাইলটা কানে চেপে ধরে জানালার পাশেই বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এদিকে বাইরে হুট করেই যেন সন্ধ্যাটা নেমে গেল। মেঘলা আকাশ না থাকলে হয়তো নদী বিকেলটাকে ভাগ করতে পারত। কিন্তু এখন শেষ বিকেলের আলো দেখার আগেই সন্ধ্যা নেমে গেল।

নদী জানালা থেকে সরে এল। আসার আগে জানালার পর্দাটা টেনে দিয়ে এল। রুমে এখন কালি ছায়া অন্ধকার। নদী রুমের লাইটটা জ্বালিয়ে দিল।

নদী আজ রুম থেকে খুব একটা বের হচ্ছে না। বের হলেও ওড়না পেঁচিয়ে আঁটসাঁট হয়ে বের হচ্ছে। গতকাল শিমুল ভাবিদের বাসায় ব্রিসবেন থেকে অতিথি এসেছেন। সাধারণত নদী এ বাসায় অনেকটা ঘরের মানুষের মতোই সহজভাবে চলাচল করে। নাজমুল আহসান তো দিনের সারাক্ষণ বাইরে থাকেন। সকাল সাতটা বা আটটায় ট্যাক্সি নিয়ে বের হয়ে যান। ফেরেন রাত সাড়ে আটটা-নয়টার দিকে। নিঝুম তো এখনো অনেক ছোট। যতই সে বড় হওয়ার ভাব ধরুক। আর শিমুল ভাবি ও নিরালা। এই কয়েকটা মাস এ বাসায় থাকতে থাকতে নদী নিজেকে আর বোর্ডার ভাবে না। নিজেকে সে এ বাসারই একজন ভাবে।

শিমুল ভাবিদের অতিথিরা বর্তমানে ব্রিসবেনে থাকলেও আগে তারা হ্যামিল্টনের এই শেয়ারউড পার্কেই থাকতেন। নটিংহ্যাম ড্রাইভে। বেবুন ভাবিদের বাসা থেকে দুই বাসা পরই।

তবে অতিথি হয়ে আসা পরিবারটা বেশ। ভদ্রলোক ডাক্তার। ডা. শাহ আমিন হোসেন নাম। তার স্ত্রী কিছু করেন না। বলা যায় পুরোপুরি গৃহিণী। একসময় শেয়ারউড পার্কে থাকার সময় বেবুন ভাবির সঙ্গে নাকি টো টো করে ঘুরতেন। নদী একটা ব্যাপার বুঝতে পারে না, বেবুন ভাবিদের সঙ্গে অতিথিদের এত দারুণ সম্পর্ক ছিল। একেবারে কাছাকাছি বাসা ছিল। প্রতিবেশী ছিলেন। কিন্তু তারা বেবুন ভাবিদের বাসায় না উঠে কেন শিমুল ভাবিদের বাসায় উঠতে গেলেন? ওদিকে বেবুন ভাবিদের বাসার দুই রুম খালি পড়ে আছে। থাকার মানুষ নেই। অথচ এদিকে শিমুল ভাবিদের বাসায় কোনো রুম খালি নেই। বলা যায় তারা লাউঞ্জেই ফ্রোরিং করছেন। নদী অবশ্য সৌজন্যতার খাতিরে তার রুমে থাকতে বলেছিল। কিন্তু সে নিজে থাকবে কোথায়।

শিমুল ভাবিও যে তাদের বেডরুম ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেননি, তা নয়। কিন্তু অতিথির লাউঞ্জে ফ্লোরিং করবেন বলে গো ধরেছিলেন। তাদের যুক্তি, কারও বাসায় গিয়ে ফ্লোরিং করার মজাই আলাদা।

নদী ভাবল, হয়তো। সে তো এখন পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডে কোথাও বেড়াতে যায়নি। গেলে হয়তো কারও বাসায় গিয়ে ফ্লোরিং করার মজাটা বুঝত।

অতিথি হয়ে আসা ভদ্রমহিলার নাম মোহনা।

মোহনা ভাবির সঙ্গে নদীর প্রথম পরিচয়ের পর্বটা খুব চমৎকারভাবে হয়েছিল। গতকাল প্রথম পরিচয়েই মোহনা ভাবি হেসে বলেন, আরে, দারুণ তো! তোমার নাম নদী, আর আমার নাম মোহনা। দেখ তো, তোমার-আমার চেহারার কোনো মিল আছে কিনা? আমার তো মনে হয় আমরা একই মায়ের পেটের বোন।

নদীও হেসে বলে, সেই সম্ভাবনা নেই।

মোহনা ভাবি জিজ্ঞেস করেন, সম্ভাবনা নেই কেন? আলবৎ আছে।

: জি না, আলবৎ নেই। কারণ আমার মার বয়স অত হয়নি। আমিই তার একমাত্র মেয়ে।

: কেন, একমাত্র মেয়ে কেন?

: একমাত্র মেয়ে মানে, একমাত্র মেয়ে।

: তোমার মা কি আর কাউকে জন্ম দিতে ভয় পেয়েছিলেন?

: না, ঠিক তা নয়।

: তাহলে?

: আসলে আমি যখন মার পেটে তখন আমার বাবা মারা যান।

: ও, সরি। আই অ্যাম সো সরি। আমি এমনিই মজা করার জন্য কথাটা বলেছি। তবে আমরা তো বোন হতেই পারি, তাই না? আজ থেকে না হয় হলাম। নদী ও মোহনা। মোহনা ও নদী...!

নদী বেডের ওপর গা ছেড়ে পা দুলিয়ে বসতে বসতে ভাবল, মোহনা ভাবি সত্যি খুব চমৎকার। আর কী মিষ্টি চেহারার মহিলা! তার চেহারার দিকে তাকালে মনে হয় মায়া যেন গলে গলে পড়ছে। সব সময় কী হাসিখুশি থাকেন! আর সারাক্ষণ শুধু রসিকতা করেন।

নদীরও রসিকতা খুব পছন্দ।

মোহনা ভাবি কথাও বলেন কোনো রাখঢাক না রেখে। নিজের দুঃখগুলো তোতাপাখির মতো কলকল করে বলে যান। হাসির পর তার কান্নাটাও খুব সহজে চলে আসে।

নদী এরই মধ্যে জেনেছে, মোহনা ভাবির এই মায়াময় হাসিখুশি চেহারার মধ্যে কত দুঃখ লুকিয়ে আছে! তার ভেতরে কত কান্না আর যন্ত্রণা! তাদের একমাত্র ছেলে, যার নামটা বেশ কাব্যিক। অনাবিল। সে তার বাবা-মার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন থাকে না। অনাবিল হ্যামিল্টন থেকে আশি কিলোমিটার দূরের ছোট্ট শহর টোকোরোয়াতে থাকে।

নদী এখনো অনাবিলকে দেখেনি। তবে সে মোহনা ভাবির মুখেই শুনেছে, অনাবিল এখন বাইশ বছরের যুবক। সে এ দেশি সাদা চামড়ার পাকিহা এক গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে গত তিন বছর ধরে টোকোরোয়া থাকে। এ বছরের শুরুতে তাদের একটা মেয়েও নাকি হয়েছে। মেয়ের বয়স এখন এক মাস। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>