দিঘল মেঘের দেশে-পঁচিশ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

হেস্টিংস ছেড়ে নেপিয়ার শহরে পৌঁছতেই সূর্যটা টুপ করে প্রশান্ত মহাসাগরে ডুবে গেল। নেপিয়ার শহর ছাড়তে না ছাড়তেই সন্ধ্যা নেমে এল।

রাকিব গাড়ি চালাতে চালাতে পেছনে চলে যাওয়া নেপিয়ার শহরটা একবার দেখল। রাস্তার শত শত বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। কোথাও এলোমেলোভাবে, কোথাও রৈখিকভাবে।

রাকিব ভাবল, নেপিয়ার ও হেস্টিংস শহর ঘিরে তার কত স্মৃতি! এমেন্ডা, সাদিয়া, হাসানুজ্জামান হাসান, রিনেই ভাবি, পুতুল ও কোহিনূর। আজ নতুন করে জাহিদের সঙ্গে পরিচয় হলো।

আজমল হোসেনের বিধ্বস্ত চেহারাটা রাকিবের মনে এ মুহূর্তে আবার হানা দিল। একজন কলেজ শিক্ষক। উচ্চশিক্ষিত মানুষ। এই বিদেশবিভুঁইয়ে এসে কী কষ্টটাই না করছেন! একদিকে পিতৃত্বের টান, অন্যদিকে এই পরবাসে নিজেকে টিকিয়ে রাখার কী আপ্রাণ চেষ্টা!

রাকিবের মাঝেমধ্যে মনে হয়, এই পরবাসের জীবনটাকে বড্ড কুহেলিকাময়। চারদিকে শুধু মায়াবী মোহ। সবাই ছুটছে শুধু ছুটছে। কারও থামাথামির লক্ষণ নেই। কারও মুখে কোনো প্রাণখোলা হাসি নেই। অভিবাসীদের সবাই যেন তাদের প্রাণখোলা হাসি যার যার দেশে রেখে এসেছে।

রাকিবের মনে পড়ল, সাড়ে দশ বছর আগে সে যখন বাংলাদেশ ছাড়ে, তখন ছিল মধ্যরাত। প্লেনটা এয়ারপোর্ট ছেড়ে ঢাকা শহরের ওপর দিয়ে উড়ছে। ঢাকা শহরের আলোগুলো দূর থেকে ক্রমশ আরও দূরে চলে যাচ্ছে।

রাকিব প্লেনে না উঠলে বুঝতেই পারত না, ঢাকা শহর এত আলোর শহর।

কিন্তু রাকিবের এত সব আলো দেখতে দেখতে সেদিন তার চোখ কেমন ভিজে আসছিল। তার তো কান্না আসার কথা নয়! তার বাবা নেই। তার মা থেকেও একরকম নেই বললেই চলে। আর বড় চাচা তাকে বিদায় করতে পারলে বাঁচেন। বড় চাচি তো তাকে একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। আর ছিল তার দাদি। বৃদ্ধা, অর্ধেক মরা মানুষ।

রাকিব তো সেদিন কোনো ভালোবাসার মানুষ পেছনে ফেলে আসেনি। তারপরও সে কেন সেই রাতে প্লেনে বসে কেঁদেছিল?

নেপিয়ার শহর ছেড়ে ইশক ভ্যালি পেরোতেই রাকিবের সামনে-পেছনে দিঘল অন্ধকার এসে থমকে দাঁড়াল। শুধু গাড়ির হেড লাইটের আলো তাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সামনে। দ্রুত থেকে দ্রুততরভাবে। এক প্রান্তর ছেড়ে অন্য প্রান্তরে। (পর্ব চার সমাপ্ত)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>