টিয়ে রাজকন্যার আখ্যান-আট

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

অফিসে আজ তিনটার পর কোনো কাজ ছিল না। ইচ্ছে করলে রাকিব সাড়ে চারটার দিকে অফিস থেকে চলে আসতে পারত। কিন্তু ডেভিড ইটনের সঙ্গে তার গল্পটা জমে উঠেছিল বলে সে পাঁচটা পর্যন্তই অফিসে থেকে যায়। ঠিক তখনই নদীর ফোন আসে।

ডেভিড ইটনের গল্পটা আর কিছু নয়। দুই দিন আগে তার নতুন গার্লফ্রেন্ডটাও চলে গেছে। এবার তার গার্লফ্রেন্ড চলে যাওয়ার সমস্যা বিড়াল নয়, কুকুর। সাদা তুলতুলে ছোট্ট একটা বাচ্চা কুকুর। কুকুরটা তার নতুন গার্লফ্রেন্ডের ছিল। গত সপ্তাহে তার নতুন গার্লফ্রেন্ড পাঁচ দিনের জন্য অকল্যান্ডের ওয়াহিকি দ্বীপে তার বাবা–মার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। কুকুরটা বাসায় ডেভিড ইটনের তত্ত্বাবধানে রেখে গিয়েছিল। কিন্তু এদিকে ডেভিড ইটনকে তো অফিসে আসতে হয়। তাই সে কুকুরটাকে বাসার একটা রুমে আটকে অফিস করতে আসত। আসার আগে অবশ্য পর্যাপ্ত খাবার দিয়ে আসত।

কিন্তু সমস্যার সৃষ্টি হয় কুকুরটার পেশাব-পায়খানা নিয়ে। ডেভিড ইটনের অফিস করতে হয় বলে সে সারা দিন কুকুরটাকে সসম্মানে টয়লেটে নিয়ে যেতে পারত না। প্রতিদিন সে অফিস থেকে ফিরে দেখত, কুকুরটা পায়খানা-পেশাব করে রুম ভরিয়ে রেখেছে...! তার এক-দেড় ঘণ্টা লাগত সেগুলো পরিষ্কার করতে।

তাই একদিন ডেভিড কুকুরটাকে রুমে আটকে না রেখে বাসার পেছনের উঠোনে ছেড়ে দিয়ে আসে। বাসার চারদিকেই উঁচু কাঠের বেড়া। কুকুরটার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই। তারপরও ডেভিড বাসায় ফিরে দেখে কুকুরটা বাসার পেছনের উঠোনে নেই। সে এ বাড়ি ও বাড়ি খোঁজে। কোথাও খুঁজে পায় না। দুর্ভাগ্যবশত তার গার্লফ্রেন্ড সেই রাতেই ফিরে আসে। এসে কুকুরটা না দেখতে পেয়ে তো অগ্নি-চণ্ডাল হয়ে ওঠে। ডেভিডকে কুকুরটা খুঁজে বের করার জন্য দুই দিন সময় দেয়।

গত শনিবারে ছুটির দিন পেয়ে ডেভিড ইটন দুই-তিন সাবার্বের প্রতিটা বাড়িতে গিয়ে খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত অন্য সাবার্বের একটা বাড়িতে কুকুরটা খুঁজে পায়। কুকুরটা নিয়ে বাসায় ফেরার পর তার নতুন গার্লফ্রেন্ড বেশ প্রসন্ন হয়। কিন্তু দুই দিনের মাথায় ডেভিড ইটনকে দায়িত্বজ্ঞানহীন পুরুষ বলে বিদায় জানিয়ে দেয়। ডেভিড ইটনও ব্যাপারটা খুব প্রসন্ন মনে নেয়।

রাকিব জানে, গত তিন বছরে হ্যামিল্টনে ডেভিড ইটনের শুধুমাত্র বিড়ালের কারণে এতগুলো গার্লফ্রেন্ড চলে গেছে যে এখন কুকুরের কারণে তার নতুন গার্লফ্রেন্ডটা চলে যাওয়ার পর সে মোটেও অবাক হয়নি। বরং বেশ স্বাভাবিকভাবেই সে ব্যাগ-বিছানাপত্র গুছিয়ে নতুন গার্লফ্রেন্ডের বাসা থেকে চলে আসে। এরপর সে গার্লফ্রেন্ড নিলে নাকি কুকুর-বিড়াল পোষে এমন গার্লফ্রেন্ড নেবে না। কুকুর-বিড়াল মুক্ত গার্লফ্রেন্ড নিবে।

রাকিব অফিস থেকে ফিরেছে বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেছে। অফিসের কাপড়চোপড় ছেড়ে সে জিনসের একটা প্যান্ট ও একটা পলো গেঞ্জি পরেছে। রাকিব নিশ্চিত জানে, নদী যতই রহস্য করে বলুক এখন সে-ই আসবে। এসে বাসাটা গল্পে ও কলকল হাসিতে সরগরম করে তুলবে। হয়তো সঙ্গে কিছু একটা কিনে নিয়ে আসবে। তাই সে বারবার সারপ্রাইজের কথা বলেছে।

রাকিব ঠিকই হট ওয়াটার জগে পানি বেশি করে দিয়ে রেখেছে। সাধারণত সে অফিস থেকে ফিরে কফি কাপ হাতে ব্যালকনিতে দাঁড়ায়। কিন্তু এখন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকলেও এখনো কফির কাপ হাতে নেয়নি। নদী এলেই সে এক সঙ্গে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কফি খাবে। নদী অবশ্য ব্ল্যাক কফি খায় না। তার জন্য দুধ ঘন করে চিনি দিয়ে কফি বানাতে হয়।

রাকিব সবকিছুই কিচেনের বেঞ্চটপের ওপর সাজিয়ে রেখে এসেছে। কফির মগ, চিনির কৌটা, ইনস্ট্যান্ট কফির ছোট্ট কন্টেইনার। এমনকি দুধের কন্টেইনারটাও ফ্রিজ থেকে বের করে বেঞ্চটপের ওপর রেখে এসেছে। আজ নদী এলে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দুজন কফি খাবে। সন্ধ্যার পর ওরা কারি পট রেস্টুরেন্টে যাবে।

রাকিব ব্যালকনিতে ঝুঁকে দাঁড়াল। তারপর দিঘল দৃষ্টি মেলে ম্যাকফার্লেন স্ট্রিটের যত দূর দেখা যায় তত দূর পর্যন্ত তাকাল। সবুজ কচিপাতায় ছেয়ে যাওয়া ম্যাপল ও ওক গাছগুলোর কারণে ম্যাকফার্লেন স্ট্রিটটা এখন বেশ ছায়ায় ঢাকা। এই ছায়ার ফাঁকে ফাঁকে বিকেলের চিলতে রোদ তির্যক হয়ে পড়েছে। এখনো সূর্য ডুবতে ঢের সময় বাকি। ডে-লাইট সেভিংসের কারণে এখন সন্ধ্যা হতে হতে সোয়া সাতটা-সাড়ে সাতটা বেজে যায়।

রাকিবের মোবাইলটা হাতেই। রাকিব মোবাইলে সময়টা দেখল। সবে ছয়টা বাজে। অফিস থেকে ফিরেছে প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে। কিন্তু নদী এখনো আসছে না কেন? তবে কী নদী না এসে সত্যি নদীর সারপ্রাইজ আসবে? কী সেই সারপ্রাইজ? আজ নদী না এলে সত্যি মনটা খারাপ হয়ে যাবে। নদীর জন্য এখন পর্যন্ত সে কফি না খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

রাকিব আবার দিঘল ম্যাকফার্লেন স্ট্রিটের দিকে তাকাল। এক জোড়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ফুটপাত ধরে হাঁটছেন। তাদের কলকল হাসির ধ্বনি এখান থেকেও শোনা যাচ্ছে। একটা এগারো-বারো বছরের বালক সাইকেলে করে সামনের ঝুড়ি থেকে ভাঁজ করা ফ্লায়ার ও কমিউনিটি পত্রিকা বিভিন্ন চিঠির বাক্সে গুঁজে দিচ্ছে। দু-একটা গাড়ি আসছে-যাচ্ছে, সাঁই সাঁই, সাঁই সাঁই।

রাকিব ম্যাকফার্লেন স্ট্রিট থেকে দৃষ্টিটা সরিয়ে নিজের বাসার ড্রাইভওয়ের দিকে তাকাল। ড্রাইভওয়ের দিকে তাকিয়েই তার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, বছর খানেক আগেও এই ড্রাইভওয়েটার দিকে তার কখনো চোখ পড়ত না। তখন ড্রাইভওয়েটা ছিল বিশেষত্বহীন ও অতি সাধারণ। কিন্তু এখন ড্রাইভওয়েটা হয়ে উঠেছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে ভালো লাগার স্থান। এখন প্রতিনিয়ত নদী এই ড্রাইভওয়েতে এসে গাড়ি থামায়। ড্রাইভওয়ে মাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসে...।

রাকিব আজকাল প্রায়ই দৃশ্য-অদৃশ্য দৃষ্টিতে এই ড্রাইভওয়ে ধরে নদীকে উঠে আসতে দেখে। নদী ছোট ছোট পদক্ষেপ, নরম মুগ্ধ করা দৃষ্টি, অপূর্ব সুন্দর দিঘল হাসি...!

রাকিব আর ভাবতে পারল না। তার কেন জানি চোখ বুজে এল। সে চোখ বুজল।

রাকিব চোখ বুজতেই তার মনে কয়েকটা কবিতার লাইন ভিড় করল।

এই নদী, একটি সরল নদী, দীর্ঘ বাঁক ফেরা নদী।
এই নদী যেখানেই যায়, যুবতী যেখানে যায়-
সোনা রং, সবুজ আঁচল বিছিয়ে যুবতী যেখানেই যায়
নদীও যুবতী টানে বাঁক ফেরা পুরুষের মতো।

রাকিব চোখ খুলে ভাবল, ধ্যাত, এটা কোনো কবিতা হলো। তারপরও সে কবিতার লাইনগুলো নিয়ে মনে মনে সাজাতে চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুই হলো না। সে ড্রাইভওয়ের এপাশ-ওপাশ দেখল। লনের পাশের ওক গাছটা থেকে কয়েকটা চড়ুই পাখি ডাকছে কিচ কিচ, কিচির-কিচির, কিচ কিচ। চড়ুই পাখিগুলো এ ডাল থেকে ও ডালে উড়ছে। কাছে কোথাও একটা পাখি ডাকছে ডউব ডউব, ডুব ডুব, ডউব ডউব। রাকিব ভাবল, ডাকটা তো বেশ চেনা। নিশ্চয়ই ঘুঘু পাখি। নিউজিল্যান্ডে ঘুঘু পাখি খুব বেশি দেখা না গেলেও মাঝেমধ্যে দেখা যায়।

রাকিবের সময়টা যেন কাটতে চাচ্ছে না। আবার মোবাইলে সময়টা দেখল। বিকেল প্রায় সোয়া ছয়টা বাজে। এতক্ষণে মাত্র পনেরো মিনিট গেছে? রাকিব মনে মনে বিরক্ত হয়ে আবার ম্যাকফার্লেন স্ট্রিটের দিকে দৃষ্টি ফেলল। ঠিক তখনই দেখল, নদীর কালো গাড়িটা ম্যাকফার্লেন স্ট্রিট থেকে তার ড্রাইভওয়ের ওপর মোড় নিচ্ছে। রাকিবের মনটা খুশিতে ভরে গেল। ভাবল, যাক, সারপ্রাইজ যাই হোক নদী অন্তত এসেছে। আজ বিকেলটা তার চমৎকার কাটবে।

নদী ড্রাইভওয়ের একপাশে গাড়িটা পার্ক করে দরজা খুলে একটা দিঘল হাসি দিতে দিতে গাড়ি থেকে নামল। একবার ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে হাতও তুলল।

এদিকে রাকিব ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নদীকে দেখে তখনই সৌজন্যে হাত তুলতে ভুলে গেল। রাকিব এমনই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল যে, তার বিশ্বাসই হচ্ছে না, এ নদী! নদী টিয়ে রঙের শাড়িটা পরে এসেছে। গলায় ও কানে তার দেওয়া এম্যারল্ডের গয়নার সেটটা। কপালে একটা সবুজ টিপও দিয়েছে। ঠোঁটে খয়েরি লিপস্টিক। বিকেলের এক চিলতে রোদ এসে নদীর চেহারায় পড়েছে। নদীকে ঠিক রাজকন্যার মতো মনে হচ্ছে। টিয়ে রাজকন্যা। বহুকাল আগে ছোট চাচিকে যেমন টিয়ে রঙের শাড়ি পরলে টিয়ে রাজকন্যা মনে হতো...!

রাকিব আর ব্যালকনিতে দাঁড়াল না। দৌড়ের মতো করে লাউঞ্জে ঢুকল। লাউঞ্জ ঘুরে সে বাসার সদর দরজা খুলে ধুপধাপ করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করল। নদীর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, এই আমার সারপ্রাইজ?

নদী হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, জি।

: এর চেয়ে বড় সারপ্রাইজ কী হতে পারে!

: আমাকে ভালো লাগছে?

: তোমাকে অসাধারণ লাগছে। আমি পুরুষ মানুষ বলেই চোখে পানি আসছে না। কিন্তু তোমাকে দেখে সত্যি আমার আনন্দে পানি আসার উপক্রম হচ্ছে!

নদী মুগ্ধ করে হাসল।

রাকিব বলল, তুমি আমার হাত ধরো।

নদী রাকিবের হাত ধরল।

রাকিব বলল, এসো, আমি তোমাকে ওপরে নিয়ে যাই। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: