টিয়ে রাজকন্যার আখ্যান-সাত

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

নদীর মা ফোন কেটে দেওয়ার পরও নদী বেশ কতক্ষণ মোবাইলটা কানে চেপে ধরে রাখল। কানে চেপে ধরে রেখে মায়ের কথাগুলো অনুভব করল। তারপর কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল। বাইরে ঝিম ধরা রোদ। ডে-লাইট সেভিংস শুরু হওয়াতে এখন বিকেলটা স্পষ্ট ভাগ করা যায়। এখন মধ্য বিকেল। জানালা দিয়ে দক্ষিণের হিন হিন বাতাস আসছে। বসার স্থান থেকে জানালা দিয়ে যত দূর দেখা যায়, নদী আকাশটা দেখল। আকাশ স্পষ্ট নীল। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘগুলো বেশ দূরে দূরে।

নদীর কানে মায়ের শেষ কথাগুলো এখনো বাজছে। কেমন রিনিঝিনি শব্দ করার মতোই যেন মার কথাগুলো ছিল। মা প্রকাশকের কাছ থেকে পঁচাত্তর হাজার টাকা নিয়ে নদীর জন্য দুটো সোনার বালা বানাচ্ছেন।

নদীর কখনোই তেমন কোনো সোনার গয়না ছিল না। তার মাকেও নদী কখনো সোনার গয়না পরতে দেখেনি। হয়তো এককালে মার সোনার গয়না ছিল। কিন্তু সংসারের চাপে পরে হয়তো তিনি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। তাদের ছোট্ট মা-মেয়ের সংসারে বিলাসিতা নামক বস্তুটি তেমন ছিল না।

নদী রাকিবকে নিয়ে ভাবতে বসল। রাকিব তাকে একটা গাড়ি দিয়েছে। যদিও ওটা রাকিবের পুরোনো গাড়িটা, তারপরও এই গাড়িটা কিনতে তার ছয়-সাত হাজার চলে যেত। গাড়িটা এখনো কালো রঙের মধ্যে চকচকে-তকতকে আছে। নদী নিজে গাড়ি কিনলে এত দামের গাড়ি কিনত না। বড়জোর দুই-তিন হাজার ডলারের গাড়ি কিনত।

গত শনিবারেই রাকিব আরেকটা পাগলামি করেছে। আপাতত নদী ওটাকে পাগলামিই বলবে। রাকিব প্রায় আট-নয় শ ডলার খরচ করে তার জন্য এম্যারল্ড-ডায়মন্ডের একটা গয়নার সেট কিনে নিয়ে এসেছে। নয় ক্যারেট সোনার ওপর এম্যারল্ড ও ডায়মন্ডের সেটটা।

নদী টিয়ে রঙের শাড়িটার সঙ্গে পরবে বলেই রাকিব সেটটা কিনে নিয়ে এসেছে। গয়নার সেটটা নদীর খুবই পছন্দ হয়েছে। নদী নিজেও একদিন শিমুল ভাবির সঙ্গে ডাউন টাউন প্লাজায় ঘুরতে গিয়ে মাইকেল হিল জুয়েলার্সের ডিসপ্লে উইন্ডোতে এই সেটটা দেখেছিল। সেটটার দিকে কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েও ছিল। কিন্তু সেটটা কেনার কথা মোটেও ভাবেনি। তার ভাববার অবকাশও ছিল না। একে তো সে কখনো বিলাসিতার মধ্যে বড় হয়নি। জীবনের অনেক চাহিদাকে সে নিজের ভেতর কাবু করে রাখতে শিখেছে। চোখের দেখার মুগ্ধতা নিয়ে যে কোনো মানুষই বসবাস করতে পারে। সে নিজেও অনেক কিছুতে চোখের দেখার মুগ্ধতা নিয়ে বসবাস করছে। কিন্তু বাস্তব তো অন্য কিছু।

নদী হঠাৎ হঠাৎ ভাবে, রাকিব তাকে লোভী করে তুলছে না তো?

নদী বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মোবাইলটা হাতে নিয়েই সে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে মধ্য বিকেলের রোদটা চমৎকারভাবে বিছিয়ে রয়েছে। দিঘল ফিন্সলি স্ট্রিটের ছোট ছোট ম্যাপল ও ওক গাছগুলোতে এরই মধ্যে সবুজ পাতায় ছেয়ে গেছে। বসন্তের দক্ষিণের বাতাসে গাছের পাতাগুলো নড়ছে গায়ে গায়ে লেগে, তির তির করে। ওক গাছের পাতা বরাবরই স্ফটিক সবুজ। কিন্তু ম্যাপল গাছের পাতা বসন্তকালে একধরনের সবুজ রং ধারণ করে। যে রংটা কচি সবুজ পাতার রং। যেন ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। গ্রীষ্মকালে ম্যাপল পাতার রং গাঢ় সবুজ হয়ে যায়।

ম্যাপল পাতার রং এখন সবুজ কচি পাতার রং। সেই কচি পাতার রঙের ওপর হলুদ রোদ বিছিয়ে থেকে কচি সবুজ রংটাকে আরও মুগ্ধকর করে তুলেছে। নদী ম্যাপল গাছের সেই কচি পাতাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। তার রুমের খুব কাছেই একটা ছোট্ট ম্যাপল গাছ।

জানালার কাছে দাঁড়িয়েই নদী শরীরের আড়মোড়া ভাঙল। আঙুলের মটকা ফোটাল মট-ময়ট-ময়ট-মট। তারপর কী মনে সে ঘড়ি দেখল। প্রায় পাঁচটা বাজে। তার তখনি রাকিবের কথা মনে পড়ে গেল। ভাবল, রাকিব ভাই নিশ্চয়ই এখন অফিস থেকে বের হবেন। তাকে একটা ফোন দিলে কেমন হয়? ভাবতে ভাবতেই নদী রাকিবকে ফোন দিল। ওপাশে একবার রিং বাজতেই রাকিব ফোন ধরল।

নদী বলল, গুড বয়!

রাকিব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন?

: এই যে, একবার রিং বাজার পরই ফোন ধরলেন।

: ওমা, তুমি কি আমাকে রিং করে রিং টোনের হিসাব রাখ?

: তা রাখি না। কিন্তু ফোন না ধরলে বুঝতে পারি আপনি রিং টোন অফ করে রেখেছেন।

রাকিব হেসে বলল, ও, আচ্ছা। তবে ম্যাডাম, আপনি আমাকে রিং টোন অফ না করতে আদেশ দেওয়ার পর থেকে আমি রিং টোন অফ করি না।

নদী বলল, হুম, কবি সাহেব, আমি আপনাকে কিন্তু আদেশ দিইনি, অনুরোধ করেছি।

: ওই একই কথা।

: না, মোটেও না। এ ধরনের সম্পর্কে আদেশ শুধু স্বামীকেই করা যায়।

: আর অনুরোধ? অনুরোধ কাকে করা যায়?

নদী একটু চুপ থেকে বলল, জানি না।

রাকিব ফোনের ওপাশে শব্দ করে হেসে ফেলল।

নদী বলল, এত হাসতে হবে না। আপনি কি অফিস থেকে বের হয়ে গেছেন?

: না, এই তো এখন বের হচ্ছি।

: অফিস থেকে বের হয়ে কোথায় যাবেন?

: আর কোথায় যাব? সরাসরি বাসায়।

: বাসায় গিয়ে কী করবেন?

: বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কফি খাব। আর?

: আর কী?

: কিছু না। আচ্ছা, তুমি এত কিছু জিজ্ঞেস করছ কেন? তুমি কি আজ আমার বাসায় আসবে?

: আসতেও পারি, আবার নাও আসতে পারি। তবে একটা সারপ্রাইজ দিতে পারি।

: কী সারপ্রাইজ?

: অপেক্ষায় থাকুন।

রাকিব একটু বিরক্তির গলায় বলল, তুমি না! নদী তুমি আজকাল খুব রহস্য কর।

নদী হেসে ফেলল, হি হি, হি হি। বলল, সারপ্রাইজ! সারপ্রাইজটার জন্য অপেক্ষায় থাকুন। আর হ্যাঁ, বাসায় ফিরে হট ওয়াটার জগে পানি একটু বেশি দেবেন। সারপ্রাইজটা আজ বাসায় এসে কফি খাবে। ব্ল্যাক কফি।

রাকিব আগ্রহ নিয়ে বলল, আমি জানি আজ তুমি আসবে। এ জন্যই তুমি এত রহস্য করছ।

: না না, মোটেও না। আমি তো একবারই বললাম, আমি মোটেও আসব না। আমার প্রতিনিধি হয়ে একজন সারপ্রাইজ আসবে।

: কী, নাবিদ ভাই ও জুঁই ভাবি আসবেন?

: ওরা আসবেন কেন?

: ওরা কেন আসবেন, আমি তা কীভাবে জানব?

: তাহলে ওদের কথা বললেন যে?

: আহা, তুমি রহস্য করো নাতো। আমি জানি, তুমি আসবে। তুমি আস। আমার খুব ভালো লাগবে। আমার বিকেলটা অসম্ভব সুন্দর যাবে।

: সত্যি অসম্ভব সুন্দর যাবে?

: জি, ম্যাডাম।

: আমি না আসলে কি বিকেল সুন্দর যায় না?

: না, যায় না। এখন বলো, তুমি কি আসছ?

: আমি সত্যি আসব না। তবে আপনি অফিস থেকে গিয়ে বাসা থেকে এক পাও কোথাও নড়বেন না। কেউ একজন আসবে।

রাকিব নির্জীব গলায় বলল, আচ্ছা।

নদী জিজ্ঞেস করল, এমন ঠান্ডা গলায় বললেন যে?

রাকিব বলল, আহা নদী, সারা দিন অফিস করেছি। এখন ক্লান্তি লাগছে। তোমার কোন সারপ্রাইজ আসবে, আসুক। আমি অফিস থেকে গিয়ে বাসাতেই থাকব। কোথাও যাব না।

নদী হি হি শব্দে হেসে বলল, হট ওয়াটার জগেও কিন্তু পানি বেশি দিয়ে রাখবেন।

রাকিব বলল, আচ্ছা, তা-ও দিয়ে রাখব।

ফোন রাখার পর নদী জানালা থেকে সরে এসে মোবাইলটা বিছানার ওপর ছুড়ে ফেলে বাথরুমে ঢুকল। হাতমুখ ভালো করে ধুয়ে সে বাথরুম থেকে বের হয়ে সরাসরি কেবিনেটের ওপর থেকে শাড়ির প্যাকেটটা হাতে নিল। শাড়িটা প্লাস্টিকের প্যাকেট থেকে খুলে সে বিছানার ওপর শাড়ি, ব্লাউজ ও পেটিকোটটা বিছিয়ে দিল।

যদিও নদী শাড়ি খুব বেশি পরেনি, কিন্তু সে শাড়ি পরতে পারে। তার মা তাকে শাড়ি পরানো শিখিয়েছেন। কিন্তু কুঁচি দিয়ে পরতে গেলেই যত গোলমাল পাকিয়ে যায়। শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে গেলে পেছনে উঠে যায়। শাড়ির পেছন ঠিক করতে গেলে কুঁচি এলোমেলো হয়ে যায়। অনেক সময় কুঁচির সঙ্গে মিলিয়ে শাড়ির আঁচলটা ঠিক করা যায় না।

নদী আজ পেটিকোট ও ব্লাউজের ওপর শাড়িটা কোনো মতে পরে নিজের রুম থেকে বের হলো। নদী এখন শিমুল ভাবির রুমে যাবে। একে তো তার রুমে বড় কোনো আয়না নেই। তার রুমের আয়নাটা শুধু মুখ দেখার জন্য। ওদিকে শিমুল ভাবির বেডরুমে ড্রেসিং টেবিলে বড় একটা আয়না আছে। তার ওপর শাড়ির কুঁচিগুলো ঠিক করতে গেলেও একজন মানুষ প্রয়োজন।

নদী লাউঞ্জ দিয়ে যেতে যেতে দেখল, নিরব প্লে-স্টেশনে গেম খেলছে। তার অন্যদিকে তাকানোর কোনো ফুরসত নেই। নিরালা লাউঞ্জে নেই। এমনকি শিমুল ভাবিও লাউঞ্জে বা কিচেনে নেই।

নদী শিমুল ভাবির রুমের দরজায় নক করল। দরজাটা ভেজানো। নদী ভেতর থেকে শিমুল ভাবির কথা শুনতে পাচ্ছে।

নিরালা এসে দরজা খুলল। দরজা খুলেই নদীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আন্টি, তুমি শাড়ি পরেছ যে? তুমি কি আজ বিয়ে করবে?

নদী হেসে ফেলল। বলল, নাহ, নাতো!

: তাহলে শাড়ি পরেছ কেন?

: শাড়ি পরলেই কি কেউ বিয়ে করে?

: হ্যাঁ, আমি জানি। শাড়ি পরলে মানুষ বিয়ে করে। মা প্রত্যেক বছর একদিন শাড়ি পরে বাবার সঙ্গে বিয়ে করে।

: তুমি বলো কী!

: হ্যাঁ, আমি ঠিক বলেছি। আচ্ছা নদী আন্টি, তুমি কি তোমার বিয়েতে আমাকে বেস্ট পারসন বানাবে। আমি কিন্তু তোমার বিয়ের ফুলটা নেব।

শিমুল ভাবি এতক্ষণ কারও সঙ্গে মোবাইলে কথা বলছিলেন। নদীকে দেখেই তাড়াতাড়ি কথা শেষ করে একটা হাসি দিয়ে প্রথমে নিরালাকে একটা ধমক দিলেন। বললেন, এই নিরালা, সব সময় পাকামো করবে না। রুম থেকে যাও।

নিরালা বলল, না, আমি যাব না। আমি নদী আন্টির বিয়েতে বেস্ট পারসন হব।

শিমুল ভাবি বললেন, তোমার নদী আন্টি যখন বিয়ে করে তখন হবে। এখন এই রুমে চুপচাপ থাক, না হয় রুম থেকে চলে যাও।

নিরালা বলল, মাম, ইউ আর মিন...!

শিমুল ভাবি নিরালার কথা গা করলেন না। নদীর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললেন, ওমা, তোমাকে শাড়িতে কী সুন্দর লাগছে! তা হঠাৎ কী মনে করে আজ শাড়ি পরলে?

নদী একটা লজ্জার হাসি দিয়ে বলল, মা নতুন শাড়িটা পাঠিয়েছেন না, তাই ট্রায়াল দিচ্ছি।

: বেশ বেশ। তা, এই ট্রায়াল দিয়ে কি বাসায় থাকবে নাকি হ্যামিল্টন ইস্টে যাবে?

: হ্যামিল্টন ইস্টে যাব ভাবি।

: আমি জানতাম। হি হি, হি হি।

: ভাবি, শাড়ির কুঁচিটা ঠিক করতে পারছি না।

: আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি ঠিক করে দিচ্ছি। শাড়ি পরলে কুঁচি ঠিক করতে আমারও সমস্যা হয়। তোমার ব্লাউজটা তো সুন্দর ফিট হয়েছে।

: মা পাঠিয়েছেন তো। তিনি মাপ জানেন।

: তা বেশ বেশ! বলেই শিমুল ভাবি বিছানা ছেড়ে নেমে নদীর সামনে উবু হয়ে বসে শাড়ির কুঁচিটা ঠিক করে দিলেন। শাড়ির পেছনটাও পেটিকোটের ওপর ভালোভাবে নামিয়ে দিলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, শুধু শাড়ি পরলে হবে? সঙ্গে গয়না পরতে হবে না? আমার কাছে তোমার টিয়ে রঙের শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে ম্যাচিং সবুজ কাচের চুড়ি আছে। তবে কানের বা গলার নেই। কিন্তু তুমি এই শাড়ির সঙ্গে মাল্টি-কালারের চুড়িও পরতে পার। আমার কাছে গলার একটা ইমিটেশনের নেকলেস আছে। মাল্টি-কালার। কানের দুলটাও মাল্টি কালারের।

নদী বলল, ওসব লাগবে না। রাকিব ভাই আমাকে একটা এম্যারল্ডের গয়নার সেট কিনে দিয়েছেন। মাইকেল হিল জুয়েলার্স থেকে কিনেছেন।

শিমুল ভাবি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আর আমি সেদিন ডাউন টাউন প্লাজার মাইকেল হিল জুয়েলার্সে যেটা দেখে এসেছিলাম, সেটা নয় তো?

: জি ভাবি, ওটাই। তবে আমি এ ব্যাপারে রাকিব ভাইকে আগে কিছুই বলিনি।

: কোন ব্যাপারে?

: ওই যে, আপনি আর আমি মাইকেল হিল জুয়েলার্সে সেটটা দেখেছি।

: তাহলে?

: রাকিব ভাই নিজ থেকেই কিনে নিয়ে এসে আমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছেন।

: তিনি তোমার পছন্দটা জানলেন কীভাবে?

নদী মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি না ভাবি।

শিমুল ভাবি হেসে বললেন, আত্মিক টান। বুঝলে নদী, এটাকে বলে আত্মিক টান। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন