টিয়ে রাজকন্যার আখ্যান-ছয়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

নদী সাধারণত দুপুরে কখনো ঘুমায় না। কিন্তু আজ ক্লাস থেকে এসে দুপুরে খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। ক্লাস থেকে ফেরার সময় নদী লাইব্রেরি থেকে দুটো বই নিয়ে এসেছে। ফ্লুয়িড ম্যাকানিক্স ও থার্মোডায়নামিক্স। বই দুটো খুবই বেসিক বই। তারপরও সে ইচ্ছে করে নিয়ে এসেছে।

নদী শোয়া অবস্থায়ই কাত হয়ে বেড সাইড কেবিনেটের ওপর থেকে থার্মোডায়নামিক্স বইটা হাতে নিল। বইটার কয়েক পৃষ্ঠা উল্টেও দেখল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর হাই তুলতে তুলতে বইটা পাশে রেখে চোখ বুজল। এক সময় ঘুমিয়েও পড়ল।

নদী ঘুমের মধ্যে একটা স্বপ্ন দেখল। সে একটা নির্জন দ্বীপের সমুদ্র সৈকতে বালুকারাশির ওপর একাকী দাঁড়িয়ে আছে। সমুদ্রের গর্জন শো শো, শো শো। তার পায়ের কাছেই সমুদ্রের জল আছড়ে পড়ছে। জলের শব্দ ছলাৎ ছলাৎ, ছলাৎ ছলাৎ। দক্ষিণের হিম বাতাস বইছে। সেই হিম বাতাসে তার গলায় পেঁচিয়ে রাখা ওড়নাটা উড়ছে তির তির, তির তির। সমুদ্রের ফেনিল স্রোত তার পা ভিজিয়ে দিচ্ছে। সমুদ্রের জল বেশ উষ্ণ।

নদী পা আরও ভেজানোর জন্য জলের ভেতর নামল। নামতে নামতে সে হাঁটু অবধি জলে নেমে গেল। ওদিকে সমুদ্রে তখন জোয়ারের টান। সমুদ্রের গর্জন ক্রমাগত বাড়ছে। দক্ষিণের বাতাস বইছে শরীরকে আরও হিম করে।

নদী নামতে নামতে কোমর অবধি জলে নেমে গেল। সমুদ্রের জলের উষ্ণতা তাকে টানছে। জলের ঢেউ একবার তাকে পাড়ের দিকে ঠেলছে, একবার জলের দিকে টেনে নিচ্ছে। জলের ভেতর কী একটা বস্তু যেন তাকে হাতছানি দিচ্ছে। এক সময় সে নিজেকে গলা অবধি জলের মধ্যে আবিষ্কার করল। আর ঠিক তখনই সে টের পেল, জলের ভেতর তার পায়ের নিচ থেকে মাটিগুলো সরে যাচ্ছে।

নদী ভাবল, ওটা জলের ভেতর চোরাবালি নয় তো? সে প্রাণপণে সেখান থেকে সরে আসতে চেষ্টা করল। কিন্তু সে পারছে না। এক সময় সে জলের ভেতর ডুবতে বসল। মাথার ওপর অগাধ জল। ঠিক তখনই সে একটা জাহাজের সাইরেন শুনল ভয়ৎ ভয়ৎ, ভয়ৎ ভয়ৎ।

নদীর তখনই ঘুম ভেঙে গেল। নদী কখন মোবাইলে ভাইব্রেশন মুড দিয়ে রেখেছে তার মনে পড়ছে না। মোবাইলে কেউ রিং করছে। মোবাইলে ভাইব্রেশন হচ্ছে ভয়ৎ ভয়ৎ, ভয়ৎ ভয়ৎ।

মোবাইলটা নদীর সিথানের পাশেই। নদী মোবাইল ধরল। মা বাংলাদেশ থেকে ফোন দিয়েছেন।

নদী ঘুম জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করল, মা, তুমি?

নদীর মা ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কি ঘুমাচ্ছিলি?

: জি, মা।

: তোদের ওখানে এখন কয়টা বাজে?

নদী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, বিকেল প্রায় চারটা।

মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুই দুপুরে কবে থেকে ঘুমাতে শুরু করেছিস? জীবনেও তো কখনো দেখিনি?

নদী হাসল। বলল, মা, আজ ক্লাস থেকে ফিরে দুপুরে খাওয়ার পর কেন জানি ক্লান্তি লাগছিল। তাই একটু শুয়েছিলাম। মনে হচ্ছে বুড়ি হয়ে যাচ্ছি। হি হি, হি হি।

: তোকে বলেছে...! তুই বুড়ি হলে আমি কী?

: মা, তুমি বয়সে কুড়ি হচ্ছ। দিন দিন রূপসী হচ্ছ।

: দেখ, তুই ফাজলামি করবি না।

: আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু মৌনতা কী বলে জানো?

: সে কী বলে?

: তোমাকে নাকি গ্র্যান্ড মা লাগে না। বলে, তুমি নাকি দেখতে ইয়ং। মা, তোমাকে একটা কথা বলি।

নদীর মা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন , কী কথা?

নদী বলল, আমি এখন দূরে দূরে থাকি। তুমি ঢাকাতে একা থাক। তোমার খারাপ লাগে না?

মা একটু চুপ হয়ে গিয়ে বললেন, খারাপ তো লাগেই। অনেক খারাপ লাগে রে...!

: তাহলে মা তুমি একটা কাজ কর।

: কী কাজ?

: তুমি আরেকটা বিয়ে করে ফেল। স্টিল ইউ লুক সো ইয়ং। যে কেউ তোমাকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে যাবে...!

: তুই আবার ফাজলামি করছিস?

নদী হেসে ফেলল, হি হি, হি হি।

মা জিজ্ঞেস করলেন, নাবিদের মেয়েটা অনেক কিউট হয়েছে, তাই নারে?

: হ্যাঁ মা। অনেক কিউট। তোমাকে না ফেসবুক ও মেসেঞ্জারে কয়েকবার ছবি পাঠিয়েছি, দেখনি?

: হ্যাঁ, দেখেছি। নাবিদ ও তার বউ কেমন আছে?

: ওরা ভালো আছে মা। আমার খুব খেয়াল রাখে। বাবার কথা আর তোমার কথা খুব বলে।

: তোর বাবার কথা বলতে পারে। কিন্তু আমার কথা কী বলবে?

: তোমার কথাও বলে।

: নাবিদ তো আমাকে কখনো দেখেনি।

: নাবিদ ভাইয়া তোমাকে একবার দেখেছেন। বিয়ের পর তুমি যখন দাদার বাড়ি গিয়েছিলে?

: ও, আচ্ছা। আমি অবশ্য খেয়াল করিনি।

: তুমি কীভাবে খেয়াল করবে? তুমি ছিলে নতুন বউ?

: সেটার জন্য নয়। আসলে তখন পরিস্থিতিটাই এমন ছিল...।

: আমি জানি মা। তুমি অনেকবার বলেছ।

: আচ্ছা, ও কথা বাদ দে। তোর শাড়িটা পছন্দ হয়েছ তো?

: পছন্দ হয়েছে মানে? আমি তো শাড়ির পার্সেলটা পাওয়ার পরপর সেদিনই বললাম।

: না, মানে আবারও শুনতে ইচ্ছে হচ্ছিল।

: কেন মা, কোনো রহস্য?

: তুই শুধু রহস্য খুঁজিস কেন?

নদী হেসে ফেলল, হি হি, হি হি।

মা বললেন, এত হাসিস না তো? মেয়েদের এত হাসতে নেই।

নদী বলল, মা, তুমিই তো আমাকে হাসতে শিখিয়েছ।

মা কী ভেবে ফোনের ওপাশে কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলেন। তারপর আস্তে করে বললেন, তুই এত হাসলে আমার মন খারাপ হয়ে যায়।

নদী জিজ্ঞেস করল, কেন মা?

মা ভারী গলায় বললেন, তুই আমার সব হাসি নিয়ে গেছিস যে...!

নদীও এ পাশে চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ দুজন কথা বলতে পারল না। নদী বুঝতে পারছে, মা ওপাশে কাঁদছেন। এদিকে তার চোখও ভিজে এল।

মা বললেন, আমি এখন রাখি, নদী।

নদী তাড়াতাড়ি বলল, মা, প্লিজ প্লিজ, ফোন রেখ না। প্লিজ...!

: অনেকক্ষণ কথা বলেছি। ফোনে ক্রেডিট যা ছিল সব শেষ হয়ে যাচ্ছে।

: ও হ্যাঁ, তুমি তো নরমাল ফোনে ফোন দিয়েছ। মেসেঞ্জারে ফোন দাওনি কেন?

: তোর মেসেঞ্জারেই ফোন দিয়েছিলাম। বারবার মেসেজে চলে যাচ্ছে। মেসেজও রেখেছি। কিন্তু তুই ব্যাক করিস না দেখে সরাসরি ফোন দিয়েছি।

: ও, সরি মা। ডেটা কখন অফ করে রেখেছি, খেয়াল করিনি। আসলে ডিপার্টমেন্ট ও লাইব্রেরি সব জায়গায় ওয়াইফাই আছে তো। তুমি ফোন রাখ। আমি ডেটা অন করে তোমাকে মেসেঞ্জারে ফোন দিচ্ছি।

মা বললেন, আচ্ছা। বলেই তিনি ফোন কেটে দিলেন।

ওপাশে নদীর মা ফোন কেটে দিলেও নদী মোবাইলে ডেটা অন করে সরাসরি ফোন দিল না। সে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। মুখটা ধুয়ে সে বাথরুম থেকে বের হয়েই ওয়ার্ডরোবের ওপর রাখা পার্সেলটার ওপর চোখ ফেলল। পার্সেলটা আসার পর খুলে সেদিন রাকিবকে দেখাতে নিয়ে গেলেও পরে সে শাড়িটা আবার পার্সেলের বড় প্লাস্টিকের ব্যাগটায় ভরে ওয়ার্ডরোবের ওপর রেখে দিয়েছে। সকাল বিকেল আসতে যেতে সে শাড়িটার ওপর চোখ ফেলে। মা শাড়িটার সঙ্গে পেটিকোট ও ব্লাউজ বানিয়ে পাঠিয়েছেন।

নদী শাড়ির পার্সেলটা একবার হাতে ধরে যথাস্থানে রেখে বিছানায় বসে মাকে মেসেঞ্জারে ফোন দিল। ওপাশে দুবার রিং বাজতেই মা ফোন ধরলেন। নদী বলল, মা, তোমার শাড়ির পার্সেলটা এখন আবার দেখছিলাম।

মা জিজ্ঞেস করলেন, কী দেখছিস?

: শাড়ির রংটা দেখছিলাম। খুব সুন্দর লাগছিল।

: ওই রংটা তো তুই পছন্দ করেছিস। তোর পছন্দের রং অনুযায়ী আমি শাড়িটা পাঠিয়েছি।

: মা, আমি জানি। কিন্তু টিয়ে রংটা তোমারও খুব পছন্দের।

: হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিস।

: এই টিয়ে রংটা আরেকজনেরও পছন্দের।

মা জিজ্ঞেস করলেন, কার?

নদী আস্তে করে বলল, রাকিব ভাইয়ের।

রাকিবের কথা শুনে মা এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেলেন।

নদী নিজ থেকেই বলল, মা, তোমাদের কবিদের পছন্দ মনে হয় এক।

: সেটা কেমন?

: তোমার আর রাকিব ভাইয়ের অনেক পছন্দ এক পেয়েছি।

মা বললেন, হু। বলেই তিনি আবার চুপ হয়ে গেলেন। তারপর কী ভেবে হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে বললেন, আরে নদী, যে কথা বলার জন্য তোকে ফোন দিয়েছি, সেটাই ভুলে গেছি।

নদী জিজ্ঞেস করল, কী কথা মা?

: আমার যে কবিতা সমগ্রের প্রথম খণ্ডটা আগামী বই মেলায় বের হবে, ওটার দ্বিতীয় খণ্ডটারও চুক্তি করেছি।

: একই প্রকাশকের সঙ্গে?

: হ্যাঁ। তবে দ্বিতীয় খণ্ডটা আগামী বইমেলায় বের হবে না। এর পরবর্তী বইমেলায় বের হবে।

: তুমি এত আগে প্রকাশকের সঙ্গে চুক্তি করে ফেলেছ?

: প্রকাশক অ্যাডভান্স দিয়ে রেখেছেন যে।

: মা, এটা তো সুখবর। কত টাকা অ্যাডভান্স দিয়েছে?

: বেশি না। পঁচিশ হাজার টাকা।

: আসলেই বেশি না।

: কবিতার বই তো। প্রকাশক সাধারণত রিস্ক নিতে চায় না। তারপরও তো প্রথম খণ্ডটা আগামী বই মেলায় বের করছে। দ্বিতীয় খণ্ডটা নিয়ে চুক্তি করে ফেলেছে।

নদী বলল, ভালো ভালো। কিন্তু তুমি খুব স্বার্থপরের মতো কাজ করছ।

মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী স্বার্থপরের মতো কাজ করছি?

: তুমি আমাকে বিদেশ পাঠিয়ে দিয়ে একা একা আনন্দগুলো ভোগ করছ।

: ও, এই কথা?

: হ্যাঁ, মা। আই ফীল জেলাস...!

মা হেসে ফেললেন। বললেন, তুই না আসলেই একটা পাগল। তুই দেশে আস। সব আনন্দ এক সঙ্গে করব।

নদী জিজ্ঞেস করল, মা, আমি কবে দেশে আসব?

মা ফোনের ওপাশে কথার জবাব না দিয়ে চুপ হয়ে গেলেন। (ক্রমশ)

মহিবুল আলম: গোল্ড কোস্ট, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন