ঢাকায় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের নামে কী চলছে!

বেড়িবাঁধের পাশে টিনশেডের আধাপাকা বাড়ি। ছোট ছোট পাঁচটি কক্ষ। নেই আলো-বাতাসের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, ঘরের জানালা বলতে টিনকাটা ফোকর। তার মধ্যেই রান্না ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। চিকিত্সক নেই, নেই চিকিত্সা সরঞ্জাম, রোগীরা ঘুমায় মেঝেতে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এটি একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধসংলগ্ন ঢাকা উদ্যানে এ কেন্দ্রটির নাম ‘নিউ তরী’। এর পাশে ‘জীবনের আলো’ ও ‘ফিউচার’ নামের আরও দুটি কেন্দ্রেরও একই চিত্র।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরে এভাবে পাঁচ শতাধিক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র চলছে। এগুলোকে সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখিয়ে কেউ কেউ সমাজসেবা অধিদপ্তর বা ঢাকা সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছে সনদ নিয়ে কেন্দ্র পরিচালনা করছেন। এসব কেন্দ্রে চিকিত্সাসুবিধা বলতে কিছু নেই। আছে অভিযোগ আর অভিযোগ—চিকিত্সার নামে রোগীর ওপর শারীরিক নির্যাতন, মাদকের ব্যবসা পরিচালনা ও রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো অর্থ আদায়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে প্রণীত হয় ‘মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র ও মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা বিধিমালা’। এটি অনুসারে কেন্দ্র পরিচালনার জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নেওয়ার কথা। কিন্তু এ পর্যন্ত মাত্র ১০টি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন নিয়েছে। নিবন্ধন নেয়নি এমন প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করেছে অধিদপ্তর।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলের সহকারী পরিচালক রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তালিকা ধরে বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা কর্ণপাত করছেন না। প্রভাবশালী কেউ তাঁদের পেছনে রয়েছেন। আবার কিছু রোগী থাকার কারণে হঠাত্ করে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। তবে শিগগির নিবন্ধন নেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে সময় বেঁধে দেওয়া হবে। নিবন্ধন না নিলে বন্ধ করে দেওয়া হবে।
অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলের আরেক কর্মকর্তা জানান, রাজধানীতে বেসরকারিভাবে পাঁচ শতাধিক নিরাময় কেন্দ্র থাকলেও নিবন্ধন নিয়েছে মাত্র ১০টি। অন্যরা আবেদন পর্যন্ত করেনি।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার এ কে এম শহীদুল হক বলেন, এটা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা শুধু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের। বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে পরিচালিত হওয়া এসব কেন্দ্র বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো সহযোগিতা চাইলে পুলিশ তা করবে।
জানা যায়, পারিবারিক বিরোধকে কেন্দ্র করে গুলশানের ব্যবসায়ী জাকাউল্লাকে তাঁর পরিবারের সদস্যরা মাদকসেবী অপবাদ দিয়ে তিন মাস নিউ তরী নিরাময় কেন্দ্রে চিকিত্সার নামে আটকে রাখেন। গত বছরের ২ জুন জাকাউল্লার স্ত্রী ইশরাত জাহান আইনি লড়াইয়ে জিতে স্বামীকে মুক্ত করেন। ওই ব্যবসায়ীকে জোর করে আটক রাখার অভিযোগে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ওই নিরাময় কেন্দ্রের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ১৫ দিন বন্ধ থাকার পর অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তার মৌখিক নির্দেশে নিউ তরীর কার্যক্রম আবার শুরু হয়। ওই কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, দুটি কক্ষের মেঝেতে ২৫ জন রোগীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি কক্ষ তুলনামূলক বড় হওয়ায় দিনে সেখানে রোগীদের মানসিক চিকিত্সা বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়। রাতে ওই কক্ষের মেঝেতে বিছানা পেতে রোগীরা ঘুমান বলে জানান প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। এখানে জরুরি বিদ্যুতের জন্য নিজস্ব জেনারেটর নেই। রোগীদের চিত্তবিনোদনের জন্য লুডু ও দাবা কোর্ট রাখা হলেও কেউ তা খেলেন না।
পাশের ফিউচার কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার পরিবেশ ছিমছাম। তবে রোগীদের ঘুমানোর জন্য পর্যাপ্ত খাট নেই। একটি বিছানায় দুজনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। মেঝেতে শুয়ে আছেন কেউ কেউ। এখানে একটি মাত্র ক্যারম বোর্ড রয়েছে।
জীবনের আলো কেন্দ্রে ২৫ জন রোগীকে পাওয়া যায়। টিনশেডের এই বাড়িতে মেঝেতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানেও রোগীরা মেঝেতে ঘুমান। ১০ শয্যার কেন্দ্রে যেসব সুবিধা থাকার কথা, তার কিছুই নেই এখানে।
নিউ তরী মাদকাসক্ত সেবা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ হেলাল জানান, এটি ১০ শয্যার। বাড়তি রোগী থাকলেও সবাই এখানে থাকেন না। অনেকেই বাইরে থেকে এসে চিকিত্সা নিয়ে বাসায় ফিরে যান। এখন ১৫ জন রোগী আছেন। জেনারেটর না থাকলেও জরুরি বিদ্যুতের জন্য জেনারেটর লাইন ভাড়া নেওয়া আছে। নিবন্ধন নিয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা নিবন্ধনের জন্য প্রকল্প প্রস্তাবনা (প্রজেক্ট প্রোফাইল) জমা দিয়েছি। কর্মকর্তারা ফাইল জিম্মি করে ধান্দা করছেন।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি পর্যায়ে মাদকাসক্তি পরামর্শ কেন্দ্র, মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ও মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা বা সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য ২০০৫ সালের জুনে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। এই বিধিমালার ৪ (খ) ধারায় বলা হয়েছে, ওই কেন্দ্র সুরক্ষিত পাকা বাড়িসহ আবাসিক এলাকায় হতে হবে এবং এতে পর্যাপ্ত আলো বাতাসের সুবিধাসহ নিরিবিলি সুন্দর পরিবেশ থাকতে হবে। খ ধারায় বলা আছে, ওই কেন্দ্রে একজন মাদকাসক্ত রোগীর জন্য গড়ে কমপক্ষে ৮০ বর্গফুট জায়গা থাকতে হবে এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তার জন্য সুরক্ষিত ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ ছাড়া বহুতল ভবনের তৃতীয় তলা বা তার চেয়ে ওপরের তলায় অবস্থিত হলে ওঠানামার জন্য লিফটের ব্যবস্থা থাকতে হবে। গ ধারায় বলা আছে, প্রতি ১০ বিছানার জন্য পৃথক একটি টয়লেট ও পানীয়জলের সুব্যবস্থাসহ কমপক্ষে একজন মনোচিকিত্সক (খণ্ডকালীন বা সার্বক্ষণিক), একজন চিকিত্সক, দুজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স বা বয়, একজন সুইপার বা আয়া এবং জীবনরক্ষাকারী উপকরণ ও অত্যাবশ্যক ওষুধপত্র থাকতে হবে।
এ ছাড়া প্রতি রোগীর জন্য একটি করে বিছানাসহ খাট, খাটের পাশে লকার বা টেবিল। জরুরি বিদ্যুত্ সরবরাহের জন্য জেনারেটরের ব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও অধিকাংশ কেন্দ্রে তা নেই।
ঢাকা উদ্যানে ফিউচার মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের কর্মসূচি সমন্বয়কারী সৈয়দ ইসকানদার আলী জানান, বিধিমালায় লাইসেন্স পাওয়ার জন্য যেসব শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে, তার অনেকটাই অপ্রয়োজনীয় এবং কঠিন। তাঁর মতে, মনোরোগ চিকিত্সক, একজন চিকিত্সক, দুজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স বা বয়, একজন সুইপার বা আয়া, জেনারেল ইনস্ট্রুমেন্ট সেট, রোগী বহনের ট্রলি, স্ট্রেচার, বেডপ্যান, ফ্লোমিটার ও মাস্কসহ অক্সিজেন সিলিন্ডার, সার্জিক্যাল কাঁচি, ব্লেডের কোনো প্রয়োজন নেই। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, অধিকাংশ মালামাল অব্যবহূত থাকবে। সারা দিন একজন চিকিত্সক কাজ না করে বসে থাকার পর তিনি এখানে চাকরি করতে চাইবেন না।
এ ছাড়া লাইসেন্সের শর্তে বলা আছে, আবেদনপত্রে যে ঠিকানা উল্লেখ করা হয়, সেখানেই কেন্দ্রের কাজ পরিচালনা করতে হবে। এই শর্তটিও ঠিক নয় বলে তিনি মনে করেন। তাঁর মতে, ঢাকা শহরের অধিকাংশ কেন্দ্র বাড়ি ভাড়া নিয়ে পরিচালনা করতে হয়। ফলে বাড়িওয়ালার সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেই কেন্দ্রটি অন্যত্র সরিয়ে নিতে হয়।
রোগীদের অভিযোগ: সম্প্রতি একটি নিরাময় কেন্দ্র থেকে বের হয়ে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুবক অভিযোগ করেন, তিনি যেখানে ছিলেন, সেখানে খাবারের মান খুবই নিম্নমানের। বাইরে থেকে কোনো খাবার কিনে খাওয়ার সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়েই ওই খাবার খেতে হয়েছে। খাবারের মান নিয়ে কোনো কথা বলার সুযোগ নেই। কথা বললেই শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। অথচ থাকা-খাওয়ার জন্য একেকজন রোগীর পরিবারের কাছ থেকে প্রতি মাসে পাঁচ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়।
অপর এক ব্যক্তি জানান, তিনি যে কেন্দ্রে ছিলেন, ওই কেন্দ্রে রোগীদের চিকিত্সার জন্য কিছু মাদক ব্যবহারের অনুমতি ছিল। কর্তৃপক্ষ ওই মাদক বাইরের লোকজনের কাছে বিক্রি করে থাকে। এ ছাড়া পরিবারের কাছ থেকে যে পরিমাণ টাকা আদায় করা হয়, তার একাংশ রোগীর পেছনে ব্যয় করা হয় না।
নিবন্ধনকৃত প্রতিষ্ঠান: মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চলের তৈরি করা তালিকা অনুযায়ী যেসব প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন নিয়েছে সেগুলো হলো—মধ্য বাড্ডার সেতু মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্র, এলিফ্যান্ট রোডে সেবা মাদকাসক্তি ও মানসিক রোগ চিকিত্সা কেন্দ্র, উত্তর গোড়ানে প্রশান্তি মাদকাসক্তি চিকিত্সায় মনোবিকাশ ও পুনর্বাসন সহায়তা কেন্দ্র, মোহাম্মদপুরে ক্রিয়া মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্র, মিরপুরে ফেরা মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্র, উত্তরায় লাইট হাউস ক্লিনিক, নিকুঞ্জ-২-এ দিশা মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্র, গুলশান-২-এ মুক্তি মানসিক অ্যান্ড মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র লিমিটেড, ফার্মগেটে হাইটেক মডার্ন সাইকিয়াট্রিক হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেড ও বারিধারা আবাসিক এলাকায় প্রত্যয় মেডিকেল ক্লিনিক লিমিটেড।
অবৈধ প্রতিষ্ঠান: মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকা মেট্রো উপ-অঞ্চল রাজধানীতে পরিচালিত অবৈধ কেন্দ্রের তালিকা তৈরি করেছে। এ তালিকায় যেসব কেন্দ্রের নাম স্থান পেয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—মোহাম্মদপুরের স্যার সৈয়দ রোডে বারাক, মনোচিকিত্সালয়, বাংলাদেশ ইয়ুথ ফাস্ট কনসার্স, মোহাম্মদী হাউজিংয়ে জীবনের ঠিকানা, ঢাকা উদ্যানে ফিউচার, জীবনের আলো, নিউ তরী, রায়ের বাজারে আশার আলো, আজিজ মহল্লায় নতুন জীবনে ফিরে আসা, উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরে রি-লাইফ, ৭ নম্বর সেক্টরে ফেরা, ৯ নম্বর সেক্টরে সেবা, ৪ নম্বর সেক্টরে গ্রিন লাইফ, ৩ নম্বর সেক্টরে দীপ জ্বেলে যাই, এলিফ্যান্ট রোডে নিউ মুক্তি ক্লিনিক, পশ্চিম যাত্রাবাড়ীতে নতুন জীবন মাদকাসক্তি ও চিকিত্সা পুনর্বাসন কেন্দ্র, হাদী মাদকতা হ্রাস কমপ্লেক্স, উত্তর যাত্রাবাড়ীতে দিশারী মাদকসক্তি চিকিত্সা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র, উত্তর শাহজাহানপুরে নির্বাণ মাদকাসক্তি নিরাময় ক্লিনিক, মতিঝিলে হলি লাইফ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র, বাড্ডার ছোলমাইদ পূর্ব পাড়ায় ক্লিন লাইফ, নবজন্ম, বাড্ডার এভারগ্রিন, পশ্চিম রামপুরায় সমর্পণ, রামপুরের ডিআইটি রোডে স্নেহ নীড়, খিলগাঁওয়ে আশার আলো, গ্রিন রোডে লাইফ অ্যান্ড লাইট হসপিটাল, ব্রেন অ্যান্ড লাইফ হসপিটাল, ব্রেন অ্যান্ড মাইন্ড হসপিটাল প্রাইভেট লিমিটেড, পশ্চিম পান্থপথে মনমিতা মানসিক হাসপাতাল, কাজীপাড়ায় রমজান ক্লিনিক, মিরপুর কাওলাপাড়ায় গোল্ডেন লাইফ, ফিউচার লাইফ, ফ্যায়িদ, নব স্বপ্ন পুনর্বাসন সমাজকল্যাণমূলক সংস্থা, পল্লবীতে ঢাকা মনোরোগ ক্লিনিক, লালবাগে মধুমিতা ক্রিয়া প্রকল্প ও ইস্কাটন গার্ডেন রোডে সারডা উল্লেখযোগ্য।