Thank you for trying Sticky AMP!!

রাজশাহীর পবা উপজেলার দুয়ারী এলাকায় একটি বাগানে ঝুলছে ল্যাংড়া জাতের আম

আমের শ্রেষ্ঠত্ব বিচার

প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে আমকে বলা হয়েছে শ্রীফল। এই উপমহাদেশের প্রাচীন কবি-সাহিত্যিক ও গুণীজনদের কাছে আম ফল হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন, যেখানে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু সমস্যা ভিন্ন ক্ষেত্রে। আমের রয়েছে হাজারো জাত। আর উৎকৃষ্টতার বিচারে কোন জাতের আম শ্রেষ্ঠ, এটিই হচ্ছে প্রশ্ন।

তবে আম বিশেষজ্ঞ বা আমের সঙ্গে যাঁদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা, তাঁরা জানেন এই প্রশ্নের মীমাংসা অত্যন্ত দুরূহ। এর সমাধান সম্ভবত কোনো দিনই হবে না। এর প্রধান কারণ, সমগ্র বিশ্বে আম এমন একটি ফল, যার জাত রয়েছে অসংখ্য আর উৎকৃষ্টতা ও নানা গুণে গুণান্বিত জাতের সংখ্যারও শেষ নেই। স্বাভাবিকভাবে শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের প্রশ্নটি কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুখ্য বিষয় হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে।

বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান ছাড়া পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতে যে যে জাতের আম উৎপন্ন হচ্ছে, সন্দেহ নেই সেগুলো আকারে বেশ বড়। কোনোটির রং আকর্ষণীয় কিন্তু অধিকাংশই আঁশে ভরা। স্বাদ ও সুগন্ধের মধ্যেও অনেক ফারাক।

আম-সংস্কৃতি আমাদের জীবনের নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে মিশে একাকার হয়ে আছে। আমরা লক্ষ করি, আম উৎপাদনকারী দেশ বা নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলের মানুষদের নিজ নিজ এলাকায় উৎপাদিত উৎকৃষ্ট জাতের আম নিয়ে গর্ব আর অহংকারের শেষ নেই। এরূপ ভাবনা এসেছে আঞ্চলিকতা, জাতীয়তাবোধ এবং সর্বোপরি দেশাত্মবোধ থেকে। বাংলাদেশে এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম নয়, যাঁরা বিশ্বাস করেন বাংলাদেশের ফজলি, ল্যাংড়া, ক্ষীরশাপাতি এগুলোই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আম।

একসময় সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যে রাজশাহী শহরের রায়পাড়া আমবাগানটি ছিল সার্বিকভাবে আয়তনে দীর্ঘ এবং উন্নতমানের আমগাছের সমাহারে সমৃদ্ধ। আসলে রায়পাড়া নামক মৌজায় কয়েকটি আমবাগান নিয়ে গঠিত বৃহৎ একটি আম্রকাননের নাম রায়পাড়া আমবাগান। এই বাগানে উৎপাদিত বিভিন্ন জাতের আম শহরের ব্যাপ্তি ছাড়িয়ে বাইরেও জনপ্রিয়তা লাভ করছে। আমের মৌসুমে রাজশাহী শহরের ঐতিহ্যবাহী সাহেব বাজারে এসে ভোক্তারা প্রথমেই রায়পাড়া বাগানের আম খোঁজ করেন।

নাটোর শহরের স্টেশন বাজার, নিচাবাজার তেবাড়িয়া হাট বা শহরসংলগ্ন দত্তপাড়া বাজার এবং ইদানীং গড়ে ওঠা মাদ্রাসা মোড় বাজারগুলোতে মৌসুমের শুরুতে যখন আম আসতে থাকবে, ভোক্তার দল প্রথমেই ‘কালুয়া’ নামের অতি সুস্বাদু একটি আমের সন্ধানে ব্যস্ত থাকবেন।

রাজশাহীর বাঘা, চারঘাট, পুঠিয়া অঞ্চলের লোকজনের বিশ্বাস, তাঁদের এলাকায় উৎপাদিত ফজলি আম শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীতে সেরা। মিষ্টতা, স্বাদ এবং গন্ধে এখানকার অতুলনীয় ফজলি আমের সুনাম ব্রিটিশ আমল থেকেই। আর নওগাঁর বিশেষ কয়েকটি অঞ্চলে উৎপাদিত নাক ফজলি আম সম্পর্কে এদের আস্থার সীমা অত্যন্ত উচ্চপর্যায়ে।

উত্তর ভারতের বিশেষ করে উত্তর প্রদেশ, উত্তরাঞ্চল, বিহারের পশ্চিমাঞ্চলসহ মধ্যপ্রদেশের উত্তরাংশে বসবাসরত মানুষেরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, তাঁদের অঞ্চলে উৎপাদিত দোসেহরী, চৌষা ও সামারবাহিশত শুধু ভারতে নয়, বিশ্বের উন্নত জাতের আমগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে।

রংপুরের বদরগঞ্জ ও মিঠাপুকুর উপজেলায় প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হচ্ছে হাঁড়িভাঙা আম। এ আম বৃহত্তর রংপুরসহ ঢাকা শহরেও পরিচিতি পেয়েছে। ঠাকুরগাঁও জেলার মানুষেরা তাঁদের অতি প্রিয় আম সূর্যপুরি নিয়েই আনন্দে বিভোর। দিনাজপুরবাসী তাঁদের জেলায় উৎপন্ন মিছরিভোগ আমকে সৃষ্টিকর্তার বিশেষ উপহার বলেই বিশ্বাস করেন। মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গার মানুষ তাঁদের জেলায় উৎপাদিত বোম্বাই আমের সঙ্গে অন্য কোনো আমের তুলনা করতে নারাজ। একইভাবে সাতক্ষীরাবাসী তাঁদের অঞ্চলে উৎপাদিত ল্যাংড়া ও গোবিন্দভোগ আমের প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত।

ভারতের অবস্থা আমাদের দেশের মতোই। দক্ষিণ ভারতীয়রা বিশেষ করে অন্ধ্র প্রদেশ, তামিলনাড়ু ও কর্ণাটকের লোকেরা এ কথা সহজভাবে স্বীকার করতে নারাজ যে সমগ্র ভারতে ‘আল্লামপুর বানেশান’ আমটির চেয়ে উৎকৃষ্ট কোনো আম রয়েছে। উত্তর ভারতের বিশেষ করে উত্তর প্রদেশ, উত্তরাঞ্চল, বিহারের পশ্চিমাঞ্চলসহ মধ্যপ্রদেশের উত্তরাংশে বসবাসরত মানুষেরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, তাঁদের অঞ্চলে উৎপাদিত দোসেহরী, চৌষা ও সামারবাহিশত শুধু ভারতে নয়, বিশ্বের উন্নত জাতের আমগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে।

পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও মালদহের লোকেরা মনে করেন, তাঁদের জেলায় উৎপন্ন যথাক্রমে শাদওয়ালা, কোহিতুর এবং ফজলি স্বাদে-গন্ধে উৎকৃষ্ট।

বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান ছাড়া পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতে যে যে জাতের আম উৎপন্ন হচ্ছে, সন্দেহ নেই সেগুলো আকারে বেশ বড়। কোনোটির রং আকর্ষণীয় কিন্তু অধিকাংশই আঁশে ভরা। স্বাদ ও সুগন্ধের মধ্যেও অনেক ফারাক।

আমের সৌরভ, স্বাদ, মিষ্টতা, রং, আঁশের পরিমাণ ইত্যাদি বিচার করে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ আমের জাতগুলোর নাম নিচে দেওয়া হলো।

ল্যাংড়া (বেনারস), আলফনসো, চৌষা, সাদওয়ালা, ক্ষীরশাপাতি, হিমসাগর, আনোয়ার রাতাউল, বারি আম-৪, আম্রপালি, বোম্বে গ্রিন, গোপালভোগ, গৌড়মতি, সিন্ধুরি, হিমাউদ্দিন, রানিপছন্দ, বাগানপল্লি, জর্দালু, আজিজপছন্দ, আলফান, সুরমা ফজলি, বোম্বে ইয়েলো, গুলাবখাস, জাহাঙ্গীর, খাসুলখাস, কৃষ্ণভোগ, সফদারপছন্দ (বিড়া), বাদামি, লতা, মালগোভা, মোহাম্মদওয়ালা, মল্লিকা ও সুবর্ণরেখা।

● মাহবুব সিদ্দিকী, লেখক ও গবেষক।