Thank you for trying Sticky AMP!!

পোলট্রি খাত যেখানে আটকে আছে

মো. বজলুর রহমান মোল্লা

অনেক আগে থেকে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বাড়ির উঠানে দেশি জাতের মুরগি লালন-পালন করত। ষাটের দশকে উন্নত পদ্ধতিতে মুরগি লালন-পালনের ব্যাপারে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণা শুরু হয়। ওই সময়ে পাকিস্তান এয়ারলাইনস প্রথম তাদের যাত্রীদের খাদ্য হিসেবে ব্রয়লার মুরগির চাষ শুরু করে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বিমান সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখে। কিন্তু তখন পর্যন্ত বেসরকারি পর্যায়ে কোনো উদ্যোক্তা এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসেনি। আশির দশকের শেষের দিকে ও নব্বইয়ের শুরুতে বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা সাহস করে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন শুরু করেন। ধীরে ধীরে তা শিল্পে রূপ নেয়। কাজী ফার্মস, নারিশ ও প্যারাগনের মতো বড় কোম্পানিগুলো নব্বইয়ের দশক থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বেশ বড় হয়ে ওঠে।

পোলট্রি খাতে এ সময়ে একটি পরিবর্তন আসে, উদ্যোক্তারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যান। একটি পক্ষ শুধু মুরগির বাচ্চা, ডিম ও পোলট্রি খাদ্য উৎপাদনে থেকে যায়। আর গ্রামীণ পর্যায়ে হাজার হাজার উদ্যোক্তা ছোট ছোট খামার স্থাপন করে বাচ্চা থেকে পরিণত মুরগি ও ডিম উৎপাদনে যুক্ত হন। বড় উদ্যোক্তারা মুরগি ও ডিম উৎপাদন করলেও তা পরিমাণে কম। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের চাহিদা পূরণে উচ্চ প্রযুক্তির মাধ্যমে হিমায়িত মুরগির মাংস দেশে উৎপাদন করা হচ্ছে।

দেশের পোলট্রি খাতের একটি বড় সমস্যা হচ্ছে, আমাদের এখানে মুরগি ও ডিম উৎপাদনের কাঁচামালের বড় অংশ এখনো আমদানিনির্ভর। পোলট্রি খাদ্য ও মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের কাজটি বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে হয়। আর মুরগি উৎপাদনের কাজটি হয় গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে। দেশে এখন মাথাপিছু মুরগির জোগান আছে বছরে আট কেজি। উন্নত বিশ্বে তা ৩০–৪০ কেজি। আমাদের এখানে মুরগি ও ডিমের উৎপাদন আরও বাড়ানোর সক্ষমতা উৎপাদকদের আছে। কিন্তু ডিম ও মুরগির যে দাম, তা বহন করার মতো সক্ষমতা দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের নেই। আমদানিনির্ভর কাঁচামালের কারণে চাইলেও উদ্যোক্তারা উৎপাদন খরচ বেশি কমাতে পারছেন না।

এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দেশের পোলট্রি খাত রপ্তানির বাজারে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু সেখানেও বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। কারণ, গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে যে ডিম ও মুরগি উৎপাদন হয়, তাতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং মুরগির মাংস ও ডিমের গুণগত মান ধরে রাখা কঠিন হয়ে যায়। আর বিশ্বের মুরগি ও ডিমের বাজারে ব্রাজিল-চীনের মতো বড় দেশগুলো দখল করে আছে। বাংলাদেশের পক্ষে এসব দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বিশ্ববাজারে তাদের পণ্য রপ্তানি করা বেশ কঠিন। ফলে পোলট্রি খাত তাদের সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করতে পারছে না।

বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিদেশে রপ্তানিযোগ্য মুরগির মাংস প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে। কিন্তু মুরগির মাংস ও ডিম রপ্তানি করতে হলে হিমায়িত পণ্য রাখার জন্য পর্যাপ্ত কনটেইনার ও দ্রুত সমুদ্রবন্দরে পৌঁছানোর মতো যোগাযোগ অবকাঠামো দেশে নেই। ফলে এ ধরনের দ্রুত পচনশীল পণ্যের রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশ প্রবেশ করতে পারছে না।

এ খাতের আরেকটি সমস্যা হচ্ছে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে খুব বেশি বিনিয়োগ করতে চায় না। কারণ, ২০১০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগ ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত এ খাতের অনেক উদ্যোক্তা বিপুল পরিমাণে আর্থিক ক্ষতির শিকার হন। ফলে এ খাতে সরকারি সহায়তা যেমন কম, আবার বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণও কম। যে কারণে এ খাতের উদ্যোক্তারা উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য এবং বিদেশে রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদনে বড় বিনিয়োগে যেতে পারছেন না।

দেশের পোলট্রি খাত তাই এখনো দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারনির্ভর। এ ক্ষেত্রে ভালো দিক হচ্ছে আমাদের উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগ স্থানীয়। আর তাঁদের সাহসী বিনিয়োগের কারণে দেশে মুরগি ও ডিম আমদানি করতে হয় না। তবে মুরগি ও ডিমের দাম কমাতে হলে এ খাতে আরও বেশি বিনিয়োগ দরকার। তবে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে না পারলে এ খাত বেশি দূর এগোতে পারবে না। তাই এ দায়িত্ব সরকারকে পালন করতে হবে।

ড. মো. বজলুর রহমান মোল্লা:  বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের  অধ্যাপক ও ওয়ার্ল্ড পোলট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ এর সহসভাপতি।