Thank you for trying Sticky AMP!!

অপরাধ ও বিচারের ফাঁকটা ঘোচাতে হবে

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

নারীর প্রতি সহিংসতা বহুদিন ধরেই চলছে, শুধু মাত্রাটা বেড়েছে। সাধারণত এগুলো চোখের আড়ালে থেকে যায়, সমাজ জেগে উঠলে সামনে আসে। এখন চারদিকে প্রতিবাদ হচ্ছে, এ জন্য সবার দৃষ্টিতে এগুলো আসছে। আইনের শাসনের অভাবে অপরাধীর শাস্তি হয় না, এ অবস্থায় অপরাধী আর ভয় পায় না।

এসব অপরাধের ক্ষেত্রে অনেকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা বলেন, কিন্তু সঠিক বিচারে যে শাস্তি হবে, তা-ই তো দৃষ্টান্তমূলক। হঠাৎ একটা শাস্তি দিয়ে তাকে দৃষ্টান্তমূলক বললে তাতে আইনের শাসনের দুর্বলতাটা আড়ালে চলে যায়। আমাদের দাবি হওয়া উচিত প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রকৃত শাস্তির ব্যবস্থা করার। তাতে অপরাধ কমে আসবে।

অপরাধীরা যখন ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনগুলোর সঙ্গে জড়িত থাকে, তখন তারা মনে করে, রাজনীতির ক্ষমতা তাদের পার করে দেবে। অপরাধীদের প্রতি এমন সব ব্যক্তির সমর্থন থাকে, যারা কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত।

অপরাধীদের বিস্তার বেড়ে যাওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ হচ্ছে তৃণমূলের সত্যিকার রাজনীতিবিদদের দূরে সরিয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসা ব্যক্তিদের সুযোগ করে দেওয়া। যারা রাজনীতির ভালো দিকগুলোর চর্চা করেন, তাঁরা নিষ্ক্রিয় হলে একটা শূন্যতা তৈরি হয় এবং ভুঁইফোড় রাজনীতিবিদেরা তা ভরাট করে। এরা নিজেদের স্বার্থ আদায়ের জন্য রাজনীতিকে ব্যবহার করে। স্থানীয় রাজনীতিতে টাকা ঢালে। সেই টাকা তারা ব্যবসায়িক কৌশল খাটিয়ে রাজনীতি থেকেই তুলে নেয়।

এই কাজটি করতে গিয়ে অপরাধীদের তারা ব্যবহার করে, তাদের পিঠে একটা হাত রাখে। বিপদ দেখলে সেই হাত আবার সরিয়েও নেয়। সিলেটের এমসি কলেজের সাম্প্রতিক ঘটনার সঙ্গে যেসব রাজনীতিবিদের সংযুক্তির খবর এসেছে, তারা এই শ্রেণির। এদের কোনো আদর্শ নেই, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তো দূরের কথা। প্রকৃত রাজনীতিবিদদের সঙ্গে অপরাধীদের সংযোগ থাকে না। কিন্তু তাদের সংখ্যা কমছে।

অপরাধকে ঘৃণা করেন দেশের বেশির ভাগ মানুষ। কিন্তু যে অপ্রতিরোধ্যভাবে অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে যে পরিমাণ ক্ষোভ ও প্রতিবাদ সৃষ্টি হওয়ার কথা, তা অনেক দিন ধরে হচ্ছিল না। দেশের নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক নানা সংগঠন—যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছিল, তারা যেন শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। এর পেছনেও অনেক কারণ রয়েছে। প্রতিপক্ষ পরাক্রমশালী হলে প্রতিবাদ বিপদ ডেকে আনে। জেল-জুলুম হয়। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের জন্য স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা যখন রাস্তায় নামল, তখন তাদের ওপর হামলা করল হাতুড়ি ও হেলমেট বাহিনী। হামলাকারীদের কিছুই হলো না, মাঝখানে একটা ব্যতিক্রমী আন্দোলন জোর হারিয়ে ফেলল।

এ ক্ষেত্রে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকার কথা আসে। এই বাহিনীগুলোতে যেসব তরুণ কর্মকর্তা আছেন, তাঁদের মধ্যে আগ্রহ আছে পরিবর্তনের। কিন্তু ঘুণে ধরা রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো তাঁদের সেই সুযোগ দেয় না। যে উপনিবেশী পদ্ধতিতে চলছে আমাদের রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান, তা তাঁদের উদ্যম কেড়ে নেয়। এই পদ্ধতি থেকে ভালো কিছু আশা করা যায় না। এই পদ্ধতি পুরোটা বদলাতে না পারলেও এর প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলোও যদি আমরা করতে পারতাম, তাহলে সমস্যা এত গভীর হতো না।

তবে কয়েক দিন ধরে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা পরিবর্তনের একটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। সিনহা (বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান) হত্যার পর সব প্রতিষ্ঠান সক্রিয় হওয়ায় ক্রসফায়ার আপাতত বন্ধ হয়ে গেছে। অপরাধ হলেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা বলা হয়। কিন্তু আমরা চাই না একটা-দুটো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে আন্দোলন থামিয়ে দেওয়া হোক। তাই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না চেয়ে আমাদের দাবি হোক নিরন্তর সুবিচার এবং অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি। এ জন্য রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন হবে, তবে আন্দোলন চলতে থাকলে সেই সদিচ্ছা জাগবে।

লেখক: শিক্ষাবিদ