Thank you for trying Sticky AMP!!

অবরুদ্ধ দেশে মুক্তির কবিতা

শুরু হলো বিজয়ের মাস। ৯ মাসের যুদ্ধদিনের নানা স্মৃতিচিহ্ন ধরে রেখেছে প্রতিরোধ আর সংগ্রামের নানান কাহিনি। এ রকমই কিছু স্মৃতিচিহ্নের কথা
শামসুর রাহমান

ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত, দিনগুলোও যেন নিকষ আঁধারে ঢাকা। ১৯৭১ সালের মে বা জুন মাস। অবরুদ্ধ ঢাকার বন্দিশিবিরে নিজ বাসভূমে সবাই পরবাসী। অগ্নিগর্ভ পুরো বাংলাদেশ। চারদিকে ফৌজি জিপের গর্জন, বুটের মর্মভেদী শব্দ, আগুন, আর্তনাদ আর মৃত্যু। এর মধ্যে পুরান ঢাকার ৩০ নম্বর আশেক লেনের বাসায় বসে প্রবল ক্রোধে কবিতা লিখছেন এক কবি:
এ দেশে আমি আজ দমবন্ধ
এ বন্দী শিবিরে
মাথা খুঁড়ে মরলেও পারি না করতে উচ্চারণ
মনের মতন শব্দ কোনো।
(‘বন্দী শিবির থেকে’)

একাত্তরের সেই দমবন্ধ বন্দিশালায় বসে গেরিলাযোদ্ধার মতো সন্তর্পণে একের পর এক পঙ্‌ক্তি রচনা করছিলেন একজনই, ‘ভ্রমরের গানে/ কান পেতে থাকাও ভীষণ বেমানান/ আজকাল। সৈন্যদল অদূরেই দাগছে কামান।’ (‘প্রতিশ্রুতি’)। পরে ডিসেম্বর ১৯৭১-এ এই কবিতাগুচ্ছের দুটো যখন ছাপা হলো কলকাতার বিখ্যাত দেশ পত্রিকায়, সবাই জানল সেই কবির নাম: মজলুম আদিব।

লিখতে বসেছি কবি শামসুর রাহমানের ১৯৭১-এ লেখা কবিতার ডায়েরি নিয়ে। যে রুলটানা খাতায় লেখা হয়েছিল ‘স্বাধীনতা তুমি’ বা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’র মতো অম্লান কবিতা। খাতাটি এখন আমাদের যুদ্ধদিনের অনন্য স্মারক। সংরক্ষিত রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। ২০০০ সালে কবি নিজেই এটি দিয়েছিলেন তাদের।

কিন্তু এ লেখার শুরুতে কেন বলা হলো মজলুম আদিবের কাহিনি?

রহস্যটি মুলতবি থাক। আগে শোনা যাক শামসুর রাহমানের যুদ্ধদিনের খাতার কবিতাগুলো কীভাবে সবার হয়ে উঠল, সেই গল্প।

খাতার ধূসর পৃষ্ঠায় লেখা কবিতাগুলো আশঙ্কা-আতঙ্কের মধ্যে লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাত ধরে গোপনে পার হচ্ছে সীমান্ত-গোটা ব্যাপারটার মধ্যে আছে ভয়ংকর এক যুদ্ধ। জীবনবাজি রেখে কবির এ এক ভিন্ন সমর বটে।

শুরুটা ২৫ মার্চের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর। ২৭ মার্চ কারফিউ শিথিল হলে ভয়াল ঢাকা থেকে আরও অনেকের মতো পরিবার-পরিজনসহ তখনকার দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার সহকারী সম্পাদক কবি শামসুর রাহমান আশ্রয় নিলেন নিজের গ্রাম—নরসিংদীর রায়পুরার পাড়াতলীতে। এপ্রিলের প্রথমার্ধে তাঁর কাছে এলেন এক যুবক। ‘যেভাবে লেখা হলো: বন্দী শিবির থেকে’ শিরোনামে রচনায় কবি লিখছেন, ‘একদিন হাজির হলো মতি, মতিউর রহমান (এখন প্রথম আলো সম্পাদক)। তখন তো তরুণ। মাথায় একটা পট্টি পরা, যাতে কেউ চিনতে না পারে।...আমার কাছে এসে বলল, “চলেন ওপারে যাই।”...আমি আমার মার কাছে গিয়ে বললাম।...মা আমার চোখের দিকে তাকালেন। বললেন, “তুমি আমাদের এখানে ফেলে চলে যাবে!”...আমি আর পারলাম না।’ (সূত্র: ২৮ অক্টাবর ২০০৫, প্রথম আলো)

এই বেদনাবোধই কি সেই যুদ্ধপ্রহরে এক দিনে মিনিট দশেকের ব্যবধানে শামসুর রাহমানকে দিয়ে লিখিয়ে নিল মানুষের মুখে মুখে ফেরা দুই যমজ কবিতা? এপ্রিলে কবির খাতায় জমা হলো যুদ্ধদিনের প্রথম শব্দ। এ প্রসঙ্গে কবির ভাষ্য, ‘একদিন সকাল ১১টার দিকে ঘর থেকে বেরিয়ে পুকুরের পাড়ে একটা গাছের ছায়ায় বসে আছি।...হঠাৎ আমার মনে স্ট্রাইক করল একটা কবিতার লাইন। আমি চট করে উঠে গেলাম।...এক চাচাতো ভাই, ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভে পড়ত, তার কাছ থেকে একটা রুলটানা খাতা ও একটা পেনসিল নিলাম। নিয়ে এসে পুকুরের পাড়ে বসলাম এবং পর পর দুটো কবিতা লিখে ফেললাম: “স্বাধীনতা তুমি” এবং “তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা”।’

কবির ওই খাতাটি ছিল ১৯৬৯ সালের একটি ডায়েরি। এ ডায়েরিতে গ্রামে বসে লেখা হয়েছিল ওই দুটিমাত্র কবিতাই। দেড় মাস পর অনেকটা বাধ্য হয়েই তিনি ফিরলেন তাঁর স্মৃতির শহরে, ঢাকায়-৩০ নম্বর আশেক লেনে। দিন কয়েকের বিরতিতে মনস্থির করলেন, ‘আমি আবার লিখবই’। ফলে সেই খাতায়ই চলল যুদ্ধ। লিখলেন আরও কবিতা—‘বন্দী শিবির থেকে’, ‘প্রবেশাধিকার নেই’, ‘পথের কুকুর’, ‘কাক’, ‘প্রতিশ্রুতি’, ‘মধুস্মৃতি’, ‘গেরিলা’, ‘জনৈক পাঠান সৈনিক’ প্রভৃতি।

এসব কবিতাই সেদিনের তরুণ মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত চৌধুরী ও (বিচিত্রা২০০০-এর সম্পাদক) হাবিবুল আলম বীর প্রতীকের হাত ঘুরে আবুল বার্‌ক আলভীর মাধ্যমে হাজির হলো কলকাতায়। আবার মফিদুল হকের মারফত এই কবিতাগুলোর আরেক সেট পৌঁছেছিল আগরতলায়ও। (সূত্র: শামসুর রাহমান: আলোর পথের যাত্রী, আকাশভরা সূর্যতারা, মতিউর রহমান)। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হকের কথায় ফুটে ওঠে সেই যুদ্ধ-সময়, ‘অবরুদ্ধ শামসুর রাহমান কবিতাগুলো সীমান্তের ওপারে পাঠাতে তখন উদগ্রীব ছিলেন। বিভিন্নজনের কাছে পাঠিয়েছেন। হাতে লিখে কপি করে আমরা নিয়ে যেতাম সেগুলো।’

আত্মজীবনী কালের ধুলোয় লেখাতে শামসুর রাহমান জানাচ্ছেন, ‘অত্যন্ত গোপনীয়তার মধ্যে চলছিল আমার এই অভিযাত্রা। আমার স্ত্রী, দু-চারজন সুহৃদ এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জানতেন সে কথা। খানাতল্লাশির মরশুমে, ধরপাকড়ের হিড়িকে এই ডায়েরিকেও গা ঢাকা দিতে হয়েছে বারবার। কখনো কোনো আত্মীয়ের বাসায়, কখনো শাড়ির ভাঁজে, কখনো-বা রান্নাঘরের সামান্য মশলার নিচে। কয়েক মাসে ভরে উঠল আমার ডায়েরির পাতা, যুগল মলাটের পাহারায় আমার কবিতাবলি এক ভয়ানক তিমিরাচ্ছন্ন ঋতুর ফসল।’

অবশেষে ‘তিমিরাচ্ছন্ন ঋতুর ফসল’ গন্তব্য পেল, খাতার কবিতাগুলো পৌঁছে গেল যশস্বী লেখক ও সমালোচক আবু সয়ীদ আইয়ুবের হাতে। এর মধ্য থেকে চারটি কবিতা তিনি ছাপতে দিলেন দেশ-এ। ১৮ ও ২৫ ডিসেম্বর দুই কিস্তিতে কবিতাগুলো যখন আলোর মুখ দেখল, তার কদিন আগে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু আইয়ুব এ কবিতাগুচ্ছ ছাপতে দিয়েছিলেন বেশ আগে-চূড়ান্ত মুক্তির স্বাদ আমাদের কাছে তখনো অধরা।

তবে এখানে একটি ঘটনা ঘটল—শামসুর রাহমান নয়, দেশ-এ কবিতা ছাপা হলো মজলুম আদিব নামে! মজলুম আদিব অর্থ নির্যাতিত লেখক। তখনকার অবরুদ্ধ বাস্তবতায় স্বনামে শামসুর রাহমানের কবিতা প্রকাশ পেলে তাঁর ক্ষতি হতে পারে। সতর্কতামূলক নাম বদলের ব্যবস্থা তাই আইয়ুবই নিয়েছিলেন।

আরও এক উদ্যোগ ছিল তাঁর ও তাঁর সহধর্মিণী গৌরী আইয়ুবের—শামসুর রাহমানের কবিতার খাতাটি বই হিসেবে বের করার এন্তেজাম তাঁরা করেছিলেন যুদ্ধের মধ্যেই।

পরে পুর্ণেন্দু পত্রীর প্রচ্ছদে কলকাতার অরুণা প্রকাশনী থেকে বই হয়ে বেরোল বাংলাদেশের যুদ্ধদিনের স্মারক এই কবিতার খাতা। ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে বন্দী শিবির থেকে শিরোনামে বইটি প্রকাশ পেল শামসুর রাহমানের নামেই। ক্ষুদ্র এ পুস্তকে তখন ঠাঁই পেয়েছিল মাত্র সাত কি আটটি কবিতা। পরে ’৭৬ সালে অরুণা প্রকাশনী থেকেই বেরোল দ্বিতীয় সংস্করণ। এরপর বইটি প্রকাশিত হলো বর্ধিত কলেবরে, বাংলাদেশের প্রকাশনা সংস্থা চট্টগ্রামের বইঘর থেকে।

শামসুর রাহমান বা মজলুম আদিবের অসামান্য কবিতার খাতাটির প্রতিটি পৃষ্ঠায় সাল হিসেবে জ্বলজ্বল করে ১৯৬৯। তবে পৃষ্ঠাগুলো, লেখাগুলো, কবিতাগুলো কথা বলে ১৯৭১ সালের বিস্ফোরণোন্মুখ ভাষায়। তারা বলে যে ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’

শারীরিকভাবে শামসুর রাহমান এখন নেই, কিন্তু তাঁর যুদ্ধদিনের ‘যেমন ইচ্ছে লেখার’ সেই কবিতার খাতাটি-কবিতাগুলো আজও প্রেরণা দেয়। নিরন্তর আমাদের শেখায় দুঃখতাড়ানিয়া মুক্তির গান।