Thank you for trying Sticky AMP!!

অবহেলা, উদাসীনতায় করোনা পরিস্থিতির অবনতি

নতুন ভেরিয়েন্ট দেশে এসেছে জানুয়ারিতে। এক মাস আগে থেকে সংক্রমণ বাড়তে দেখা গেছে। কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী হয়নি।

করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচলের নির্দেশনা থাকলেও মানা হচ্ছে না। মুখে মাস্ক নেই বেশির ভাগ যাত্রীর। মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব। গতকাল বিকেলে শরীয়তপুরের সুরেশ্বর এলাকায়, শরীয়তপুর থেকে ঢাকাগামী লঞ্চে

মার্চের শুরুতেও পরীক্ষার তুলনায় করোনা রোগী শনাক্তের হার ছিল ৪ শতাংশের সামান্য বেশি। মাসের শেষে এসে গতকাল মঙ্গলবার শনাক্তের হার হয়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ। ৩০ দিনে সংক্রমণরেখা সোজা ঊর্ধ্বমুখী। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। স্বাস্থ্য বিভাগের অবহেলা আর স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে মানুষের উদাসীনতায় সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে।

সংক্রমণ এখন সারা দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। নমুনা পরীক্ষায় তা ধরা পড়ছে, আর জানা যাচ্ছে মৃত্যুর সংখ্যায়। গতকাল সারা দেশে ৫ হাজার ৪২ জন নতুন রোগী শনাক্তের তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আর মারা গেছেন ৪৫ জন। একইসংখ্যক মানুষ মারা যান আগের দিন, সেদিন অবশ্য আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি ছিল।

বরাবরের মতো সংক্রমণ ও মৃত্যু ঢাকায় বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বলছে, রাজধানীতে কোভিডের জন্য নির্ধারিত ১৯টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে শয্যা খালি ছিল মাত্র ৭২০টি। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নির্ধারিত শয্যার চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি ছিলেন। ওই হাসপাতালসহ সাতটি হাসপাতালে আইসিইউর কোনো শয্যা খালি ছিল না। ঢাকার বাইরে অন্য সব বিভাগেও নির্ধারিত হাসপাতালে খালি থাকা শয্যা দ্রুত কমে আসছে। স্বাস্থ্য বিভাগের তিন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা দেশের করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে বর্ণনা করেছেন।

সংক্রমণ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার পর নির্দেশনা এল। ১৮ দফা নির্দেশনা অনেকটা উইস লিস্ট বা ইচ্ছা তালিকার মতো। বাধ্যতামূলক কিছু না করলে এই প্রজ্ঞাপন সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কোনো কাজে আসবে না।
বে-নজির আহমেদ, জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক

সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গত পরশু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৮ দফা করণীয় ঠিক করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এসব সিদ্ধান্ত সারা দেশে আপাতত দুই সপ্তাহ বলবৎ থাকবে। এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দপ্তর, বিভাগ ও সংস্থাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এসব নির্দেশনা কতটা কাজে আসবে, তা নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ তৈরি হয়েছে। বলা হচ্ছে, এসব নির্দেশনা কে বাস্তবায়ন করবে, কে নজরদারি করবে, তা স্পষ্ট নয়।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘সংক্রমণ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার পর এসব নির্দেশনা এল। ১৮ দফা নির্দেশনা অনেকটা উইস লিস্ট বা ইচ্ছা তালিকার মতো।’ বাধ্যতামূলক কিছু না করলে এই প্রজ্ঞাপন সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কোনো কাজে আসবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) নাসিমা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং স্থানীয় প্রশাসনকে উদ্যোগী হতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগের একার পক্ষে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না।’

একটি দফায় বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার কথা বলা আছে। কিন্তু এ নিয়ে সমালোচনা আছে। সমালোচনা আছে টিকার ব্যাপারেও। সব ছাপিয়ে মানুষের মনে বড় প্রশ্ন সংক্রমণের বর্তমান ধাক্কা কত দিন চলবে।

রূপান্তরিত ভাইরাস

অণুজীববিজ্ঞানী ও চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী প্রধান সমীর সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা করোনাভাইরাসের জিন বিশ্লেষণ করে দেখেছি, এ দেশের মানুষের মধ্যে ইউকে ভেরিয়েন্ট এখন আছে, এ দেশের মানুষের মাধ্যমেই তা ছড়াচ্ছে। সুতরাং যুক্তরাজ্য বা ইউরোপ থেকে আসা যাত্রীদের কোয়ারেন্টিন করে ইউকে ভেরিয়েন্টের বিস্তার বন্ধ করা যাবে না।’

গত বছর ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্যে এই ভেরিয়েন্ট প্রথম শনাক্ত হয়। এর সংক্রমণ হার অনেক বেশি। আইইডিসিআর জানিয়েছিল, বাংলাদেশে এই ভেরিয়েন্ট প্রথম শনাক্ত হয় ৫ জানুয়ারি। তখন যুক্তরাজ্য থেকে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিন ঠিকভাবে করা হয়নি বলে অভিযোগ আছে। যাত্রীদের কখনো চার বা সাত দিন কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে। অনেকে প্রভাব খাটিয়ে নির্ধারিত হোটেলে না থেকে বাড়িতে চলে গেছেন। সরকার বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ নেয়নি।

জনস্বাস্থ্যবিদ বে-নজির আহমেদ বলেন, যুক্তরাজ্য থেকে আসা ব্যক্তিদের যথাযথ কোয়ারেন্টিন করা দরকার ছিল। ইউকে ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা, অর্থাৎ কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং ঠিকমতো করা হলে সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতো।’

সংক্রমণ পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বর্ণনা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ‘বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতির জন্য শুধু ইউকে ভেরিয়েন্টই একমাত্র কারণ, তা নয়। বিগত মাসগুলোতে প্রচুর সামাজিক অনুষ্ঠান হয়েছে, পর্যটনকেন্দ্রে উপচে পড়া ভিড় হয়েছে—এগুলো সংক্রমণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।’

ধাক্কা কত দিনের

করোনা সংক্রমণ নিয়ে অনেক পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। শুধু বিদেশে নয়, এ দেশেও এসব হয়েছে। কিন্তু কোনো অনুমান ঠিকঠাক মিলেছে, এমন নজির নেই। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে বলে যে কথা বলেছিলেন, তা-ও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সংক্রমণের বর্তমান ধারা কত দিন চলতে পারে, তা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন আছে।

গতকাল মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ‘১৪ দিন পর হয়তো সংক্রমণের রাস টেনে ধরা সম্ভব হবে।’ ১৪ দিন কেন বা এর ব্যাখ্যা কী, এমন প্রশ্নের উত্তরে মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ‘১৪ দিনকে করোনা সংক্রমণের ইনকিউবেশন পিরিয়ড (সুপ্তাবস্থা) ধরা হচ্ছে। ধারণা করা যায়, এখনই মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মানা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে কড়াকড়ি করলে সংক্রমণের ওপর প্রভাব পড়বে। আজ কড়াকড়ি ব্যবস্থায় গেলে ১৪ দিন পর পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, তা বলা সম্ভব হতে পারে।’

তবে মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মানা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে কড়াকড়ি করা ছাড়া সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বপূর্ণ অন্য পদক্ষেপ এখন নেওয়া সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করছেন আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরীন। তিনি বলেন, ‘এখন দিনে পাঁচ হাজার রোগী শনাক্ত হচ্ছে। তাঁদের সংস্পর্শে কত মানুষ এসেছিলেন, তাঁদের খুঁজে বের করার মতো জনবল নেই, এখন তা সম্ভব নয়।’

এরই মধ্যে ২ এপ্রিল দেশে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এবার ১ লাখ ২২ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেবেন। ৫৫টি কেন্দ্রে এই পরীক্ষা হবে। পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে আরও প্রায় সমানসংখ্যক অভিভাবক কেন্দ্রে উপস্থিত হবেন। তবে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম এনায়েত প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করব।’

টিকায় অস্পষ্টতা

করোনার টিকা নেওয়ার পর ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন, এমন অন্তত দুই রোগীর উপসর্গের তীব্রতা কম হতে দেখা গেছে। বিজ্ঞানীরাও বলছেন, টিকা নিলে রোগের তীব্রতা কম হবে, মৃত্যুঝুঁকি কমবে। তবে টিকার মজুত কমে আসছে। টিকার পরবর্তী চালান ঠিক কবে আসবে, তা অনেকটাই অস্পষ্ট। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাতৃ, নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচির পরিচালক শামসুল হক বলেন, ‘আমরা ঠিক জানি না পরবর্তী চালান কবে আসবে।’

দেশে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত টিকা দেওয়া হচ্ছে। সরকার এ পর্যন্ত ১ কোটি ২ লাখ টিকা পেয়েছে। ৩২ লাখ টিকা পেয়েছে ভারত সরকারের উপহার হিসেবে। বাকি ৭০ লাখ টিকা কিনেছে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে। সরকার, বেক্সিমকো ফার্মা ও সেরাম ইনস্টিটিউটের মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী তিন কোটি টিকা কিনেছে সরকার। বেক্সিমকোর প্রতি মাসে ৫০ লাখ টিকা সরবরাহ করার কথা। প্রতিষ্ঠানটি জানুয়ারি মাসে ৫০ লাখ টিকা সরবরাহ করেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে ৫০ লাখের পরিবর্তে ২০ লাখ সরবরাহ করেছে। মার্চ মাসে কোনো টিকা সরবরাহ করেনি। কবে পরের চালান আসবে কেউ জানে না। গতকাল চেষ্টা করেও বেক্সিমকোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

গতকাল পর্যন্ত ৫৩ লাখ ১৯ হাজার ৬৭৯ জনকে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। তাঁদের সবাইকে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার মতো টিকার মজুত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নেই। ৮ এপ্রিল দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেওয়া শুরু হবে।

আন্তর্জাতিক উদ্যোগ কোভ্যাক্স থেকে টিকা পাওয়ার কথা বলেছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। সে ব্যাপারে শামসুল হক বলেন, ‘নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না কোভ্যাক্সের টিকা কবে পাওয়া যাবে।’