Thank you for trying Sticky AMP!!

অভিনব স্কুলের স্রষ্টা

অনলাইনে ক্লাস নিচ্ছেন আয়মান সাদিক। ছবি: খালেদ সরকার

আজ একজন সাহসী ছেলের কথা বলব। তাঁর বাবা সামরিক কর্মকর্তা। এমনও নয় যে তিনি মফস্বলে থাকতেন। পড়েছেন ঢাকার স্কুলেই। নিয়মমাফিক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা জজ-ব্যারিস্টার হওয়ার মতোই তাঁর পারিবারিক অবস্থা। তিনি এক সকালে উঠে বললেন, ‘আমি স্কুলশিক্ষক হব। ছাত্র পড়াব।’

তাঁর সেই অভিনব স্কুলের শুরুটাও খুব মজার। তাঁর সঙ্গে আমি প্রায়ই ঢাকার বাইরে যাই বিভিন্ন সেমিনারে। আজকে একটা সত্যি কথা বলে ফেলি, আমি আসলে তাঁর বক্তব্য শুনতে যাই। যোগাযোগের এত অপূর্ব ক্ষমতা যে কারও থাকতে পারে, না শুনলে আপনি বুঝবেন না। তিনি যদি ঠিক করেন এই বিষয়টা আজকে কারও মাথায় ঢোকাবেন, তিনি ঢুকিয়েই ছাড়বেন। অসামান্য স্তরে তাঁর যোগাযোগ দক্ষতা।

একদিন তিনি ঠিক করলেন, ‘এই যোগাযোগ দক্ষতাটাকেই আমি কাজে লাগাব। এবং আমি নিশ্চিত, আমার মতো এ রকম আরও অনেকেই আছে।’ তিনি কী করলেন, তাঁর মতো ছেলেমেয়েদের এক করলেন। তারপর তাঁরা মিলে ঠিক করলেন, পুরো বাংলাদেশকে তাঁরা পড়াবেন। এবং শুরুটাও করে ফেললেন।

এই লেখাটা যখন লিখছি, তখন তিনি আদতেই বাংলাদেশের সবচেয়ে কনিষ্ঠ হেডমাস্টার। তাঁর ভার্চ্যুয়াল স্কুল আছে ৬৪ জেলায়। ৪ হাজার ইউনিয়নের ছাত্রছাত্রীরা ঘরে থেকেই তাঁদের পড়ার টেবিলে বসে তাঁর পাঠ নিতে পারছে।

তিনি ভার্চ্যুয়াল পরিসরে ‘টেন মিনিট স্কুল’-এর প্রতিষ্ঠাতা।

তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় বছরখানেক আগে। তাঁকে প্রথম প্রশ্নটা করলাম, ‘স্কুলের নামটা এমন দিলেন কেন?’

‘ভাইয়া, টেন মিনিট আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আম্মা হয়তো ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করছে, কখন বাসায় আসবি? আমরা বলি, টেন মিনিট লাগবে, আম্মা। আব্বা হয়তো আম্মাকে বলছে, সাজগোজ শেষ হলো? উত্তর, আর দশ মিনিট লাগবে। চাচা হয়তো আব্বাকে বলছে, খাওয়া শেষ হলে আয়। দশটা মিনিট দাঁড়াও, প্লিজ! এই দশ মিনিটে যদি আসা-যাওয়া-সাজগোজ-খাওয়া-নাওয়া হতে পারে, তাহলে পড়াশোনা কেন হবে না?’

তিনি আরও বিশদ করে বলেন, ‘আপনি নরসিংদী থাকেন, আজকে স্কুলের উপপাদ্যটা বুঝতে পারেননি? আমি দশ মিনিটে অনলাইনে বুঝিয়ে দেব আপনাকে। আপনি গফরগাঁওয়ে থাকেন, রচনার পয়েন্টস কীভাবে আরও চমকপ্রদ করা যায়, বুঝতে পারছেন না? দশ মিনিটে বুঝিয়ে দিই, আসেন।’

আমি অবাক হয়ে তাঁর কথা শুনতে থাকি। এখনো দেখা হলে অবাক হয়েই শুনি।

তাঁর ছাত্রছাত্রীরা এখন আর ক্লাস ওয়ান থেকে টেনের মধ্যেই আটকে নেই। এসএসসি আর এইচএসসি শেষ করে ভর্তি পরীক্ষার পাঠও তারা নিচ্ছে।
বুয়েটে ভর্তি হতে চাইলে এই ভার্চ্যুয়াল ক্লাসরুমে ঢুকে পড়ো। তুমি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছ? ওই উইন্ডোতে আসো। মাস্টার্স? এমবিএর ভাইভা কাল? তাহলে এই উইন্ডো।
তুখোড় তুখোড় একদল ছেলেমেয়ে তাঁর ফ্যাকাল্টিতে আছেন—রাইদ, শামস, জিহান, মুনজেরিন, জুবায়ের, সাদমান, ইহসান, শামি—নাম বলে শেষ করা যাবে না। দলটা তাঁদের ভারী হয়েই চলেছে। ফ্যাকাল্টি সদস্য এখন ৫২ জন। প্রতি মাসেই তিন-চারজন করে যুক্ত হচ্ছেন। তাঁরা দশ মিনিটে মুশকিল আসান করে দিচ্ছেন পড়াশোনার। ওই যে বললাম, সাহসী ছেলের কথা বলব। কেউ সাহস দেখায় নিজে পরিবর্তিত হতে, কেউ সাহস দেখায় পুরো ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে। তাদের সংখ্যা হয়তো লাখে এক।
এই লাখে এক ছেলেটার নাম আয়মান সাদিক। সাহস দেখিয়ে তিনি এগিয়ে এসেছেন গতানুগতিক জীবনটাকে ঝেড়ে ফেলে। তাঁর সাহস, এ রকম আরও বহু আয়মানকে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছে। সাহস মানে কিন্তু ভয়ের অনুপস্থিত থাকা নয়। সাহস হলো সেটা, ভয়কে দেখেও যেটা এগিয়ে যেতে দমে যায় না। আয়মান এটা দেখাতে পেরেছেন।
ভয় তো অবশ্যই ছিল। আইবিএ থেকে বিবিএ পাস করে এই সিদ্ধান্ত নিলেন ‘চাকরিতে যোগ দেব না’, ব্যাপারটা তো তাঁর নিজের ক্যারিয়ারের জন্য ভয়েরই ছিল। পরিবারের সবচেয়ে বড় ছেলের মুখে ‘আগে দেশ গড়ব, পরে নিজেকে’, ব্যাপারটা অবশ্যই ভয়ের ছিল তাঁর পরিবারের জন্য।
প্রথম প্রথম তাঁর বাবা-মাকেই বিব্রত হতে হতো, তাঁদের ছেলে কী করে এই উত্তর দিতে গিয়ে। পাশের বাসার ভাবি হয়তো বলছেন, ‘ছেলের তো পড়ালেখা শেষ, এখন কী করছে?’
‘ভিডিও বানায়।’

‘ক্যামেরাম্যান? কিসের ভিডিও বানায়, বিয়েশাদির?’

‘না, না। সে রাত জেগে জেগে কিসের জানি ভিডিও বানায়।’

‘ও আল্লাহ, বলেন কী!’

পাড়ায় রটে যায়, আয়মানের কাছ থেকে দূরে থাকবে। সে কী জানি ভিডিও বানায় রাত জেগে জেগে।

কে কী মনে করল তা থোড়াই কেয়ার করে আয়মান এগিয়ে যেতে থাকলেন। টিউশনি করে সেই টাকা দিয়ে চালিয়ে যেতে থাকলেন তাঁর অনলাইন ক্লাস। দিনে চারটি টিউশনি পর্যন্ত করেছেন। টেন মিনিট স্কুলে প্রথম স্পনসর আসার আগে তাঁর টিউশনি করে তোলা আট লাখ টাকার পুরোটাই এখানে দিয়েছেন। সাহস এক মুহূর্তের জন্যও হারাননি। হাসিমুখেই ছিলেন।

গফরগাঁও বা কিশোরগঞ্জের সেই ছেলে বা মেয়েটার এগিয়ে যাওয়াই যে তাঁকে দারুণ অনুপ্রাণিত করছে। ঢাকায় থেকেই ঢাকার বেড়াজাল ভেঙে এগিয়ে যান এই হাসিমুখো ছেলেটা।

আমরা সাহস পাই তাঁর সাহস দেখে। মনে আছে, হুমায়ূন আহমেদের আগুনের পরশমণি চলচ্চিত্রে বোমা হাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গিয়ে বলা এক মুক্তিযোদ্ধার সংলাপ? ‘আমরা এসেছি এই বিল্ডিংটা উড়িয়ে দিতে, আমরা মুক্তিবাহিনীর ছেলে।’

‘মুক্তিবাহিনী, সেটা আবার কী?’

ঠাস করে একটা চড়ের শব্দ হয়েছিল সেই দৃশ্যে। আবহে তখন বাজছে, ‘মৃত্যুর কোলে মাথা রেখে তারা জীবনের গান গায়’। আমরা সাহস পাই সেই সাহসটা দেখে, যেটা ভয়কে দেখেও এগিয়ে যেতে দমে যায় না। ঠাস করে সমাজকে একটা চড় দিয়ে বলে, ‘আমরা মুক্তির ছেলে।’

আরিফ আর হোসেন: সহপ্রতিষ্ঠাতা, আমরাই বাংলাদেশ।