Thank you for trying Sticky AMP!!

অর্থনৈতিক সংকটে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ববাজারে কিছু পণ্যের সরবরাহে টান পড়েছে এবং লাফিয়ে লাফিয়ে এসব পণ্যের দাম বাড়ছে। দুর্ভাগ্যক্রমে সেগুলোর প্রতিটি পণ্য বাংলাদেশের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় আমদানি পণ্য। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের অতিমূল্যের প্রভাব ইতিমধ্যেই আমাদের আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রেও দেশের বাজার যেভাবে অস্থির হয়ে পড়েছে, সরকার কার্যত তা সামাল দিতে পারছে না। বাকি দুটি পণ্য—রাসায়নিক সার ও গম বেশি দামেও আমদানি করা যাবে কি না, তা নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

রপ্তানি আয় কোভিড-পরবর্তী সময়ে চাঙা হয়ে উঠলেও তা আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। আবার রেমিট্যান্স আয় না বেড়ে বরং কমেছে। এর ফলে বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আগামী মধ্যমেয়াদি সময়ে মেগা প্রকল্পগুলোর জন্য নেওয়া ঋণ পরিশোধের পরিমাণও দ্রুত বাড়বে। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাজারে ছেড়ে ডলারের মূল্য কমিয়ে রাখা সমীচীন বা সম্ভব নয়। আর ডলারের দাম বাড়াটা অভ্যন্তরীণ বাজারের মূল্যস্ফীতিতে ঘৃতাহুতি দেওয়ার মতো হতে পারে।

নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রার ওপর মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব লাঘব করার আগাম প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। প্রশ্ন হলো এ জন্য বাজেটে যথেষ্ট বরাদ্দ রাখার সুযোগ কতখানি আছে। আবার সারের ওপরও বড় অঙ্কের ভর্তুকি দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। আপাতত নতুন প্রকল্প হাতে না নিয়ে আপৎকালীন অবস্থার মোকাবিলা করার জন্য বাজেটে সাধ্যমতো বরাদ্দ রাখা সমীচীন হবে।

সরকারের বাজেটের চিরাচরিত ও প্রধান সমস্যা হলো রাজস্ব সংগ্রহের দুর্বলতা। এর ওপর আবার কোভিড অতিমারির ধাক্কা সামলাতে এবং বৈদেশিক ঋণনির্ভর মেগা প্রকল্পের কারণে সরকারের সুদ পরিশোধের দায় বেড়ে যাচ্ছে, ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। এতে রাজস্ব আয়ের একটা বড় ও ক্রমবর্ধমান অংশ চলে যাচ্ছে দেশি ও বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ।

বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর মেগা প্রকল্পের সুদ-আসল পরিশোধ করতে গিয়ে আমরা কি শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থানের যাচ্ছি কি না—এ নিয়ে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের ম্যাক্রো অর্থনীতির বর্তমান সূচকগুলোর বিচারে অদূর ভবিষ্যতে এ ধরনের শঙ্কা আছে বলে মনে হয় না। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ঘটনা এত দিন আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতেও দেখা যেত, শ্রীলঙ্কা সেদিক থেকে একটি ব্যতিক্রম।

তবে দেনা পরিশোধে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ঠেকানোই মেগা প্রকল্পের সাফল্য মূল্যায়নের মাপকাঠি অবশ্যই হতে পারে না। শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো মেগা প্রকল্পগুলোর ব্যয়ের সাশ্রয়, সম্পদের অপচয় রোধ এবং প্রকল্পের সঠিক অগ্রাধিকার নির্ণয়। এ ধরনের ব্যয়সাপেক্ষ প্রকল্প গ্রহণ নিছক জনতুষ্টির বিষয় হতে পারে না, বরং এগুলো সত্যিকারের সফলতা নির্ভর করবে—এর ফলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কতখানি আকৃষ্ট করা গেল, তার ওপর। বিশেষত রপ্তানিমুখী শিল্পে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা গেলে পরবর্তী সময়ে ঋণ পরিশোধের জন্য বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর আর চাপ পড়বে না।

২০০৮ সালর বিশ্বজুড়ে খাদ্যমূল্য বাড়ার প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় টানাপোড়েনে পড়েছিল। প্রায় দেড় দশক ধরে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরে অর্থনীতি এখন আবার একটা অস্থিরতার দিকে পড়তে যাচ্ছে। এটাও মূলত বিশ্ব অর্থনীতির কারণেই। তবে অর্থনীতিতে এ ধরনের ঝাঁকুনি খেলেই হয়তো টেকসই প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে যে কাঠামোগত মৌলিক প্রতিবন্ধকতাগুলো আছে, সেদিকে নজর পড়ে। যেমন আগামী দিনে আমাদের উন্নয়ন ব্যয়ে অনেক সাশ্রয়ী হতে হবে এবং রাজস্ব সংগ্রহ অবশ্যই জোরদার করতে হবে। কারণ, পরিবেশবান্ধব শিল্পায়ন ও নগরায়ণ, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, জনস্বার্থ রক্ষা ও প্রযুক্তিগত উন্নতি—এসবের জন্যই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের খরচ ক্রমেই বেড়ে যাবে।

মনে রাখা দরকার, উন্নয়নশীল বিশ্বে মধ্যমেয়াদে, বিশেষ করে এক দশক সময়ের জন্য উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের অনেক নজির আছে। কিন্তু কয়েক দশক ধরে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা, যেমন দক্ষিণ কোরিয়া পেরেছিল—তার উদাহরণ খুবই বিরল। সে কারণেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ–পরবর্তীকালে সিঙ্গাপুর বা হংকংয়ের মতো কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র বা অঞ্চল বাদ দিলে দক্ষিণ কোরিয়াই শুধু নিম্ন আয়ের দেশ থেকে শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হওয়ার এখন পর্যন্ত একমাত্র দৃষ্টান্ত। সুতরাং এসব বিষয় নিয়েও ভাবতে হবে।

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, অর্থনীতিবিদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা