Thank you for trying Sticky AMP!!

আইসোলেশনের সঙ্গে লড়াই

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com

চট্টগ্রামে থেকে জরুরি কিছু কাজ সেরে ঢাকা ফিরতেই শুরু হলো অদ্ভুত গলাব্যথা, জ্বর-জ্বর ভাব আর ক্লান্তি। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ইঙ্গিত দিল, করোনা।

টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ চলে এল। মায়ের চেহারার দিকে আর তাকানোই যাচ্ছিল না। বউ-বাচ্চারা সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়! বাবা-চাচা, মা-খালাসহ সব আত্মীয়-বন্ধু, সহকর্মীর মধ্যে অনুভব করলাম আমার জন্য নির্ভেজাল দুশ্চিন্তা আর ভালোবাসা।

শুরু হয়ে গেল আমার করোনাভাইরাসকে হারানোর যুদ্ধ। পাশাপাশি সমানতালে চলল আমার আইসোলেশন-যুদ্ধ। করোনাকে হারানোর যুদ্ধে আমার ভূমিকা বরং নগণ্য। বন্ধু ডা. সানাউল্লাহ মোর্শেদ আর বোন ডা. আবেদা রাইয়ানের সঙ্গে বিশদ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, বাসায় পুরোপুরি আইসোলেশনে থেকেই এ যুদ্ধে আমি লড়াই করব। আমার অতিরিক্ত ওজন, পাঁচ বছরের বেশি হাইপারটেনশন আর ডায়াবেটিসের ইতিহাস স্বাভাবিকভাবেই ওদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াল।

বাসায় থেকেই চিকিৎসা নেওয়ার কারণ ছিল। বাসায় থেকে এই রোগের বিরুদ্ধে স্বীকৃত টোটকা মেনে চলা সহজ ছিল। যেমন ঘন ঘন গরম পানির ভাপ নেওয়া, গরম চা খাওয়া, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হালকা ব্যায়াম, বারবার বেলুন ফোলানোসহ ফুসফুসের ব্যায়াম করা প্রভৃতি।

লক্ষণ ধরে ওষুধ তো চলছেই। সে লড়াইয়ে আমার বন্ধু আর বোনই সেনাপতি। আমার নিজের লড়াইটা চলল আইসোলেশনের সঙ্গে। কারও কোভিড-১৯ হলে এটাই সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন লড়াই। অভূতপূর্ব শারীরিক অসুস্থতার অভিজ্ঞতা যখন হতে থাকে, তখন কাছের মানুষগুলোকেই পেতে ইচ্ছে করে। স্বাস্থ্যনিরাপত্তার জন্য তাদের কাছে আসতে দেওয়া যায় না। কিন্তু সে বেদনাটা বুকে বাজতে থাকে। একই বাড়ির অন্য ঘর থেকে ভিডিও কলে মায়ের কান্নাভেজা চোখ, বাবার আকুতিভরা চাহনি, আইসোলেশন রুমের দরজার কপাটের ফাঁক গলে সহধর্মিণীর মরিয়া উঁকি, ১২ বছরের মেয়ের ছুঁতো বের করে কাছে আসার চেষ্টা, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ৯ বছরের ছেলের উচ্চ স্বরে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনা—এসব যখন চলতে থাকে, তখন আত্মবিশ্বাসের অনমনীয় বাঁধ ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে চায়।

অভূতপূর্ব শারীরিক অসুস্থতার অভিজ্ঞতা যখন হতে থাকে, তখন কাছের মানুষগুলোকেই পেতে ইচ্ছে করে। স্বাস্থ্যনিরাপত্তার জন্য তাদের কাছে আসতে দেওয়া যায় না। কিন্তু সে বেদনাটা বুকে বাজতে থাকে।

ভার্চ্যুয়াল জগৎটা এই সময়ে আতঙ্কের স্বর্গ। তাই প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিলাম, ওখান থেকে নিজেকে দূরে রাখব। আমার সংগ্রহের কয়েকটা বই আনিয়ে নিলাম। প্রথমেই পড়লাম বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী। এই বইটিই মনোবল বাড়িয়ে দিল কয়েক গুণ। এরপর একে একে পড়লাম হেনরি ফোর্ডের দ্য সিক্রেট অব জায়োনিজম, জে এলিয়টের ­দ্য স্টিভ জবস ওয়ে, সত্যজিৎ রায়ের ছিন্নমস্তার অভিশাপ, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশ বক্সী সিরিজের চিত্রচোর ইত্যাদি। প্রচুর লেখা পড়লাম বিভিন্ন কারিগরি বিষয়ে।

সাত-আট দিন পর থেকে মোটামুটি জোর করেই অফিসের দু-একটা ছোটখাটো কাজ করার চেষ্টা করলাম। ১১ দিনের মাথায় করলাম অফিসের কয়েকটা গ্রুপের সঙ্গে স্বল্পদৈর্ঘ্যের কয়েকটা ভিডিও কনফারেন্স। খালাতো ভাই আর প্রবাসী বন্ধুদের একাধিক গ্রুপের সঙ্গে চ্যাট করলাম বিছানায় শুয়ে শুয়ে। প্রচণ্ড ক্লান্তির কারণে দিনে প্রায় ১২-১৩ ঘণ্টা ঘুমিয়েই পার করে দিতাম।

তবে যা-ই করি না কেন, নিজেকে কোভিড নিয়ে চিন্তা করার সুযোগই দিতাম না প্রায়। তবু আইসোলেশনের একেক দিন ছিল একেকটা যুগের সমান। আইসোলেশন জিনিসটা অনুধাবন করলাম হাড়ে হাড়ে।

এখন আমি কাজ শুরু করেছি। প্রায় পূর্ণ উদ্যমেই বলা চলে, তবে আগের মতোই স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে। করোনার সঙ্গে যুদ্ধের এই পুরো সময়টায় অবকাশ পেয়েছি নিজেকে ও জীবনকে নতুন করে মূল্যায়নের। এই অভূতপূর্ব সময়ের সবচেয়ে বড় অর্জন আত্মোপলব্ধি! বিত্ত, বৈভব আর অহংকারের চেয়ে স্বপ্ন, সত্য আর ভালোবাসা সবচেয়ে প্রশান্তির। অন্তরের অন্তস্তল থেকে এই উপলব্ধিই এই অভূতপূর্ব সময়ের সবচেয়ে বড় উপহার।