Thank you for trying Sticky AMP!!

আটচল্লিশেই গতিশীল আন্দোলন

জেলায় জেলায় ভাষা আন্দোলন আজ যশোর

.

অবিভক্ত বঙ্গের যশোহর তথা যশোর জেলা দেশভাগের কল্যাণে সীমান্তবর্তী শহর হিসেবে মোহাজের সমস্যা থেকে মুক্ত ছিল না। সেই সঙ্গে ছিল রাজনৈতিক প্রগতিশীলতার পাশাপাশি সামাজিক রক্ষণশীলতারও প্রকাশ। শহরের ছাত্ররাজনীতিতে ও ভাষা আন্দোলনে বিভাগপূর্বকালে স্থাপিত মাইকেল মধুসূদন কলেজের ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। দেশভাগের অব্যবহিত পূর্বে যশোরের রাজনৈতিক ভুবনে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পরই ছিল কমিউনিস্ট পার্টি ও তার অঙ্গসংগঠনের শক্তিমান অবস্থান।
ভাষা আন্দোলনে যশোরের রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা। ১৯৪৭ সালের জুলাইয়ে দৈনিক আজাদ-এ বাংলা ভাষাবিরোধী রচনার প্রতিবাদে কলকাতার স্বাধীনতা পত্রিকায় প্রতিবাদপত্র পাঠান যশোরের বামপন্থী ছাত্রী হামিদা রহমান (সূত্র: আকসাছুল আলম)। একই বিষয়ে প্রতিবাদপত্র পাঠান বামপন্থী ছাত্র আফসার আহমদ সিদ্দিকী, যা ছাপা হয় সাপ্তাহিক মিল্লাত ও দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় (সূত্র: ফখরে আলম)। এগুলোতে শুধু প্রতিবাদই ছিল না, ছিল বাংলাকে হবু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবিও।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যশোর এরপরও এক কদম এগিয়ে থাকে। ঢাকায় ১৯৪৮ সালের মার্চের সংঘটিত ভাষা আন্দোলন শুরুর সামান্য আগে, অর্থাৎ জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে যশোরের ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়, যা ইত্তেহাদ-এ ছাপা হয়। এর রচয়িতা যশোরের আরেক ছাত্রনেতা আলমগীর সিদ্দিকী।
এর সাংগঠনিক রূপ প্রকাশ পায় ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলনের সূচনায়, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে ফেব্রুয়ারি (১৯৪৮) ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠনে। উভয় সংগঠনের দুই ছাত্রনেতা আলমগীর সিদ্দিকী ও রণজিত মিত্রকে মনোনীত করা হয় যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে।
কমিটির সদস্য হামিদা রহমান, সুধীর রায়, আফজল হোসেন, আফসার সিদ্দিকী প্রমুখ। পরে কমিটিতে যুক্ত হন কংগ্রেস নেতা জীবন রতন ধর, আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা মশিউর রহমান (একাত্তরে শহীদ) ও কমিউনিস্ট পার্টির অনন্ত মিত্র।
ঢাকা থেকে ১১ মার্চের ভাষা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের আহ্বানের আগেই যশোরের সংগ্রাম কমিটি পথে নামে সভা, সমাবেশ ও মিছিলের মাধ্যমে। সেই সঙ্গে ছাত্র ধর্মঘট। ইতিমধ্যে ১০ মার্চ জারি হয় ১৪৪ ধারা। প্রতিবাদী ছাত্রসমাজ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাস্তায় নামে। মিছিলের শহর প্রদক্ষিণকালে এতে যোগ দেন ছাত্রীরা, রাজনৈতিক নেতাদের একাংশ এবং বিশেষ করে বাংলাপ্রেমী জনসাধারণ।
পুলিশ প্রচণ্ড দমননীতির মাধ্যমে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে আন্দোলন বন্ধ করতে চেষ্টা চালায়। দফায় দফায় গ্রেপ্তার করা হয় ছাত্রনেতাসহ একাধিক ভাষাসংগ্রামীকে। প্রতিবাদে স্বতঃস্ফূর্ত হরতালের আলামত দেখা দেয়। দোকানপাট আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। এর পরের ঘটনা ১২ মার্চ থেকে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়। পুলিশের লাঠিচার্জ ও গুলি স্তব্ধ করতে পারে না আন্দোলন।
মিছিল যত বাড়তে থাকে, আন্দোলনে ছাত্র নেতৃত্বের সংখ্যাও ততই বেড়ে চলে। আলমগীর সিদ্দিকী, আফসার সিদ্দিকী ছাড়াও নেতৃত্বদানে এগিয়ে আসেন সুনীল রায়, শেখ আমানুল্লাহ, সুধীর রায়, দেবীপদ চট্টোপাধ্যায়, গোলাম ইয়াজদাম চৌধুরী প্রমুখ। মেয়েদের নেতৃত্বে হামিদা রহমান, সুফিয়া খাতুন, রুবী রহমান। কয়েক হাজার মানুষের মিছিলের সঙ্গে পুলিশের একরকম খণ্ডযুদ্ধই চলে। পায়ে গুলি লাগে আলমগীর সিদ্দিকীর।
বন্দীদের মুক্তির দাবিতে নতুন করে ১৮ মার্চ আন্দোলনের বিস্তার। এবার প্রশাসন ব্যবহার করে তাদের গুন্ডা বাহিনী ও বিহারিদের। ওদের সশস্ত্র দল প্রতিবাদী জনতার ওপর হামলা চালায়। প্রতিরোধ জেগে ওঠে মিছিল থেকে। প্রশাসনের বিকল্প দুষ্টবুদ্ধি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত করার। কিন্তু ছাত্র-জনতার মিছিল দাঙ্গা প্রতিরোধে তৎপর হওয়ার কারণে যশোরবাসী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পায়। ইতিমধ্যে ১৫ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন ও কেন্দ্রীয় সংগ্রাম কমিটির মধ্যে আট দফা চুক্তির বদৌলতে অবস্থা ক্রমেই থিতিয়ে আসে। তবু অবাঙালি ম্যাজিস্ট্রেট নোমানি তাঁর দমননীতির অনাচার যতটা সম্ভব চালিয়ে গেছেন।
আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলন যশোরের ছাত্রসমাজের জন্য এক বিশাল অর্জন। কারণ, বায়ান্নর আন্দোলনও এতটা আবেগ, এতটা রাজনৈতিক জনসংশ্লিষ্টতা নিয়ে বিস্ফোরক পরিবেশ সৃষ্টি করেনি, যতটা দেখা গেছে আটচল্লিশে। এদিক থেকে বিচারে যশোরে সেই সময়ের ভাষা আন্দোলন ঢাকাসহ অন্য যেকোনো শহরের তৎকালীন আন্দোলন থেকে কয়েক পা এগিয়ে।
দুর্বোধ্য কারণে যশোরে বায়ান্নর ফেব্রুয়ারির আন্দোলন গতানুগতিক ধারাতেই ছিল। সভা, সমাবেশ ও মিছিলের পথ ধরে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান উচ্চারণে। এসব তৎপরতা মূলত ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের প্রতিক্রিয়ায় সংঘটিত। বিশেষ করে স্মরণযোগ্য ২৩ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সভা, মিছিল, শিক্ষায়তনে ধর্মঘট এবং হরতাল পালন। শেষোক্ত দিনে শহীদ দিবসের মিছিলে হাজার পনেরোর মতো ছাত্র-জনতার উপস্থিতি, মাইল দেড়েক দীর্ঘ মিছিল সম্ভবত আটচল্লিশের স্মৃতি জাগিয়ে তুলেছে কারও কারও মনে। মিছিল শেষে টাউন হল ময়দানে জনসভা, সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল ওয়াহেদ।