Thank you for trying Sticky AMP!!

আটলান্টিকের বিশালতায় কয়েক দিন

আটলান্টিকের নীল পানিতে ভাসছে বরফ। ছবি: লেখক

কানাডার নাম শুনলেই গা শিরশিরে একটা অনুভূতি হয়। ধবধবে সাদা বরফে ঢাকা রাস্তাঘাট আর গাছপালা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মনের মধ্যে এ রকমই একটা ছবি নিয়ে তার্কিশ এয়ারলাইনের একটি ফ্লাইটে উঠে পড়লাম। গন্তব্য ছিল অ্যান্টিগনিশ, নোভা স্কশিয়া, পূর্ব কানাডার একটি প্রদেশ। এটি কানাডার তিনটি মেরিটাইম প্রদেশ এবং চারটি আটলান্টিক প্রদেশের মধ্যে সর্বাধিক জনবহুল। প্রদেশটি আটলান্টিক মহাসাগরের দক্ষিণ এবং পূর্ব দিকে অবস্থিত আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মণ্ডিত।

প্রায় ২৪ ঘণ্টায়, পরপর দুটি ফ্লাইট পরিবর্তন করার পর নামলাম হ্যালিফ্যাক্স এয়ারপোর্ট, তখন স্থানীয় সময় ভোর চারটা। এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়া মাত্র রক্তহিম করা বরফশীতল বাতাস যেন শরীর চিরে ভেতরে ঢুকে গেল। তখন মে মাস, কানাডায় বসন্তের বিদায়ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। এয়ারপোট থেকে আরও এক ঘণ্টা গাড়িতে করে সর্বমোট প্রায় ২৭ ঘণ্টা ভ্রমণ করে, ১৪ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পৌঁছালাম ছোট্ট অ্যান্টিগনিশ শহরে। নোভা স্কশিয়া প্রদেশটি জনবহুল বলা হলেও পাঁচ বর্গকিলোমিটারের এই শহরটিতে মাত্র ৪ হাজার ৪০০ মানুষ বাস করে। অ্যান্টিগনিশ শহরটি স্থাপিত হয় ১৭৮৪ সালে আর এটি নোভা স্কশিয়ার ‘হাইল্যান্ড হার্ট’ হিসেবে পরিচিত এবং স্কটিশ সংস্কৃতিসমৃদ্ধ। এই শহরে অবস্থিত সেন্ট ফ্রন্সিস জেভিয়ার ইউনিভার্সিটিতে একটি শর্ট কোর্সে স্কলারশিপ পাওয়ায় এই ভ্রমণের সুযোগ হয়। এটি পূর্ব কানাডার অনেক পূরোনো নামকরা একটি ইউনিভার্সিটি, যা ১৮৫৫ সালে স্থাপিত হয়। এই ইউনিভার্সিটির হোস্টেলেই আমার থাকার ব্যবস্থা হয়। হোস্টেলটি এককথায় চমৎকার, আসবাবগুলোতে আছে স্কটিস সংস্কৃতির ছোয়া। হল রুমে আছে বিশাল এক পিয়ানো, টেলিভিশনের সঙ্গে আরামদায়ক সোফা, টেবিল টেনিস রুম, সাজানো গোছানো কিচেন, পরিষ্কার বাথরুম, ওয়াশিং মেশিন, এক কথায় সবকিছুই! প্রত্যেকের জন্য ছিল ফুল-ফার্নিশড আলাদা রুম, সঙ্গে বিশাল এক জানালা, যা দিয়ে বাইরের সৌন্দর্য কিছুটা উপভোগ করা যেত।

আটলান্টিকের বিশাল আকাশের নিচে। ছবি: লেখক

ভোররাতে হোস্টেলে ঢোকায় আশপাশটা আঁচ করতে পারিনি, বিকেলে ফ্রেশ হয়ে হোস্টেলের সাইকেলটা নিয়ে বের হয়ে তো চোখ ছানাবড়া! অসম্ভব সুন্দর সাজানো গোছানো পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন ছোট্ট একটি শহর। শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে পর্বত হতে বেয়ে আসা ঢলের ছোট্ট একটি নদী। আর সেই নদীর আশপাশ দিয়ে গড়ে ওঠা ছোট ছোট বাড়ি। ঠিক যেন ছবির মতো...শহরটি ছোট হওয়ায় মূলত সবাই সবাইকে চেনে আর না চিনলেও কুশল বিনিময় করতে ভোলে না। কমবেশি যাদের সঙ্গে দেখা হলো সবাই হাই, হ্যালো বলে সম্বোধন করল, এমনকি শহরের এক পুলিশও পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে দেখে মুচকি হেসে হাই দিল। মজার ব্যপার ঘটল রাস্তা পার হতে গিয়ে, যখনই কোনো ক্রস সেকশন পার হওয়ার জন্য দাঁড়াই, অন্যদিক দিয়ে আসা গাড়িগুলো ব্রেক করে থেমে যায় আর একটু হেসে হাত দিয়ে ইশারা করে আগে যাওয়ার জন্য বলে। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই অবাক করার মতো একটা বিষয়। কেন জানি হঠাৎ করেই শহরটি আপন মনে হতে লাগল। মনে হতে লাগল, শহরের মানুষগুলো আমার অনেক দিনের চেনা। আমার ধারণাও ছিল না পৃথিবীতে এত সুন্দর একটি শহর থাকতে পারে।

এই শহরে টাইম টেবিলগুলো একটু ভিন্ন রকমের, এখানে সকাল ৬টায় সূর্যোদয় হয় আর সূর্যাস্ত হয় রাত ৯টায়। অতিপ্রয়োজনীয় দোকান বাদে সব দোকান বিকেল ৪টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়ার জন্য তাদের এই নিয়ম। আমরা সকাল ৭টায় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ইউনিভার্সিটির ক্যানটিনে সকালের নাশতা করতে যেতাম। সেখানে ধোঁয়া ওঠা ৫০ পদের নাশতার আইটেম থাকত। কন্টিনেন্টাল থেকে শুরু করে ওয়েস্টার্ন ঘরনার খাওয়াদাওয়া, কি নেই এখানে। আমার সবচেয়ে মজা লাগত জুস ডিস্পেন্সার, যেখানে বিভিন্ন রকমের ফ্রেশ জুস ইচ্ছামতো খাওয়া যেত। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও বাংলা খাওয়া অবশ্যই মিস করতাম। নাশতা সেরে ঢুকতাম ক্লাসে আর দুপুর ১টায় আবার চলে যেতাম ক্যানটিনে। অবাক ব্যপার হলো, আমাদের রাতের খাওয়া সারতে হতো সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে। কারণ, ওদের নাকি ওটাই নিয়ম। তো সন্ধ্যায় খেয়ে আমরা হোস্টেলে আসার সময় ব্যাগভর্তি করে খাওয়া আর বোতল ভর্তি করে জুস নিয়ে ফিরতাম। এরপর ইউনিভার্সিটির মাঠে একটু খেলাধুলা আর তারপর সবাই মিলে একসঙ্গে আড্ডা। হলরুমে বসে আমি পিয়ানো বাজাতাম আর সবাই হেড়ে গলায় গান, সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। ওখানে প্রায় ৮টি দেশের ২০ জন শিক্ষানবিশ থাকত কিন্তু আড্ডার সময় সেটা কখনোই বোঝা যেত না। মনে হতো সবাই সবার আপন। এরপর রাত ৯টার দিকে যখন সূর্য অস্ত যেত, তখন আমরা কুড়িয়ে আনা খাওয়া হালাল করতাম। এরপর যে যার মতো ঘুম।

একধরনের কচুরিপানার এই ফুলের অপার সৌন্দর্য। ছবি: লেখক

একদিন এক মজার ঘটনা ঘটল। আমি আর আমার এক ক্লাসমেট বের হয়েছি শহর ঘুরে দেখার জন্য কিন্তু একটু পরে রাস্তা হারিয়ে ফেললাম। তো দুজন বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি, একটু পরে দেখলাম, হালকা–পাতলা গড়নের একটা ছেলে সাইকেলে আসছে। তাকে হাতের ইশারায় থামতে বললাম। প্রথমে ভেবেছি ইন্ডিয়ান বা শ্রীলঙ্কান হবে, তো ইংরাজিতেই বকবক করছি। হঠাৎ কি মনে হলো, আমি ছেলেটিকে প্রশ্ন করলাম. ‘আর ইউ ফ্রম বাংলাদেশ?’ ও বলল, ‘জি ভাইয়া’, ঠিক ওই সময়টাতে অনন্দে আমার লাফাতে ইচ্ছা করছিল! ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। দেশ থেকে এত দূরে দেশের কাউকে পাব স্বপ্নেও ভাবিনি। ছেলেটির নাম ছিল মাহবুব ইসলাম আর ও ওই ইউনিভার্সিটিতেই কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ছে। ও আমাদেরকে রাতে খাওয়ার দাওয়াত দিল আর বাংলা খাবার খাওয়ার লোভে আমি তা সাদরে গ্রহণ করলাম। ওর বাসায় গিয়ে দেখি বিশাল আয়োজন। খিচুড়ি, মুরগির মাংস আর সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজি! দীর্ঘ ৯ দিন পরে দেশি খাবার খাওয়ার সময় মনে হলো স্বর্গীয় খাবার খাচ্ছি! হাত ডুবিয়ে পেট পুরে খেয়ে, ভরপুর আড্ডা দিয়ে, হাজারটা ধন্যবাদ দিয়ে বুকভরা কৃতজ্ঞতা নিয়ে হোস্টেলে ফিরলাম।

পরদিন জানানো হলো আমাদেরকে একটা কান্ট্রি সাইড ট্যুরে নিয়ে যাওয়া হবে। খাওয়াদাওয়া প্যাকেট করে রওনা হলাম। উঁচু–নিচু মসৃণ রাস্তা ধরে এগোতে থাকলাম। দুই পাশের প্রকৃতিক সৌন্দর্যের কথা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। বরফের সিজন মাসখানেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। উজ্জ্বল সবুজ ঘাসের ওপর ফুটে থাকা হাজার হাজার হলুদ ড্যান্ডেলিয়ন আর রাশি রাশি ম্যাপেলসহ আরও বিভিন্ন ধরনের গাছ বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়... আমরা একটা খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে থাকলাম আর একটু পর একটা লাইটহাউসের সামনে নামলাম...গাড়ি থেকে নেমে একটু এগোতেই আমার মুখ এমনিতেই হা হয়ে গেল আর মনের অজান্তেই বেরিয়ে এল ‘কি সুন্দর!’ নিজের চোখে জীবনে প্রথমবারের মতো দেখলাম বিশাল আটলান্টিক মহাসাগর! আনন্দে এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখ ভিজে গেল। পৃথিবীর পৃষ্ঠের প্রায় এক-পঞ্চমাংশজুড়ে থাকা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশাল এই নীল জলরাশি কাছে নিজের এই ক্ষুদ্র অস্তিত্বের বিষয়টি জানতে পারা কিন্তু বিশাল এক আবিষ্কারের মতোই...।

বরফের সৌন্দর্য মন ভুলিয়ে দেয়। ছবি: লেখক

সাগরের পাড়টাতে পাথর দিয়ে বানানো সুন্দর বসার জায়গা, সঙ্গে শরীরজুড়ানো চমৎকার ঠান্ডা বাতাস। চোখ বন্ধ করে বুকভরে শুদ্ধ বাতাসে নিশ্বাস নিলাম। মনে হলো আজীবন এ রকম একটা জায়গায় বসে থাকা যায়...ওখান থেকে চলে আসার জন্য মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। ওখানে খাওয়াদাওয়ার পর্ব চুকিয়ে আমরা গেলাম ফিশারম্যানস কমিউনিটিতে। দেখলাম, সমুদ্র থেকে শিকার করে নিয়ে আসা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, আর তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য কীভাবে তারা বার্ষিক কোটা নির্ধারণ করে সমুদ্রে মাছ শিকার করে...এর ফলে তাদের আঞ্চলিক চাহিদাও পূরণ হয় আবার সমুদ্রে মাছের ঘাটতিও পড়ে না। অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা মাছ ধরার এলাকা নির্ধারন থেকে শুরু করে পানির তলদেশে মাছের উপস্থিতি সম্পর্কেও জানতে পারে। শেষ বিকালে গেলাম এক ডেইরি ফার্মে, দেখলাম আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কীভাবে একটি গাভির খাওয়াদাওয়া আর পরিচর্যা থেকে শুরু করে দুধ দোহন পর্যন্ত—সবকিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে করে। অবাক হলাম দেখে যে গাভির গলায় একটি জিপিএস ও এক্সিলারোমিটার সংযুক্ত করে কীভাবে তারা বুঝতে পারে গাভিটি কতটুকু ঘাস খেয়েছে এবং গাভিটি ধীরগতির বা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে কি না। আরও মজার ব্যপার হলো দুধ উৎপাদনেও এখানে কোটা করে দেওয়া, একজন খামারি কী পরিমাণ দুধ উৎপাদন করতে পারবেন, সেটা আগে থেকেই নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, যাতে অতিরিক্ত উৎপাদন না হয়ে দাম কমে না যায়, আর খামারি লোকসানে না পড়ে। দারুণ সব পরিকল্পনা, আর সর্বোপরি ভালো লাগল তাদের আতিথেয়তা আর সৌজন্য বোধ। এর পরের দিনগুলোতে যথারীতি প্রশিক্ষণ শেষ করে দেশে ফিরে আসি। এখনো সেই স্মৃতিগুলো মনে পড়লে এখনো ভালো লাগে আর আবার যেতে ইচ্ছা করে...।

এরপর আরও অনেক দেশে-বিদেশে ঘুরেছি কিন্তু আটলান্টিকের ওই বিশলতার কাছে নিজের ক্ষুদ্র অস্তিত্বের প্রমাণ বলেন আর ছোট্ট ওই শহরের নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও মানুষের ভালোবাসা বলেন, ওই রকম অনুভূতি আর কোথাও হয়নি। জায়গাটাকে হয়তো একটু বেশিই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। কানাডা ভ্রমণে অনেক কিছু শিখেছি...দেখেছি শিষ্টাচার ও সভ্যতার সঙ্গে মানুষের মনের সৌজন্যতা এবং মানবতাবোধ । ভ্রমণের মাধ্যমে শুধু ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক জ্ঞানই বাড়ে না, শেখা যায় শিষ্টাচার ও মানবতাবোধ। প্রকৃতির বিশালতায় পূর্ণ অপার সৌন্দর্যে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় এবং ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আসে মন-প্রাণ, আর খুলে যায় মনের অনেকগুলো বন্ধ দরজা।

লেখক: বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত