Thank you for trying Sticky AMP!!

মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী

আপনাদের ফারুকী আমার সরয়ার

সরওয়ার–পরবর্তী যুগের পার্থক্যটা ধরা পড়ে সহজেই। দেখা যাবে প্রকাশভঙ্গি, চলচ্চিত্র ভাষা, অভিনয় বা গল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন ঘটিয়েছেন তিনি

গত শতাব্দীর নব্বই দশকেও এদেশে টেলিভিশন ও বিকল্প ধারার সিনেমাগুলোতে মঞ্চনাটকের প্রভাব দেখা যেত। বিশেষ করে সংলাপে। মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী এই ধারা ভেঙে তৈরি করেছিলেনে নতুন ধারা। টেলিভিশন নাটকেও তিনি এনেছিলেন চলচ্চিত্রের স্বাদ। সংলাপ আর বাচনভঙ্গীতে নাটুকে ভাব থেকে বেরিয়ে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা আর বাচনভঙ্গী দক্ষভাবে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন ফারুকী। বাংলাদেশের আধুনিক চলচ্চিত্রের যে আন্তর্জাতিকীকরণ হয়েছে গত কয়েক দশকে, ফারুকী আছেন সেখানে সবার ওপরে। বিশ্বের বড় বড় অনেক চলচ্চিত্র উৎসবে ফিল্ম তাঁর ছবি প্রদর্শিত হয়েছে, হচ্ছে। পেয়েছেন অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সরয়ার কেন গুরুত্বপূর্ণ — এমন প্রশ্নের একটি সংক্ষিপ্ত জবাব দেওয়া যায় এভাবে; বাংলাদেশের অডিও–ভিস্যুয়াল মাধ্যমে সরয়ার–পূর্ব ও সরয়ার–পরবর্তী যুগের পার্থক্যটা ধরা পড়ে সহজেই। দেখা যাবে প্রকাশভঙ্গি, চলচ্চিত্র ভাষা, অভিনয় বা গল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন ঘটিয়েছেন তিনি। তরুণ নির্মাতাদের একটা বড় অংশের ওপর তিনি রেখেছেন অসম্ভব প্রভাব। এদের অনেকেই এখন দাপটের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর এই ভূমিকাকে আমাদের বিবেচনায় রাখতেই হবে। দেশের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে তাই ফারুকীর আবেদন অন্যরকম। কিন্তু দর্শক ও সমালোচকদের চেয়ে ফারুকীর আবেদন আমার কাছে একটু অন্যরকম। আটপৌরে চলচ্চিত্রকারের যে ভাবমূর্তি অন্যদের কাছে, আমার কাছে তিনি একজন সুহৃদ বন্ধু। এই লেখায় আমি বন্ধু ও মানুষ ফারুকীকে অনুসন্ধানেরও চেষ্টা করব।

২.

সরয়ারকে বোধ হয় এখন ফারুকী নামেই সবাই চেনে। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এখন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র মহলে বাংলাদেশের দূতের মতো হয়ে উঠেছেন। ‘ভ্যারাইটি’ কাগজে লিখেছিলেন জে উইয়েসবার্গ, ‘বাংলাদেশের নতুন ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী হলেন আসল উদাহরণ—কি এক্সেম্প্লার।’ আর ‘হলিউড রিপোর্টার’-এ এলিজাবেথ কার লিখেছিলেন, ‘ফারুকী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পরবর্তী চলচ্চিত্র নির্মাতা, যিনি ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারেন।’

ভীষণ ব্যস্ত ফারুকী দেশ-বিদেশে ছুটছেন, ছবি বানানোর কাজ, সম্পাদনার কাজ, একবার তাঁকে দেখা যাচ্ছে এ আর রাহমানের বাড়িতে, তো আরেকবার তাঁকে দেখা যাচ্ছে নওয়াজউদ্দীন সিদ্দিকীকে চরিত্র বুঝিয়ে দিতে ব্যস্ত। ছুটতে হচ্ছে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে, কখনো পুরস্কার নিতে, কখনো পালন করছেন বিচারকের দায়িত্ব, কখনোবা ইতালিতে ছুটছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্মের ক্লাসে লেকচার দিতে। মিলান ফিল্ম স্কুল, গ্রিফিথ ফিল্ম স্কুল অস্ট্রেলিয়া কিংবা বুসানে ফিল্ম একাডেমিতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ফিল্ম মেকিং নিয়ে কথা বলেছেন, জাপানের ফুকোওয়াকা ফিল্ম আর্কাইভে তাঁর চারটি ছবি আর্কাইভ করা হয়েছে; তিনি এশিয়া প্যাসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ডস, তালিন ব্লাক নাইট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, বুসান ফেস্টিভ্যালসহ নানা উৎসবে পালন করেছেন জুরির দায়িত্ব।

দেশেও তিনি ভীষণ জনপ্রিয়, সদা আলোচিত এবং তর্কিত। বইমেলায় তিনি হাঁটতে পারেন না, ভিড় হয়ে যায়; পর্দার নেপথ্যের মানুষদের মধ্যে তাঁর মতো ফেনোমেনন আমাদের সময়ে খুব কম জনই হতে পেরেছেন।

আপনাদের এই ফারুকী আমার কাছে সরয়ার। আমাদের অনেকেরই কাছে। সরয়ার নামের বানানটা আলাদা, ছোটবেলায় হাতের লেখা শেখার সময় ‘ও’ লেখা কঠিন মনে হওয়ায় সরওয়ার হয়ে গেছেন ‘সরয়ার’। এটা তাঁকে ভিড়ের মধ্যে আলাদা করেছে। সরয়ার তাঁর ছবিতে কতবার যে ‘ও’ এড়িয়ে গিয়ে আলাদা হয়ে গেছেন, তিনি জানেন, আর আমরা কিছু কিছু জানি।

সরয়ার প্রথমে লেখক হতে চেয়েছিলেন, নিয়মিত লিখতেন, কবি বেলাল চৌধুরী ছিলেন তাঁর মেন্টর। এরপর গ্রুপ থিয়েটারের দলে ভিড়ে গিয়েছিলেন, মঞ্চে অভিনয়ের কসরত শিখছিলেন দলের একজন হয়ে। আড্ডাস্থল ছিল শাহবাগ, আজিজ সুপার মার্কেটের বইপাড়া। সেখান থেকে চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। নাখালপাড়ার ছেলে, মধ্যমানের কলেজে পড়েছেন, এখন বলেন, পড়েছি ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব মিসটেকসে। নিজেকে নাখালপাড়ার বলে মনে করেন, এবং সেটা সগর্বে বলেন। নাখালপাড়ার চায়ের দোকানের আড্ডায় লোকে কীভাবে গল্প বানাত, সেসব নাকি তার গল্প বানানোর রসদ আর প্রেরণা। সেই যে ‘খাঁটি সরিষার তেল কোথায় পাওয়া যায়’ বিজ্ঞাপনটা, এটার আইডিয়ার উৎপত্তিস্থলও নাখালপাড়া। ১৯৭৩-এর ২ মে জন্ম। গত সহস্রাব্দের শেষের দিক, তখন তাঁর বয়স ২৬-২৭, আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয়। আমাকে এসে বললেন, আয়েশামঙ্গল উপন্যাসটা আমি পড়েছি, আমি এটার রিভিও লিখেছিলাম, আমার খুব প্রিয় উপন্যাস, আমি এটাকে ফিল্ম বানাতে চাই। আপনি যদি লেখক হন, আর আপনার বই যদি কেউ পড়ে ভালো বলে, আপনি দ্রবীভূত বোধ করবেন। আমি তখনো তাঁকে ভালো করে চিনি না। এরপরের দিন এসে তিনি এক প্যাকেট টাকা আমার টেবিলে রেখে গেলেন, ১৫ দিন পরে আয়েশামঙ্গল শুটিং সেরে এলেন রংপুর থেকে। এই হলো আমাদের চলার শুরু।

আমি তখন থাকতাম এলিফ্যান্ট রোডের ভাড়ার বাসায়। পদ্যর তখন ৪-৫ বছর বয়স। সরয়ার বাসায় এসে পদ্যর সঙ্গে খেলতে খেলতে বলতেন, ভীষণ খিদে পেয়েছে। মেরিনা তাঁকে পরোটা আর মাংস দিলে তিনি চাইতেন অনেকগুলো কাঁচা মরিচ। হয়তো তাঁর সঙ্গে থাকতেন মারজুক রাসেল। দুনিয়ার আবদার সইতে হতো আমাকে। রাত ১২টায় ফোন করে বলতেন, অমুক নায়িকাকে লাগবে, এখনই ফোন করে রাজি করান। কিংবা অমুকে রমনা থানায় আটকে আছে, ফোন করে ছাড়িয়ে আনান। একের পর এক প্রতি চুনিয়া, প্রত্যাবর্তন, চড়ুইভাতি, কবি... এরপর ৫১-বর্তী আর ৬৯। ৫১-বর্তী আমাদের প্রবাসী বাংলাদেশিদের ঘরে ঘরে নিয়ে গেল। তারপর সরয়ার চড়ুইভাতির সিকুয়েল করবেন, বড় পর্দায়। গেলাম ফরিদুর রেজা সাগর ভাইয়ের কাছে। সরয়ার বানালেন ব্যাচেলর।

সরয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, পুরস্কার পেতে শুরু করলেন। শ্রুতিদৃশ্য মাধ্যমে আগের অভিনয়রীতিতে ছিল মঞ্চের প্রভাব, সংলাপ ছিল কেতাবি, ভালো ছবি মানেই ছিল সিরিয়াস গল্প—এর বাইরে তিনি তাঁর নিজস্ব রীতিতে ভিডিও ছবি বানাতে শুরু করলেন, হলেন জনপ্রিয়, পুরস্কৃত এবং তিরস্কৃতও। ছবিয়ালের মাধ্যমে একঝাঁক নতুন ধারার নির্মাতা পেল বাংলাদেশ।

এর মধ্যে পদ্য বড় হয়ে গেল, পড়তে চলে গেল আমেরিকা। তিশার সঙ্গে ফারুকীর বিয়ে হলো। টেলিভিশন পর্যন্ত আমি সরয়ারের জুটি। এশিয়া প্যাসিফিক পুরস্কার আনতে তিশার সঙ্গে গেলাম অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেন। তারপর ফারুকী করবেন পিঁপড়াবিদ্যা, ডুব, স্যাটারডে আফটারনুন, নো ল্যান্ডস ম্যান। পিঁপড়াবিদ্যার সময় আমি ফারুকীকে বললাম, এই গল্পে আমি থাকতে চাই না... আমি বিযুক্ত হয়ে পড়লাম, আমার মেয়ে পদ্য পারমিতা সরয়ারের টিমে যুক্ত হয়ে গেল। গল্পের ইংরেজি সারসংক্ষেপ, প্রজেক্ট প্রোপোজাল, সাব-টাইটেল—পদ্য আমেরিকায় বসে করে। সরয়ার হাসেন, বলেন, মিটুন ভাই, আগে আপনি ছিলেন আমার স্ক্রিপ্ট রাইটিংয়ের টিমে, এখন পদ্য... কী আশ্চর্য না! আমি বললাম, দেখো, আমি বৃদ্ধ হলাম, কিন্তু তুমি পদ্যর ব্যাচেই রয়ে গেলে, সেটাই তোমার ম্যাজিক...

নিজের চোখের সামনে একটা চারা বৃক্ষে পরিণত হলো, পরিবর্তনটা বোঝা আর অ্যাপ্রিশিয়েট করা অনেক সময় বেশ কঠিন। কিন্তু সরয়ার যে আমাদের আঙিনা থেকে বিশ্ব-আঙিনায় প্রবেশ করলেন, আমি সেটা বুঝি, সম্ভবত অ্যাপ্রিশিয়েট করতে পারি... আমি বেশ বুঝি সরয়ার আর সেই শাহবাগের সরয়ার নেই! প্রতি চুনিয়া বা ভোকাট্টার প্রিমিয়ার হবে ভারতীয় সংস্কৃতি কেন্দ্রে। সরয়ার সবাইকে দাওয়াত করে নিজে কেটে পড়েছেন, অগত্যা আমি মঞ্চে দাঁড়িয়ে শো শুরু করে দিলাম... শেষের দিকে সরয়ার চুপ করে এসে সবার পেছনে লুকিয়ে দাঁড়ালেন। সেই সরয়ার এখন বুসানে হাজার হাজার দর্শকের সামনে হাত নাড়ছেন, বিদেশি সাংবাদিকদের সহাস্য ইন্টারভিউ দিচ্ছেন, একের পর এক পুরস্কার জিতছেন... আবার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে তর্কবিতর্কের ঝড় তুলছেন... গর্বে আমার বুক ভরে ওঠে...

কিন্তু সরয়ার সেই শাহবাগের তরুণটিই রয়ে গেছেন। ছবিয়াল করে রেদোয়ান রনি কিংবা আদনান রাজীবের মতো পরিচালকদের তিনিই হাতে ধরে সামনে এনেছেন, মারজুক রাসেল, রিফাত চৌধুরী, কামরুজ্জামান কামু, টোকন ঠাকুরের মতো কবিদের দিয়েছেন ভালোবাসা এবং সমর্থন।

দেশ এবং মানুষের জন্য সরয়ারের অপরিসীম ভালোবাসা-বেদনা... আমি তাঁকে পরামর্শ দিই, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া বন্ধ করো, ছবি বানাও... তিনি কথা শোনেন না। সরয়ার আরো বড় হবেন, আরো বড় স্বীকৃতি, সম্মান আনবেন দেশের জন্য, তবে তাঁর নিজের গোপন বেদনা বা সুখবরটি সবার আগে আমিই পাব... খ্যাপা, দুর্বিনীত, কখনো কখনো সাকিব আল হাসানের মতো ‘বেয়াদব’ সরয়ার যে ভেতরে ভেতরে কত নরম আর নাজুক, সেটা আমি বোধ হয় খুব ভালো জানি...


আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক