Thank you for trying Sticky AMP!!

আমাদের ভোরের নায়কেরা

তবুও ভোর হয়। আলো ফোটে। সুকান্তের কবিতা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের লাইনগুলো বাস্তব হয়ে ওঠে, রানার ছুটেছে খবরের বোঝা হাতে। আমাদের ভোরের নায়কেরা দিনের প্রথম আলোটুকু এনে দেন আমাদের ঘরে ঘরে।

ছোটবেলায় আম্মা কবিতা পড়াতেন, শুনে শুনে মুখস্থ করতাম: ‘আমি হব সকালবেলার পাখি, সবার আগে কুসুমবাগে উঠব আমি ডাকি, সূয্যিমামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে, হয়নি সকাল ঘুমোও এখন মা বলবেন রেগে...।’ তখন ভাবতাম, এই সকালবেলার পাখিটা হলো আমাদের আতিয়ার চাচা। যিনি রোজ সকালবেলা আমাদের বাড়িতে আসেন সাইকেল চালিয়ে, কুয়াশার ভেতরে লাল একটা আলোয়ান ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে; আব্বার হাত ধরে আমি তখন মর্নিং ওয়াক করে ফিরছি, পায়ের স্যান্ডেলের নিচে শিশিরভেজা মরা-ঘাস। আতিয়ার চাচা দিগন্তে কুয়াশা চিরে আসছেন, ক্রিং ক্রিং শব্দ আসছে, লাল আলোয়ান, তিনিই কি আমাদের সকালবেলার সূর্য? তিনিই কি সকালবেলার পাখি?

সকাল সকাল খবরের কাগজ আসত রংপুরে, তবে কাগজটা কিন্তু ছিল আগের দিনের। একদিন পরে মফস্বলে যেত ঢাকার কাগজ। এখন দিনেরটা আসে দিনে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে, বগুড়ায়, খুলনায় ছাপা হয় প্রথম আলো। ভোরের আলো ফুটবার আগেই কাগজ বুঝে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন আলোর পথের যাত্রীরা! ভোরের প্রথম আলোর চরণধ্বনি আর ভোরের নায়কদের কড়া নাড়ার শব্দ বেজে ওঠে একই সঙ্গে।

আতিয়ার চাচাই আমাদের শৈশবের প্রথম নায়ক। যিনি সকাল বয়ে আনতেন আমাদের ঘরে। বয়ে আনতেন আলোর বার্তা।

আরেকটু বড় হলে রংপুর শহরে নিজেই যেতাম সাইকেল চালিয়ে। লক্ষ্মী টকিজ সিনেমা হলের সামনে ছিল রুপালি পেপার ঘর। স্টেশন রোডে পত্রিকা বিপণি। এদের প্রত্যেকের সঙ্গেই আমার ছিল স্পেশাল খাতির। চিত্রালী, পূর্বাণী, বিচিত্রা, রোববার পড়তাম পত্রিকার স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। আরেকটু বড় হলে চলে এলাম ঢাকায়। ছাত্রাবস্থাতেই কাজ করতে শুরু করলাম সাপ্তাহিক দেশবন্ধু আর পূর্বাভাস পত্রিকায়। তখনো কলাম লিখতাম গদ্যকার্টুন। ১৯৮৯ সাল, আমার বয়স ২৪। খুলনা গেলাম।

কাউকে চিনি না। পত্রিকার হকার ভাইদের কাছে গেলাম। আশ্চর্য, হকার ভাইয়েরা আমাকে চিনতে পারলেন। আমাকে চা আর শিঙাড়া খাওয়ালেন। তাই পত্রিকার বিপণনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা আমার ভাই, তাঁরা আমার নিঃসঙ্গতার সঙ্গী, অচিনপুরের ঘনিষ্ঠতম আত্মীয়। যেখানেই যাই, পত্রিকা হাতে কাউকে দেখলেই মনে হয়, তিনি আমার আর জীবনের ভাই, এখনই তাঁকে জড়িয়ে ধরা যায়!

আমার আরেকটা ভাই ছিল। ছিল মানে আছে। এখন একটা টেলিভশন কেন্দ্রের সবচেয়ে বড় কর্তা। তিনি নিজেই সকালবেলা পত্রিকা বিলি করতেন দ্বারে দ্বারে। ভোরবেলা উঠে সাইকেলে করে পাঠকদের দুয়ারে দুয়ারে পত্রিকা রেখে এসে নিজে রেডি হয়ে কলেজে যেতেন। বেশ আয় হতো। পড়াশোনার খরচটা উঠে আসত। একদিন আমার সঙ্গে দেখা হলো আমাদের বাসার দরজায়। সালাম দিলেন। বললেন, ভাই, একটা কথা আছে। আমি একটু একটু লিখি। আমি বললাম, বেশ তো। একটা লেখার স্যাম্পল কাল আমাকে দেবেন। পরদিন তিনি এলেন। লেখা পড়ে আমি অভিভূত। তিনি একটা শব্দ ব্যবহার করেছেন। ‘কবন্ধ’। ‘কবন্ধ সময়।’ আমি বললাম, কবন্ধ মানে কী। তিনি বললেন, জানি না। আমি তাঁকে একটা অভিধান উপহার দিলাম। এরপর তিনি এসে ভোরের কাগজ–এ যোগ দিলেন। পরে এলেন প্রথম আলোয়। উন্নতি হতে লাগল তাঁর। এখন একটা বেসরকারি টেলিভিশনের সবচেয়ে বড় কর্তা তিনি।

আজকাল ফ্ল্যাটবাড়িতে আমাদের ভোরের নায়কদের ওপরে উঠতে দেওয়া হয় না করোনার নিয়ম অনুসারে। তাতে একটা অসুবিধা হয়। ভোরের নায়কদের সঙ্গে দেখা হয় না বললেই চলে।

তবুও ভোর হয়। আলো ফোটে। সুকান্তের কবিতা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের লাইনগুলো বাস্তব হয়ে ওঠে, রানার ছুটেছে খবরের বোঝা হাতে। আমাদের ভোরের নায়কেরা দিনের প্রথম আলোটুকু এনে দেন আমাদের ঘরে ঘরে, আমাদের হৃদয়ে, আমাদের মননে। শীতের ভোরে কাঁথায় মায়ের শাড়ির ওমটা উপভোগ করতে করতে আবৃত্তি করি: আমি হব সকালবেলার পাখি। আম্মা রংপুরের কবরে শায়িত, আম্মার শাড়ি গায়ে, বিড়বিড় করি: আমি হব সকালবেলার পাখি...ওই তো আমার ভোরের নায়কেরা ভোরের পাখি হয়ে উড়ছে, ছুটছে, ডানা মেলছে, আর জানাচ্ছে সকালের খবর: বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে...

আমার ভোরের পাখি ভাইয়েরা, আর জীবনে আমি তোমাদের মায়ের পেটের ভাই ছিলাম, আমাদের ছিল পাখি মা...আমরা পাখি হয়ে জন্মেছিলাম একটা খড়কুটোর নীড়ে...।


আনিসুলহক:সহযোগীসম্পাদক