Thank you for trying Sticky AMP!!

আরও টাকা চায় হল-মার্ক!

কারখানা চালু করতে সরকারের কাছে অর্থ চেয়ে আট মাসে সাতবার আবেদন করেছে সাধারণ মানুষের আমানতের অর্থ লুণ্ঠনের অভিযোগ ওঠা হল-মার্ক গ্রুপ। কখনো অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বরাবর, কখনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে এসব আবেদন করা হচ্ছে।
হল-মার্ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে জালিয়াতি করে সোনালী ব্যাংক থেকে দুই হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল। গ্রুপটির মালিকসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে ১১টি মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে। তবে মামলার সব আসামিকে এখনো ধরেনি পুলিশ। দুদক এ-সংক্রান্ত আরও ২৭টি মামলার তদন্ত করছে।
গত বছরের মার্চে সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘হল-মার্কের কারখানাগুলো চালু করতে এদের আরও ঋণের দরকার।’ এ বক্তব্যের পর থেকেই মূলত হল-মার্ক আরও অর্থ চেয়ে বারবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের শরণাপন্ন হচ্ছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে।
সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সূত্রে জানা গেছে, যে ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে সাধারণ আমানতকারীদের দুই হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা তুলে নিয়ে গিয়েছিল হল-মার্ক, সেই সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ হল-মার্ককে আরও অর্থ দেওয়ার পক্ষে ছিল। গত বছর হল-মার্কের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছিল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। তাতে দায়দেনা নিয়মিত করে হল-মার্কের সঙ্গে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালুরও সুপারিশ করা হয়েছিল।
হল-মার্ক থেকে টাকা আদায়ের পদক্ষেপ হিসেবে এ সুপারিশ করা হয়েছিল বলে গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে জানান সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রদীপ কুমার দত্ত।
তবে এখন গ্রুপটির কাছ থেকে পাওনা অর্থ আদায় করতে অর্থঋণ আদালতে মামলা করার উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানাচ্ছে সোনালী ব্যাংক। গত সোমবার অনুষ্ঠিত ব্যাংকের পর্ষদ সভায় হল-মার্কের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। এ মামলা করতে ২৭ লাখ টাকা কোর্ট ফি লাগবে।
প্রদীপ কুমার দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মামলার উদ্যোগ নিচ্ছি। এখনো চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। গোছগাছ করা হচ্ছে।’ হল-মার্ককে আরও অর্থ দেওয়া হবে কি হবে না, তা একান্তই সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সোনালী ব্যাংকের পরিচালক জায়েদ বখত্ গতকাল শুক্রবার মামলার সিদ্ধান্তের কথা স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। মামলার সিদ্ধান্ত আগেরই ছিল। তার অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’
হল-মার্কের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, তাঁর স্বামী ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ, ব্যবস্থাপক (কমার্শিয়াল) তুষার আহমেদ (তানভীরের ভায়রা) এবং কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাসহ মোট ২৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে দুদক। কিন্তু তাতে সরকারের নিয়োগ করা সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ সদস্য কারও নাম নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান হল-মার্ক কেলেঙ্কারির জন্য সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ সদস্যরাও দায় এড়াতে পারেন না বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনসংবলিত একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। ওই চিঠি তেমন একটা আমলে নেয়নি অর্থ মন্ত্রণালয়। পর্ষদ ভেঙে না দিয়ে তা পুনর্গঠন করে দায় সেরেছে মন্ত্রণালয়।
যোগাযোগ করলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এম আসলাম আলম গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘হল-মার্ক কেবল তারিখ বদল করে একই আবেদনপত্র বারবার ডাকে পঠিয়ে দিচ্ছে। প্রতি মাসে একটি করে আবেদন আসছে।’ আবেদন এলেও মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে এ ব্যাপারে তেমন কিছু করার নেই বলে জানান তিনি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব আবেদন অহেতুক ও বাড়তি ঝামেলা তৈরি করে। আবেদনকারী হিসেবে এমনকি কারও নাম-ঠিকানাও নেই এগুলোতে। ‘৪০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর’ নাম ভাঙিয়ে কারখানা চালুর জন্য অর্থ চেয়ে এসব আবেদন করা হচ্ছে। গত আট মাসে সাত দফা আবেদন এসেছে বলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, হল-মার্ক ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী কোনো গোষ্ঠীর নতুন কোনো তৎপরতার অংশ হিসেবে এসব আবেদন করা হতে পারে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে চাপ তৈরি করে জালিয়াতির বিপুল অর্থ ঋণ হিসেবে পুনঃ তফসিল করিয়ে নেওয়ারও চেষ্টা থাকতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা।
কারখানা চালু করতে হল-মার্ককে আরও টাকা দিতে রাজি কেন সোনালী ব্যাংক—এ বিষয়ে জানতে চাইলে জায়েদ বখত্ বলেন, এ সুযোগ এখন আর আছে বলে মনে হয় না। অর্থ মন্ত্রণালয় চেয়েছিল বলে তখন দায়দেনা চিহ্নিত করে একটা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘হল-মার্কের সম্পত্তি আছে বড়জোর সাত থেকে আট শ কোটি টাকার। বুঝতে হবে, হল-মার্কের নিয়ে যাওয়া অর্থের পুরোটা কিন্তু ঋণ নয়। বড় অংশই জালিয়াতি। যদি আরও ঋণ দেওয়াও হয়, তাহলে কারখানা পরিচালনা করবে কে? আসামিরা তো কেউ কারাগারে, কেউ বা পলাতক।’
সোনালী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, হল-মার্ক গ্রুপের ৪৮টি কারখানার মধ্যে ২০টি সাব-কন্ট্রাক্টে চলছে। কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর হল-মার্কের কাছ থেকে মোট ৪১০ কোটি আদায় করতে পেরেছে ব্যাংকটি। বাকি বিপুল দায়দেনার বিপরীতে সহায়ক জামানত হিসেবে উল্লেখ করা জমির মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
হল-মার্কের লাগাতার আবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবেদন করলেই কি টাকা পাবে ওরা?’ সোনালী ব্যাংক অর্থঋণ আদালতে মামলা করতে যাচ্ছে, এটা করে কি সব টাকা আদায় করা যাবে—এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সেটা সোনালী ব্যাংক বলতে পারবে। তারা নিশ্চয় আইন-কানুন দেখে করছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, অর্থঋণ আদালতের মাধ্যমে টাকা আদায় দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। এ প্রক্রিয়ায় সব টাকা আদায় করা সম্ভব কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, হল-মার্কের বাইরেও যারা এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত, তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে বিশেষ আইনের মাধ্যমে টাকা আদায় করতে হবে।