Thank you for trying Sticky AMP!!

আজ বুধবার সকালে ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের বাড়িতে খান সারওয়ার মুরশিদ ও নূরজাহান মুরশিদ দম্পতির স্মরণসভায় অতিথিরা

আলোকিত দম্পতি খান সারওয়ার–নূরজাহান মুরশিদকে স্মরণ

পাকিস্তানের বৈরী সময়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য যাঁরা দেশের রাজনীতি, স্বাধীনতা, বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে ভাবতেন, নানাভাবে যুক্ত থাকতেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ। স্বাধীনতার পরেও দেশের শিক্ষা–সংস্কৃতির বিকাশ এবং রাজনৈতিক ক্রান্তিলগ্নে উত্তরণে পথে অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছেন তিনি। সমাজ–সংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশে ভূমিকা রেখেছেন তাঁর সহধর্মিণী নূরজাহান মুরশিদও।

শিক্ষাবিদ, কূটনীতিক, সমাজচিন্তক খান সারওয়ার মুরশিদের নবম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আজ বুধবার সকালে আলোকিত এই দম্পতিকে স্মরণ করেন বিশিষ্টজনেরা। ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে তাঁদের বাড়িতে আয়োজন করা হয়েছিল ‘স্মরণসভা’। মুরশিদ ট্রাস্টের পরিচালিত ‘নূরজাহান–সারওয়ার মুরশিদ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ এই আয়োজন করে। ধানমন্ডির এই পুরোনো বাড়িটিতে এখন নতুন বহুতল ভবন করা হবে। পুরোনো বাড়ির নকশা করেছিলেন প্রখ্যাত স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। গত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে বহু বিখ্যাত মানুষের আবাধ যাতায়াত ছিল খান সারওয়ার মুরশিদের এই বাড়িতে। তাঁদের মধ্যে জীবিতদের বেশ কয়েকজন এসেছিলেন এই স্মরণসভায়।

উপস্থিত আলোচকদের মধ্যে ছিলেন রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আমীর–উল ইসলাম, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনোয়ারুল করিম, অধ্যাপক মাহমুদ শাহ কোরেশী, লেখক হাসনাত আবদুল হাই, শিল্পী রফিকুন নবী, অধ্যাপক পারভিন হাসান প্রমুখ। তাঁরা সারওয়ার–নূরজাহান মুরশিদ দম্পতির অবদানের কথা তুলে ধরতে গিয়ে ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন হয়ে মুক্তিযুদ্ধ, রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন থেকে বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণের কর্মপ্রবাহ, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন থেকে নতুন মানবিক মূল্যবোধ এবং স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। আলোচকদের পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণায় এই বাড়ির কথাও এসেছে ঘুরেফিরে।

আলোচনায় আরও অংশ নিয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম, নারীনেত্রী হামিদা হোসেন ও নাট্যজন ম হামিদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। সঞ্চালনা করেন খান সারওয়ার মুরশিদের মেয়ে শারমীন মুরশিদ, মায়ের স্মৃতিচারণা করেন আরেক মেয়ে তাজিন মুরশিদ। কবিতা আবৃত্তি করেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুফিয়া আখতার।

ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘পাকিস্তানের কঠিন সময়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য যাঁরা দেশের রাজনীতি, স্বাধীনতা, বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে ভাবতেন, নানাভাবে যুক্ত থাকতেন, খান সারওয়ার মুরশিদ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তাঁর এই বাড়িতে সে সময় আমাদের অনেক গোপন বৈঠক হয়েছে। এই বাড়িটকে নিরাপদ ভাবা হতো। পাকিস্তানিরা এ জন্য তাঁকে “ষড়যন্ত্রকারী” মনে করত। তিনি নতুন মূল্যবোধ নিয়ে নতুন দেশ গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। সেই কাজ করছিলেন। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে।’

খান সারওয়ার মুরশিদ ও নূরজাহান মুরশিদ দম্পতির স্মরণসভায় নতুন সংগঠন ‘উত্তরসূরি’র যাত্রা শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়

আইনবিদ আমীর–উল ইসলাম বলেন, পাকিস্তানের ভেতর থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের যে মর্মকথা, তা নতুন প্রজন্মের কাছে নিয়ে যেতে হবে। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নই উন্নতির মূল কথা নয়। বাংলাদেশের উত্থানের এই মর্মকথাকে উপলব্ধি করে নতুন মূল্যবোধ নিয়ে নতুন সমাজ গঠন করতে হবে। এ জন্য আগের প্রজন্মের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের যোগসূত্র সৃষ্টিতে উত্তরসূরি কাজ করতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সুলতানা কামাল বলেন, ‘খান সারওয়ার মুরশিদ সমাজের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলার শিক্ষা দিয়েছেন। শুধু মা-বাবা, ভাই-বোন নিয়েই আমাদের পরিবার নয়। একা একা বেড়ে ওঠা, বড় হওয়াই সাফল্য-সার্থকতা নয়। চারপাশের সবাই আমার, আমিও সবার—এই ভাবনায় নূরজাহান-মোরশেদ সারোয়ার দম্পতি আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন। উত্তরসূরিও এভাবে কাজ করবে, এটা আনন্দের বিষয়।’

অধ্যাপক আনোয়ারুল করিম বলেন, নতুন প্রজন্মকে আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে বের করে আনতে হবে। দেশের ও সমাজের জন্য কাজ করার মনোভাব সৃষ্টি করতে হবে।
মাহমুদ শাহ কোরেশী বলেন, দেশের প্রতি খান সারওয়ার মুরশিদের ভালোবাসা ও ভাবনা ছিল সুগভীর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে কাজ করার সময় তিনি যে ‘ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ’ স্থাপন করেছিলেন, কেবল সে কারণেই তাঁর স্মৃতি অক্ষয় হয়ে থাকবে।

হাসনাত আবদুল হাই বলেন, ব্যক্তিজীবন, কর্মজীন এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা—সবদিক থেকে তিনি (খান সারওয়ার মুরশিদ) একজন অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। সুরুচি, নতুন মূল্যবোধ সৃষ্টিতে নিরলস কাজ করে গেছেন।

রফিকুন নবী বলেন, সাহিত্য থেকে শিল্পকলা—সব ক্ষেত্রেই গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁর সম্পাদিত নিউ ভ্যালুজ নামের পত্রিকায় নতুন ভাবনার সূত্র থাকত।

খান সারওয়ার মুরশিদ ও নূরজাহান মুরশিদ দম্পতির স্মরণসভায় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল

সভাপতির বক্তব্যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা এক বিচ্ছিন্নতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। করোনা মহামরি সেই বিচ্ছিন্নতাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। সমাজের ভেতরে ধনী ও দরিদ্রের দূরত্ব বাড়ছে, নতুন ঔপনিবেশিকতার সৃষ্টি হয়েছে। এর অবসানের জন্য প্রয়োজন সাংস্কৃতিক জাগরণ। তরুণেরাই এতে নেতৃত্ব দেবে এবং তারা যেন পথভ্রষ্ট না হয়, সে জন্য এই সাংস্কৃতিক জাগরণের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকতে হবে। সমাজে পরিবর্তন আনতে হবে।’

এ অনুষ্ঠানেই আগের প্রজন্মের আলোকিত ব্যক্তিদের স্বদেশ, সমাজ, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে ভাবনার উত্তরাধিকার নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ‘উত্তরসূরি’ নামের একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। নতুন মূল্যবোধ নিয়ে মানবিক সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক জাগরণের আহ্বান জানানো হয় সংগঠনের পক্ষ থেকে।

উত্তরসূরির কাজ সম্পর্কে শারমীন মুরশিদ বলেন, প্রথমিক পর্যায়ে তিনটি কাজের পরিকল্পনা করা হযেছে। এর একটি হলো সমাজ, সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা। এ ক্ষেত্রে যাঁরা বিশেষ কাজ করছেন, তাঁদের সহায়তা করা। দ্বিতীয়টি হলো নির্দিষ্টি বিষয় নিয়ে বছরে তিন থেকে চারটি গণবক্তৃতার আয়োজন করা এবং তৃতীয় কাজটি আর্কাইভ গড়ে তোলা ও প্রকাশনা।