Thank you for trying Sticky AMP!!

আলোকিত মাতামহের আদর্শ দৌহিত্র

লতিফুর রহমান সাহেব আজ নেই। কিন্তু তাঁর সততা, দৃঢ়তা, নৈতিকতা, উচ্চায়ত মূল্যবোধ আমাদের মাথাও সর্বদা রাখে উঁচু।

হাস্যোজ্জ্বল নানা লতিফুর রহমান ও নাতি ফারাজ আইয়াজ হোসেন। লতিফুর রহমান ও শাহনাজ রহমানের বিবাহবার্ষিকী অনুষ্ঠানে নানার কানে কানে নাতির কথা বলার চকিত মুহূর্ত। ২১ আগস্ট ২০১৫।

২০১৬ সালের ১ জুলাই ফারাজ আইয়াজ হোসেন পৃথিবী থেকে বিদায় নিল। তার নানা লতিফুর রহমান তখন বিদেশে। দুঃসংবাদ শুনে ওই দিন সন্ধ্যায় ঢাকায় আসেন। কী ভয়াবহ ছিল তাঁর সেই মুহূর্তগুলো! কী মর্মপীড়ার মধ্য দিয়েই না যেতে হচ্ছিল তাঁকে। তিনি হারিয়েছেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় নাতিকে। পরিবারের মধ্যে ফারাজ পরিচিত ছিল ‘ছোটু’ হিসেবে। আর নানা লতিফুর রহমান তাকে ডাকতেন ছোটন বলে। ছোটনকে নানা আদর করতেন একটু বেশিই।

১৯৯৬ সালের ১৫ এপ্রিলে জন্ম নেওয়া ফারাজ স্কুলে ছিল ভালো ছাত্র। ঢাকায় আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে সমাবর্তন বক্তৃতা দেওয়ার গৌরব সে অর্জন করেছিল, ক্লাস ফাইভে থাকতেই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য প্রেসিডেন্ট (জর্জ ডব্লিউ বুশ) পুরস্কার পেয়েছিল। আমেরিকার এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলে আন্ডারগ্রাড ছাত্র হিসেবে সেখানকার সবার চিত্ত জয় করে নিয়েছিল, সেই ফারাজ আর নেই। লতিফুর রহমান সাহেবের সমস্ত অস্তিত্ব সেদিন শোকে–ক্ষোভে বিদীর্ণ হওয়ার কথা।

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ১ জুলাই রাতে আমাকে আর রিপোর্টার রোজিনা ইসলাম ও আলোকচিত্রী িজয়া ইসলামকে নিয়ে চললেন গুলশান–২–এর দিকে। আমরা কী বলব লতিফুর রহমান সাহেবকে?

লতিফুর রহমান সাহেবের বাড়ির বাতি তখন নিভিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। আমাদের দেখে তিনি আলো জ্বালাতে বললেন। অন্য কোনো কথা না বলে বললেন, টেবিলে খাবার দাও। আমাদের
নিয়ে খেতে বসলেন। আমাদের পাতে ভাত তুলে দিতে দিতে বললেন, ‘শুনেছেন নিশ্চয়ই, ফারাজকে ওরা ছেড়ে দিতে চেয়েছিল, চলে যেতে বলেছিল। ফারাজ তার বন্ধুদের ছেড়ে আসতে অস্বীকার করেছে।’

‘জি। নিউইয়র্ক টাইমস–এ প্রকাশিত হয়েছে।’

লতিফুর রহমান সাহেব রাত একটার দিকে বিদায়ের সময় বাসার বাইরে এসে আমাদের গাড়ির দরজা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। মতিউর রহমান পরে গাড়িতে আমাদের বললেন, লতিফুর রহমান সাহেবের কথা থেকে কিছু কি শিক্ষণীয় আছে? তিনি সংকটের মধ্যেও ইতিবাচক জিনিসটা দেখতে পান, মেঘের আড়ালে দেখতে পান আলোর রেখা।

২০১৬ থেকে ২০২০। চারটা বছর গেল। এই ৪ বছরে লতিফুর রহমান সাহেব সব সময় ভাবতেন তাঁর প্রিয় নাতির কথা। এ সত্ত্বেও আগের দিনগুলোতে যেমন, এই চার বছরেও তিনি মেঘের আড়ালের সূর্যের উপস্থিতিকেই বড় করে দেখেছেন, মেঘের প্রান্তে দেখেছেন আলোর রুপালি রেখা।

২০২০ সালের ১ জুলাই, তাঁর প্রিয়তম দৌহিত্রের চলে যাওয়ার দিনটাকেই লতিফুর রহমান সাহেব যেন বেছে নিলেন তাঁর তিরোধানের দিন হিসেবে।

ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে নীতিনৈতিকতা, সুনাম আর সততার স্বীকৃতি হিসেবে লতিফুর রহমান ২০১২ সালে পেয়েছেন বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড। তিনি প্রথম আলোর উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও এমডি ছিলেন। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম দাবি করেন, তাঁরা দুজন হলেন পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাধীন সম্পাদক। উদ্যোক্তারা কোনো দিনও সম্পাদকীয় স্বাধীনতায় বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ করেননি। বরং সব সময় সাহসী, সৎ, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় ইস্পাতদৃঢ় সমর্থন দিয়ে গেছেন লতিফুর রহমান সাহেব। বাংলাদেশের বিজয়ের ব্যাপারে ছিলেন সদা আশাবাদী, বাংলাদেশের সুখবর শোনার ব্যাপারে ছিলেন সদা আগ্রহী। তাঁর ছোট মেয়ে শাজনীনও অপঘাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাঁর প্রাণপ্রিয় নাতিও হোলি আর্টিজান ট্র্যাজেডির শিকার হলো, এরপরও এই পরিবারের সবার পাসপোর্ট সবুজ, তাঁরা কখনোই দেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবেনওনি।

লতিফুর রহমান সাহেব ১ জুলাই রাতে আমাদের বলেছিলেন, ‘ফারাজ এই ঘোর বিপদের মধ্যে সততা, মূল্যবোধ, বন্ধুত্ব, সাহসিকতার যে পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে দিতে পেরেছিল, আমরা কি হঠাৎ করে তা দিতে পারব। ভেবেচিন্তে হয়তো দেওয়া যাবে, কিন্তু উপস্থিতভাবে? ফারাজ আমাদের সবাইকে হারিয়ে দিয়েছে আদর্শবাদিতার পরীক্ষায়, কিন্তু আমাদের সবার মাথা উঁচু করে দিয়ে গেছে।’

লতিফুর রহমান সাহেবও আজ নেই। কিন্তু তাঁর সততা, দৃঢ়তা, নৈতিকতা, উচ্চায়ত মূল্যবোধ আমাদের মাথাও সর্বদা রাখে উঁচু। লতিফুর রহমান সাহেবের করা সেই প্রশ্নটা আমাদেরও সব সময় তাড়িত করে, আমরা কি সততার পরীক্ষায়, সাহসিকতার পরীক্ষায়, মূল্যবোধের পরীক্ষায় এমনিতর দৃঢ়তা দেখাতে পারব?

লতিফুর রহমান সাহেব অনেকবার পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছেন এবং সাহস, মূল্যবোধ, সততার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গেছেন। ছোট্ট ফারাজ, তাঁর আদরের নাতি, নিজের জীবন দিয়ে বাংলাদেশের অতিথিবাৎসল্য, বন্ধুত্বের মহিমার চরম উৎকর্ষ দেখিয়ে দিয়েছে।

১ জুলাই দুজনই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, আমাদের মাথা উঁচু করে রেখে গেছেন আর আমাদের সামনে অনুকরণযোগ্য, অনুসরণযোগ্য আলোকিত জীবনাদর্শ রেখে গেছেন। তাঁদের দুজনকেই অভিবাদন।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক